বোকা মেয়ের গল্প ( ৫ম পর্ব )

রফিক সাহেব ভ্রু কুঁচকে বলেন-এই সাদা জামাটা বদলাও তো।

কেকা হাসে- কেন বাবা?

‘ওকে নীল জামা পড়াও।সাদা জামায় ভালো লাগছে না।
কেকা দৌঁড়ে যায়, নীল জামা এনে পড়ায়।

কেকা এইদিকে আসো,মায়া বেগম ডাকেন।

কেকা দৌঁড়ে আসে- কী হয়েছে মা?

ওকে এখনও খাওয়াও নাই? খিদা লাগছে তো।
মায়া বেগমেরই যেন খিদেয় জান যায় যায় অবস্থা।

কেকা ছেলে রুদ্রকে মায়া বেগমের কাছ থেকে কোলে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে শোনে মায়া বেগম উচ্চস্বরে বলছেন – খাওয়া হইলে ওর জন্য গরম পানি আনো, আমি গোসল করাইয়া দিমু।

কেকার সংসারে যেন দিন বদলের হাওয়া লাগে, নতুন এক প্রাণ যেন সংসারের প্রাণ ফিরিয়ে নিয়ে আসে, মাঝ রাতে রুদ্র কেঁদে উঠলে – মায়া বেগম আর রফিক সাহব সাথে সাথে দৌঁড়ে এসে দরজায় টোকা দেন- কি হলো, ও কাঁদে কেন?
পরস্পরের বন্ধন যেন আগের চাইতে একটু মজবুত হয়। মজবুত হয় নিজ রক্তের টানে। নিজ রক্তের মায়া বড় অদ্ভুত মায়া!

কেকার অনার্স পরীক্ষা শুরু। কেকার প্রার্থনা শুনেই বোধ হয় আল্লাহর ইচ্ছেতেই রুদ্রর জন্ম পরীক্ষার আটদিন আগেই হয়েছিলো।
এখন সন্ধ্যা, কাল সকালে পরীক্ষা। রুদ্রের জন্মের কারণে এই কয়দিন ঠিক মতো পড়াশোনাও করা হয়নি। এর মধ্যে দুটো পরীক্ষা মাত্র হয়েছে। সজল না করায় কেকার আর বাসায় গিয়ে পরীক্ষা দেওয়া হয়নি, স্ত্রী পুত্রকে ছেড়ে সে একদিনও থাকতে নারাজ।

বই নিয়ে বসে আছে কেকা, সব কিছু এলোমেলো লাগছে,একটু পর পর রুদ্রকে খাওয়াতে হচ্ছে নয়তো কাপড় পালটে দিতে হচ্ছে তাই পড়ার প্রতি পুরোপুরি মনোযোগ দিতে পারছে না কেকা। এর মধ্যেই তাহমিনা এসে দরজার পর্দা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে বললো – মেহমান আসছে ভাবী, কাকী বলছে আপনারে নাস্তা বানাইয়া দিতে। কেকা বই থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে বললো – তাহমিনা তুমি তো সবই পারো, যাওনা একটু নাস্তাটা বানিয়ে দাও। আমার না অনেক পড়া বাকী আছে,পারবে না তুমি? তাহমিনা হেসে পারবে বলে চলে গেলো ।
সন্ধ্যা নাগাদ কেকার ডাক পরলো ড্রয়িং রুমে, যথারীতি শালিস বসেছে ।
মায়া বেগম তারস্বরে বললেন -তোমারে নাস্তা দিতে কইছিলাম, আর তুমি না করছো, এতো সাহস তোমার?

‘মা আমার পড়া বাকী ছিলো, কাল সকালে পরীক্ষা অথচ অনেক পড়া রিভিশন দেওয়া বাকী, তাই তাহমিনাকে বলেছিলাম নাস্তাটা করে দিতে,ও তো পারে, ও আজকে একটু করে দিলে ক্ষতি কী?মায়া বেগম ক্ষোভে ফেটে পড়লেন – ইস! লাট সাহেবের বেটি আইছে, উনি পড়াশোনা করে জজ ব্যারিস্টার হবেন। বলেই মুখ ঝামটা দিলেন।
চিৎকার চ্যাঁচামেচি চললো বেশ কিছুক্ষণ।

কেকা নিজের ঘরে এস চুপচাপ বসে রইলো, তার আর ইচ্ছে হচ্ছে না পড়াশোনা করতে, বারবার বাবার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে, ছেলেহীন এই মানুষটা তার তিন মেয়েকে শিক্ষিত করেতে চেয়েছিলেন, কোনদিন তার তিন মেয়ে সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারে কোন রকম চাহিদা পূরণ করতে কোন কার্পণ্য করেন নি তিনি। নিজে কখনও তার চাহিদা গুলোর দিকে তাকিয়ে দেখেন নি, কখনও মাইলের পর মাইল হেঁটে এসে ক্লান্ত শরীরে একটা কোকের বোতল কিনে খাননি, পারতো পক্ষে রিক্সায় চড়েন নি বরং ভেবেছেন কোন বইটা মেয়েদের কিনে দিতে হবে? কাল সকালে মেয়ের কতটাকা হাত খরচ দিতে হবে? এই কষ্ট তিনি শুধু মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়েই সহ্য করেছেন, তার মনে একটাই আশা ছিলো ছেলে নেই তো কী হয়েছে? মেয়ে গুলোকে শিক্ষিত করবেন। সমাজের নিয়মে হয়তো তিনি মেয়েকে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন কিন্তু বিয়ের সময় তার একটাই আবদার ছিলো মেয়ের পড়াশোনা যেন বন্ধ না হয়। ভাবতে ভাবতে অভিমানে কেকার দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিলো, ঠিক এমন সময় সজল অফিস থেকে ফিরে এসে সব শুনলো ।

কেকা মন খারাপ করে বললো – আমি আর পরীক্ষা দিবো না। আর পড়বো না।সজল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো – তুমি তৈরি হয়ে নাও, আমরা একটু বাইরে যাবো।কেকা যদিও প্রথমে যেতে রাজি হলো না, কিন্তু সজলের পিড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত ওর সাথে বাইরে যেতে বাধ্য হলো।

কফি শপে বসে কেকা আর সজল, মজার মজার সব গল্প বলছে সজল , কেকার সেসব কথা শুনতেও ইচ্ছে করছে না। কিন্তু সজলের একটা বড় গুণ হচ্ছে সে পরিস্থিতি খুব সহজেই হালকা করে দিতে পারে, তার সামনে বেশিক্ষণ গম্ভীর হয়ে থাকা যায় না, এক সময় না এক সময় হেসে উঠতেই হয়। কথায় কথায় কখন যে কেকা হেসে উঠলো, কখন যে মনের ভিতরের মেঘ গুলো দূরে কোথাও হারিয়ে গেলো কেকা বুঝতেও পারলো না।
ঘরে ফিরে সজল কেকাকে বললো এবার পড়তে বসো, কাল পরীক্ষার পর তোমাকে তোমার বাসায় দিয়ে আসবো। পরীক্ষা শেষ করে তারপর ফিরবে। সব ভুলে কেকা পড়ছে, তাকে তার বাবার ইচ্ছে পূরণ করতে হবে, সজলের মতো একটা মানুষ যার পাশে আছে তার আর কষ্ট কিসের !
পরীক্ষা শেষে বাবার বাসা থেকে ফিরে এলেও কেকার মৌখিক পরীক্ষা তখনও বাকী ছিলো।

রোজা চলছে। রুদ্রকে রেখে সারা বিকেল ভার্সিটিতে অপেক্ষা করার পর যখন কেকার রোল ডাকার সময় হলো ঠিক তখনই মাগরিবের আজান দিলো, আজকের মতো পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়া হলো, কাল সকালে আবার আসতে হবে। ক্লান্ত দেহে বিরক্ত কেকা যখন ঘরে ফিরলো মায়া বেগম তখন গর্জে উঠলেন – আবার কালকে যাইতে হইবো? এই পড়াশুনা ধুইয়া আমি কী পানি খামু? সারাটা ক্ষণ তিনি গজগজ করলেন। কেকা সবাইকে বলে দিলো অনার্স পরীক্ষা শেষ হলে সে আর মাস্টার্স পরীক্ষা দিবে না। পরদিন ভার্সিটি থেকে ফিরে বিষণ্ণ মনে নিজের ঘরেই শুয়ে ছিলো কেকা, দুপুরের খাবার খেতেও আর তার ইচ্ছে হচ্ছিলো না। খাবার ঘর থেকে রফিক সাহেব ডাক দিলেন, মায়া বেগম ততক্ষণে খাওয়া শেষ করে উঠে গেছেন। কেকা উঠে গিয়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালে রফিক সাহেব নরম গলায় বললেন- ভাত খেয়েছো?

কেকা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।

রফিক সাহেব এবার আরও গভীর স্বরে বললেন -যাও তোমার প্লেট নিয়ে আসো, তুমি না খেলে আমিও খাবো না, এই দেখ আমি খালি প্লেট নিয়ে বসে আছি। তুমি এলেই আমি একসাথে খাবার খাবো ।
বহুদিন পর শশুড় বাড়ির কারও আচরণে কেকার চোখ আবার ছলছল করে উঠতে চায়, মনের ভিতর উথলে ওঠে ভালোবাসার নদী। এতদিনে সংসারটা বুঝি কেকার আরও একটু আপন মনে হয়, ভালোবাসার পরশ লাগে। আত্মীয় স্বজন পরিবার ফেলে আসা একটা মেয়ে এতদিনে কি নতুন করে শেকড় খু্ঁজে পায়, মেয়েরা তো নিজেকে হারিয়ে আবার খুঁজে পেতে জানে, খুজে পেতে তারা বাধ্য হয়।
অথচ একটা শক্ত শিকড় থেকে উপরে আনা একটা গাছের অংশ আবার যখন নতুন মাটিতে রোপণ করা হয় তখন সেই গাছে নিয়মিত জল দিতে হয় তার জন্য দরকার পরে বিশেষ যত্ন। সজলের ভালোবাসা, রফিক সাহেবের মায়া মাখা দুটো কথাই হতে পারে সমূলে উপরে আনা সেই গাছের জন্য যত্নের ছোয়া, ভালোবাসার জল।
কিন্তু কয়জন কেকার এটুকু ভাগ্যে জোটে? অথচ এটাই তো তাদের পাওনা। ভালোবাসা পেতে হলে ভালোবাসা দিতে হয়।

এই সংসারে এত দিনে সজলের পরে আর একজন মানুষ কেকার খুব আপন হয়ে ওঠে, আর তিনি হলেন তার শশুড় রফিক সাহেব। ভালো মন্দ, দুঃশ্চিন্তা সবকিছু এখন কেকা তার সাথেই ভাগ করে নেয় । মাঝ রাতে কখনও সজল বাড়ি ফিরতে দেরি করলে কেকা যখন ড্রয়িংরুমে একা একা বসে থাকে তখন রফিক সাহেব এসে কেকার পাশে বসে থাকেন। আকাশে ঘন কালো মেঘ করলে কেকা যখন দৌঁড়ে ছাদে যায় কাপড় আনতে রফিক সাহেবও কেকার সাথে দৌঁড়ে যান, কেকাকে সাহায্য করতে।
কেকার ছেলে রুদ্রকে যখন কেকা মুখে তুলে ভাত খাইয়ে দেয়। রফিক সাহেব তখন পাশে বসে বাচ্চাদের কন্ঠ নকল করে বলেন- আমু, খাবারটা তো খুব মজা হয়েছে! আমিও খাবো আম্মু, আমাকে দাও, আমাকে দাও।
রুদ্র তখন দাদাকে হারিয়ে দিয়ে কেকার হাতে তুলে ধরা খাবারটা জলদি খেয়ে নেয়, রফিক সাহেব আর কেকা রুদ্রর এই জিতে যাওয়া দেখে আনদে হেসে ওঠে। ক্রমশই রফিক সাহেবের চেহারাটা কেকার বাবার চেহারার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে থাকে। রফিক সাহেব দিন দিন কেকার বাবা হয়ে ওঠেন।
নিজের মেয়েকে শশুড় বাড়ি পাঠিয়ে রফিক সাহেব যেন কেকাকেই তার অবলম্বন করে নেন।
রফিক সাহেবের উৎসাহ আর সজলের পাশে থাকা,কেকার জীবনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়,কেকা মাস্টার্স পরীক্ষা দেবে না ঠিক করেছিলো কিন্তু এই দুজনের পিড়াপিড়িতে পরীক্ষাটা শেষ পর্যন্ত দেয় সে এবং খুব ভালোভাবেই পাশ করে, রেজাল্ট পেয়ে যখন কেকা মায়া বেগমকে সালাম করে, মায়া বেগম তখন মুখ বাঁকিয়ে বলেন- এতে সালাম করনের কী হইছে?
কেকা অবাক হয়, স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভাবে, যে মানুষ সন্মান নিতে জানে না তাকে আর সম্মান করতে যাওয়ার কোন অর্থ হয় না।

-শামীমা হক ঝর্ণা


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *