মাই এক্স (১৫ তম পর্ব)

আজ ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করলাম। যাকে বলে ‘ড্রিম কেম ট্রু’ টাইপ ব্যাপার।। ইউনিভার্সিটিতে যেন জয়েন করতে পারি সেজন্য কি খাটনিই না খেটেছিলাম একসময়। একটুর জন্য হয়নি। দুই মার্কের জন্য ফার্স্ট হতে পারিনি। সেকেন্ড হই। বাট সেটা কিন্তু কম ছিল না। অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলাম মাত্র আমরা ক’জন।

মন খারাপ হয়েছিল খুব। সে সময় সুমন পাশে দাঁড়িয়েছিল, বলেছিল, একদম ভেঙ্গে পড়বে না। এখনও সুযোগ আছে, মাস্টার্সে ফার্স্ট হলে। লেগে পড়লাম। মাস্টার্সে ক্লাস শুরুর তখন তিনমাসও হয়নি। দিনরাত পড়াশোনা করতাম। আর সুমনের কাজ ছিল নিয়মিত স্বপ্ন দেখান। কি অদ্ভুত ছিল দিনগুলো। আজ যখন আবার ইউনিভার্সিটির করিডোর ধরে হাঁটছিলাম, কানে শুধু সুমনের কথাগুলো ভাসছিল, ‘ভালমতো পড়, ফার্স্ট হতেই হবে। এরপরে একসাথে চাকরী করব।’ কখন যেন নিজেও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম, আমি ফার্স্টই হচ্ছি।
ওর মাস্টার্সের রেজাল্ট হব হব করছে। ওয়ারেস স্যার তখন ডিপার্টমেন্টাল হেড। একদিন সুমনের সাথে যখন উনার করিডোরে দেখা হয়, তখন উনি সুমনকে ‘কংগ্র্যাচুলেট’ ও করেন। তারপরও অফিশিয়াল রেজাল্ট না হওয়া পর্যন্ত, কোন ভরসা নেই। সুমন অবশ্য জানিয়ে দিয়েছে, মাস্টার্সের আগে ও বিয়ে করবে না। আমার পরীক্ষা শেষ হবে, এরপরে। শাসনও করে গেছে, পরীক্ষার আগে প্রেম, বিয়ে এসব নিয়ে একদম আলাপ না। সপ্তাহে একদিন, লং ড্রাইভ। গাড়ীতে না, রিক্সায়। এরপরে ঝন্টু রেস্তোরায়, কেবিনে বসে গল্প। অধীর হয়ে অপেক্ষা করতাম দিনটার জন্য।
এরপরে হঠাৎ একদিন, জীবনটা তছনছ হয়ে যায়। সুমনের জেল হয়। পড়াশোনা শিকায় ওঠে। সুমনের কি হবে? আমিই বা কি করব? সারাটা ক্ষণ দুশ্চিন্তায় কাটত। সপ্তাহে একদিন, সুমনের সাথে দেখা করতে যেতাম। ও শান্ত স্বরে কেবল একটাই কথা বলত। ‘ফার্স্ট হওয়া চাই।’ঐ একটা কথাতেই কোথা থেকে যেন একরাশ সাহস ফিরে পেতাম। এমন হতাশার মাঝেও, পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
একদিন হঠাৎ সুমন বলে বসল, আর এখানে আসবে না। কারণ জানতে চেয়েছিলাম, কিছু বলেনি। দেখতে দেখতে বছর খানেক কেটে গেল। রিউমার শুরু হয়, ওকে আর ছাড়বে না। এদিকে বাবা মা ও বিয়ে নিয়ে আমাকে অতিষ্ট করে ফেলেছেন। তারপরো হয়তো চেষ্টা করতাম। কিন্তু পারলাম না। শাহেদ এসে যায় আমার জীবনে। সময়ও আসলে অনেক কিছু ভুলিয়ে দেয়। অ্যান্ড দেন…সুমনকে বিট্রে করলাম।
বিয়েটা হয়। মাস্টার্সের মাস ছয়েক আগে। শাহেদকে বলেওছিলাম, পরীক্ষার পরে বিয়ে করতে চাই। ও হেসে বলেছিল, তোমার মাস্টার্স শেষ করার গ্যারান্টি আমি দিচ্ছি। এই বিয়ের জন্য, তোমার পড়াশোনায় কোন বিঘ্ন ঘটবে না। প্রমিজ। তবে সেটাই আসল কারণ না, ততোদিনে আমি নিজেও শাহেদকে পছন্দ করতে শুরু করে দিয়েছি। রিয়েলি নাইস একটা ছেলে।
এরপরে তো সবকিছু অন্যরকম হয়ে গেল। নতুন বিয়ে, নতুন সংসার, সব মিলিয়ে পড়াশোনা হল, তবে সেভাবে না। আর ফার্স্ট হওয়া তো পুরোপুরি শিকেয় উঠল। পাশ করতে পারলে হাজার শোকর। অবশ্য শাহেদের উৎসাহও একটা কারণ। পড়াশোনাটা কন্টিনিউ করি আর রেজাল্ট খারাপ হয়নি। বাট ফার্স্ট হতে পারিনি, এবার থার্ড। তাই টিচার হওয়া হয়নি। ওটা অবশ্য আর ড্রিম ছিলও না। শাহেদের জীবনে প্রবেশ করে যে আধিক্যের মাঝে পড়লাম, তাতে ড্রিম কোথায় যে হারিয়ে গেল, নিজেই জানি না।
এরপরে দীর্ঘ দেড় বছর বই থেকে একেবারে দূরে। শাহেদ জানতে চেয়েছিল, চাকরী করতে চাই কি না। ওর জিজ্ঞাসায় অবশ্য উৎসাহ কম ফর্মালিটি বেশি ছিল। মনে হল, ও আসলে চায় না আমি চাকরী করি। আর তাছাড়া আমার নিজের ভেতরেও কেমন একটা আলসেমি ভর করেছিল। টিপিক্যাল গৃহিনীর মত, বাসায় টিভি দেখা আর বরের ফিরে আসবার ওয়েট করতে কেমন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম।
এরপরে অনেকেই চাকরী করার কথা বললেও, কখনই গা করিনি। পত্রিকায় সার্কুলার দেখে অ্যাপ্লাই করার কথা ভাবিনি। ইচ্ছেও যেমন করেনি, তেমনি কেউ সেভাবে জোরও করেনি। একদিন ওয়ারেস স্যারের সাথে দেখা হয়েছিল, উনি বলেছিলেন চলে আসো ইউনিভার্সিটিতে। আমি ‘দেখি’ টাইপ একটা উত্তর দিয়ে চলে আসি। শাহেদকে বললাম। ও নাক শিঁটকাল। বলল, ‘টিচারের আর কত বেতন?’ আর ওপথে যাওয়া হয়নি।
সেই ঘটনার প্রায় দেড় বছর পরে আবার যে ইউনিভার্সিটিতে ফিরে যাব, ভাবিনি। তবে চাকরীটার জন্য কাউকে যদি ক্রেডিট দিতে হয়, সেটা তিথির। সেটা মাস দুয়েক আগে। ওদের কলেজে তখন দিন পনের হল জয়েন করেছি। সার্কুলারের খবরটা ও ই আমাকে দেয়। ও অ্যাপ্লাই করছে। খবরটা পেয়ে দুজনেই সোজা ওয়ারেস স্যারের সাথে দেখা করি। উনি উৎসাহ দিলেন। বললেন, অ্যাপ্লাই কর, দেখা যাক।

ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে আসবার সময় উৎসাহে যখন আমি বেশ টগবগ করছি তখন তিথি বাঁকা হাসি দিল বলল ওসব পলিটিক্যাল জব। পার্টির সদস্য দেখে ঢোকাবে। আমাদের কারো হবে না। আমি বিশ্বাস করিনি। তখন তিথি পুরো গল্পটা বলল।

আসলে ওর বরের প্ল্যানিং ছিল, কমার্স ডিপার্টমেন্ট খুলে সেখানে তিথিকে লেকচারার হিসেবে নেবে। নিয়েওছিল। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। সেক্রেটারী সাহেব যখন বেশি ঘুষ চেয়ে বসলেন, তখন ওরা পড়ল সমস্যায়। এমন সময় শেলির বিয়েতে দেখা হয় সুমনের সাথে। কলেজের ফাইলটা ক্লিয়ার হচ্ছে না, কথাটা তখন ওরা সুমনকে বলে। সুমন এক ঝটকায় কাজটা করে দেয়। আর আশ্বাস দেয়, সরকারীও করে দেবে।

এরপরে যখন দেখে সুমন কাজটা না করে খালি ঘোরাচ্ছে, তখন ওরা খোঁজ খবর শুরু করে। এক কেরানী নাকি ওদের খবর দেয়, আমাকে নিলে নাকি কাজ হবে। কথাটা জানতে পেরে কলেজ কমিটির সবাই সিদ্ধান্ত নেয়, আমাকে নেবে। যেহেতু পোষ্ট মাত্র একটা, তাই তিথি কলেজ থেকে রিজাইন করে আর আমাকে সেখানে ঢোকায়। এসব ঘটনা আমাকে আগে জানায়নি। তিথি ভাল মতই জানে, একথা জানলে হয়তো জয়েন করতাম না। আর না জয়েন করলে সুমন ওদের কাজটা করে দেবে না।
যাই হোক জানার পর আমি এক মূহুর্ত দেরী করি না। রিজাইন করি। তিথি আঁতকে ওঠে। আমার হাত চেপে ধরে রিকোয়েস্ট করে,
— আর কটা দিন। প্লিজ।
— কেন?
— সরকারীটা হয়ে যাক।
এই রিকোয়েস্টের একটা কারণ আছে। কেরানী মারফত ওরা খবর পেয়েছে, ওদের কলেজের ফাইলটা মুভ করা শুরু করেছে। অনেক টেবিল পার হয়ে প্রাইম মিনিস্টারের টেবিলে যাবে। আর সেটা একবার হয়ে গেলে আর কোন সমস্যা নেই। তখন সুমন চাইলেও আর ব্যাপারটা রিভার্স করতে পারবে না। তাই সে পর্যন্ত আমাকে থাকতে বলল। সময়টা কতদিন জানতে চাইলাম। জানাল প্রাইম মিনিস্টারের সাইন হতে আর গেজেট হতে এখনও মাস তিনেক লাগবে। ওর কথা শুনিনি। সুমনের কারণে আমার জব হয়েছে, কথাটা শুনেই গা রি রি করছিল। তিথি খুবই কাঁদছিল। হাত ধরে রিকোয়েস্টও করেছিল। কোন কথা শুনিনি। চলে এসেছিলাম।
এরপরে আর কোনদিন ঐ কলেজে যাইনি। বাসায়ই ছিলাম। সার্কুলার দেখে অবশ্য মাঝে মাঝে এদিক ওদিক কয়েকটা কলেজে অ্যাপ্লাইও করি। কাজ হয়নি। এরপরে একদিন আসে ইউনিভার্সিটির ইন্টারভিউ কার্ড। দেখ এক মূহুর্তের জন্য সুমনের কথা মনে হয়েছিল। নিজের ভাগ্যের ওপরই হাসলাম। আমার সেই ড্রিমের কাছেই আবার ফিরে এলাম, বাট অনেক পথ ঘুরে।
ইউন্টারভিউতে গেলাম। খারাপ হল না, ভালোই হল। ওয়ারেস স্যারও বেশ ইম্প্রেসড মনে হল। উনি হেড, সর্বেসর্বা। উনি চাইলে, কেউ আর না বলবে না। যদিও বেশ কজন ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট আছে। তবে সবাই ছেলে। কেবল আমি মেয়ে। তারপরও আমি আশাবাদী ছিলাম।
রেজাল্ট হল। আমি সিলেক্টেড। কেন হলাম, জানি না। আমার জেন্ডার হয়তো আমাকে হেল্প করেছে, কিংবা ওয়ারেশ স্যার আমাকে স্নেহ করতেন, এটাও কারণ হতে পারে। কারণ যা ই হোক, সুমন অন্ততঃ না, এটাই সবচেয়ে বড় শান্তির ব্যাপার। মনে হল, নতুন ভাবে জীবন ফিরে পেলাম। কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তখন তিথির কথা মনে হল। ভাবলাম ওকে খবরটা জানাই। ফোন দিলাম।
— কেমন আছিস?
— এই তো?
— কলেজ?
—চলছে।
— তুই জয়েন করেছিস?
— হ্যা।
— গুড। শোন, ইউনিভার্সিটিতে আমার চাকরীটা হয়ে গেছে।
— তাই? কংগ্র্যাটস।
বেশ শুকনো কংগ্র্যাটস। বুঝলাম, এখনও মন খারাপ করে আছে। হয়তো কলেজের কাজটা হয়নি। জানতে চাইলাম
— আর তোদের কলেজের ফাইল?
— এগোচ্ছে। এখনও প্রাইম মিনিস্টারের সই হয়নি।
গলায় হতাশা। একবার মনে হল, কথাটা বলেই ফেলি। তারপর নিজেকে সংযত করলাম। পুরোটা বলা যাবে না। শুধু জানাই
— ভয় পাস না। কাজটা হয়ে যাবে।
তিথি অবাক হয়ে জানতে চায়
— মানে?
উত্তর দিলাম না। লাইন কেটে দিলাম।
কারণ উত্তরটা শুধু আমি জানি। বাট কাউকে বলা যাবে না। খবরটা হাইলি কনফিডেনশিয়াল।

চলবে….

-রাজিয়া সুলতানা জেনি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *