বোকা মেয়ের গল্প ( ১ম পর্ব )

সদ্য বিবাহিতা নতুন বউটি খাটের উপরে বসে আছে। কিছুটা আড়ষ্টতা আর ভয় ভয় ভাব নিয়ে। বাড়ির ভিতরে কি হচ্ছে ঠিক সে বুঝে উঠতে পারছেনা। সকাল থেকেই চেঁচামেচি আর হাউ কাউয়ের শব্দে সে আরও আড়ষ্ট হয়ে পড়ছে। গত কালই সে এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয় হয়, এদের চিৎকার চেঁচামেচি কিছুটা কমে এলে অল্প বয়স্ক একটা শ্যামলা করে লম্বা চুলের মেয়েকে এই ঘরে প্রবেশ করতে দেখে বহু কষ্টে সাহস করে এতক্ষণ ধরে মনের ভিতর ঘুরতে থাকা প্রশ্নটা করেই বসে সে – ভিতরে এত চিৎকার চেঁচামেচি কিসের?

প্রশ্নটা শুনে মেয়েটা একটু হাসে, মাথাটা এককাঁত করে একটু ঝাকি দিয়ে বলে – তেমন কিছু না ভাবী, ভাইয়ার খালা-ফুফুরা একটু ঝগড়া করছে, কাকে কী শাড়ি দেওয়া হলো তাই নিয়ে।

কেকা এবার একটু অবাক হয়, শাড়ি পছন্দ হওয়া না হওয়া নিয়েই এত ঝগড়া! বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই মাঝ বয়সী এক মহিলা হাতে একটা বাচ্চাদের ফ্রক নিয়ে এসে কেকার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে -নাও গো বউ মা, এই জামাটার বোতাম গুলো লাগিয়ে দাও তো।
বলেই হাতের কয়েকটা গোলাপি বোতাম আর সুঁই সুতো কেকার দিকে বাড়িয়ে দেয়। সেগুলো সাবধানে হাতের মুঠোয় নিয়ে কেকা ফ্রকটার বোতাম ঘর গুলো খুঁজে নিয়ে উল্টো পাশের ঘর গুলোতে যত্ন করে বোতাম লাগাতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই একটা ব্লাউজ, একটা শার্ট সহ আরও কিছু কাপড় চলে আসে,সেগুলোকে হয় সেলাই করে চাপিয়ে দিতে হবে নয়তো বোতাম গুলো লাগাতে হবে। কেকা টুকটুক করে কাজ গুলো মনোযোগ দিয়ে করতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর শ্বাাশুড়ি মায়ের ঘরে তলব পরে । কেকাকে পাশে বসিয়ে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করার পর তিনি বলেন – বউ মা, অনেককেই তো তোমার হাত থেকে আংটি খুলে দিয়েছো, এইবার তাহমিনাকেও একটা আংটি দিও, আর ওই যে তোমার বড় খালা শ্বাশুড়ির মেয়ে জামাই তাকেও একটা দিও। তাহলে সারা জীবন তারা বলবে, ভাবী তাদের আংটি দিয়েছে।
কেকা হাসি মুখে শ্বাশুড়ির কথায় সম্মতি জানিয়ে নিজের ঘরে চলে আসে। তাহমিনা মেয়েটাকে তার বেশ পছন্দ,সেই যে লম্বা চুলের শ্যামলা করে মেয়েটা সেই ই তাহমিনা। স্বর্ণের জিনিসের প্রতি কেকার বরাবরই কোন আকর্ষণ নেই তাই ওদের ডেকে হাতের আঙ্গুল থেকে আংটি গুলো খুলে দিতে কেকার এক ধরণের অদ্ভুত আনন্দ হয়।

রাতে বউ ভাত । সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষে আবার সবার সাথে বাবার বাড়ি ফিরে আসা, তবে এবার আর আগের অন্য সব বারের মতো ফিরে আসা না, এবার তার সাথে তার বর সজলও আছে। চেনা নিজের ঘরটাতেও যেন অচেনা একটা গন্ধ। ছোট ভাই বোন সবাই মিলে পরিপাটি করে সাজিয়ে রেখেছে। ফুল দিয়ে সাজানো ঘরটাকে কেমন অন্য রকম লাগছে। সারাদিন সজলের সাথে দেখা হলেও ওর দিকে চোখ তুলে একবারও তাকায় নি কেকা। অন্ধকার ঘরটাতে এককোনে সাজানো মোমবাতির আলোয় বিছানায় মুখোমুখি বসা সজলের চেহারায় যেন রাজ্যের মায়া মাখানো।
সংসারের মায়া বোধ হয় এমনই, মেয়েরা সারাজীবনই পরকে আপন করে নেয়।

ফিরতি নাইওর শেষে ফিরে আসে কেকা, তার নতুন জীবনে, নতুন ভালোবাসার ঘরে। যেখানে শুধুই ভালোবাসা থাকে না, থাকে এক একটা হৃদয় জয় করার তীব্র ইচ্ছা। সংসারের কাজে ততটা দক্ষ না কেকা, এত দিন পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে যেটুকু করেছে তাতেই মা মহা খুশি ছিলো। আসলে মায়েরা অল্পতেই খুশি হয়।
সারাদিন ছুটোছুটি সংসারের ব্যস্ততা, সেই সকালে সজলের অফিসে যাওয়া আর সন্ধ্যায় ফিরে আসা, সারাদিনের ক্লান্তি মুছে যেতো সজলের সান্নিধ্যে। গল্প করতে করতে প্রায়ই মাঝ রাত। সজলের আবার রাত জাগলেই খিদে পায়। অফিস থেকে আসার সময় তাই হাতে করে নানান রকম ফল নিয়ে আসাটা সজলের নিত্য দিনের অভ্যাস, ফল গুলো ডাইনিং টেবিলের উপরে ঝুড়িতে সাজানো থাকে। গল্প করতে করতে সজল এক ফাঁকে কেকাকে বলে – খিদে পেয়েছে, কয়টা আপেল নিয়ে এসো তো।
অন্ধকারে আলো জ্বালাতে কেমন যেন লজ্জা হয় কেকার, নিজের ঘরের ভিতর থেকে যে আলো বাইরে ছড়িয়ে পরে, সেই আলোতেই কেকা টেবিলটার দিকে এগিয়ে যায়। ঝুড়ি থেকে আপেল নিয়ে বেসিনে ধুয়ে প্লেটে করে আবার ঘরে ঢুকে যায় সে। এটা এখন প্রতিদিনেরই নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়।
নতুন সংসারে মানিয়ে নিতে কেকার বেশ কষ্ট হচ্ছে, সবাই কেমন যেন একটু গম্ভীর। কথা বলা হাসা এসব যেন এরা জানেই না। রুটিনে বাঁধা সংসার।
ভার্সিটির ক্লাস গুলোও এখন আর কেকার নিয়মিত করা হয় না, কোন মতে বন্ধুদের সাথে ফোনে যোগাযোগ রেখে যেটুকু পড়াশুনা চালিয়ে নেওয়া।
সব কিছু কেমন যেন অন্য রকম হয়ে গেছে। নিজের এত দিনের পরিচিত জগৎটা হঠাৎই বদলে গেছে কদিনের ব্যবধানে।
আগে পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে সংসারের টুকটাক কাজ করতো আর এখন সংসারের কাজের ফাঁকে টুকটাক পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। নিজের সমস্ত কথা এখন কেকা সজলের জন্য জমিয়ে রাখে,যতো হাসি, যতো না বলা কথা সব এখন সজলের জন্য।
সপ্তাহ শেষে কেকার মা বাবা ভাই বোন সবাই অপেক্ষায় থাকে কখন কেকা ফিরে আসবে। কেকারও যেন সপ্তাহ শেষ হতে চায় না। এক একটা দিন যেন এক একটা বছর মনে হয়। তারপর যখন সপ্তাহের ছুটির দিনটা আসে তখন সকালটা শুরু হয় অনাবিল আনন্দ নিয়ে, ঘুমের মধ্যেও কেমন যেন একটা সুখ সুখ অনুভূতি জাগে । সকাল থেকে হাতের কাজ গুলো তাড়াতাড়ি শেষ করে কেকা তৈরী হয় বাবার বাড়ি যাওয়ার জন্য। তারপর সজলের সাথে রওনা হয় বুকের মধ্যে চাপা এক আনন্দ নিয়ে, ফিরে যায় আপন ঠিকানায়।
ছোট বোন গুলো সে ফিরবে বলে যত্নে ঘর সাজায়। মা সারা সপ্তাহের বিষন্নতা ভুলে মেয়ের জন্য পছন্দের খাবার রাধতে বসেন। আর বাবা সকাল থেকে পায়চারি করেন ঘরে আর বাইরে, পথের দিকে তাকিয়ে থাকেন কেকার অপেক্ষায়।
আর কেকা ঘরে ফিরেই ভাই বোনদের সাথে কথার ঝুলি নিয়ে বসে। সারা সপ্তাহের না বলা কথা খইয়ের মতো ফুটতে থাকে কেকার মুখে, সারাঘরময় ছুটোছুটি করে বেড়ায় সে ।
দিন শেষে আবার ফিরে আসে সজলের সাথে নতুন ঠিকানায়। আবার নিজের ভিতরে লুকিয়ে যায় কেকা, আবার সংসারের পারা না পারার হিসেব, আবার দিন শেষে সজলের ভালোবাসায় ভেসে যাওয়া।
ধীরে ধীরে বাবার বাড়ি যাওয়ার উপরও আসে নিষেধাজ্ঞা। এত ঘন ঘন বাবার বাড়ি যাওয়া কিসের? সংসারে কাজ আছে না।
মা ভাই বোন গুলো অপেক্ষায় থাকে, এখন মাস ঘুরলে তবেই তাদের দেখতে যাওয়া যায়। নিজেকে বন্দী পাখির মতো মনো হয় কেকার, খাঁচার ভিতরে ছটফটিয়ে মরে সে!

বিকেল বেলা সজলের জন্য নাস্তা বানিয়ে বসে থাকে কেকা , ফিরে এলে নাস্তা দিয়ে গল্পে বসে। অথচ সেখান থেকে খাবার তুলে খাবার সাহস হয় না তার, আবার কেউ যদি কিছু বলে। শ্বাশুড়ি যে পরিমাণ দেখিয়ে দিয়েছেন সেই পরিমাণেই রান্না করে এবং ভালোভাবেই বোঝে কেকা এটা দুজনের পরিমাণের কখনই না। কেকার মন পড়ে থাকে বাবা মা ভাই বোনদের সাথের বিকেলের চায়ের আড্ডায়, সবার প্রাণবন্ত হাসি আর মায়ের হাতের চায়ের অভাব এখন কেকা বড্ড অনুভব করে। শ্বশুরের জন্য সকাল বিকেল চা বানায় কেকা কিন্তু নিজের জন্য চা বানানোর সাহসও হয় না তার।
সময় যায়, চলে আপন করার আপ্রাণ চেষ্টা। তবুও কি ভাবেই যেন দূরত্বটুকু ঘোচানো যায় না। হয়তো সবার চাওয়া পাওয়ার হিসেব মেলে না।

ঈদ আসে, এতদিন সমবয়সী বন্ধুরা ঈদের দিনে ঘরে ঢুকেই চটপটির বাটিটার উপর হামলা করতো। কেকা তাই যত্ন করে চটপটি রাঁধে, ননদ দেবর সবাই হয়তো আগ্রহ নিয়ে খাবে সেই ভাবনায়, কিন্তু এখানে মানুষ কোথায়? কেকার জানা উচিত ছিলো চটপটি এখানে চলে না, পায়েসও না। পাতলা খিচুড়ি আর গরুর মাংসই যথেষ্ট। রাতে যথারীতি বিচারের আসর বসে শ্বশুর শ্বাশুড়ি সবাই মিলে।
কেকার তলব পরে, ভীরু ভীরু পায়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকে এক কোণায় আড়ষ্ট হয়ে দাড়ায় কেকা। যেন কাঠগড়ায় দাড়ানো আসামী। দু’চার কথার পর শ্বাশুড়ি বলেন- এই যে ড্যাগ খানেক চটপটি রাঁধছো এগুলোর হবে কী?
কেকা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, কী উত্তর দিবে ভেবে পায় না। হয়তো ভয়ে তার শরীরটাও একটু কেঁপে কেঁপে ওঠে।
এবার শ্বাশুড়ির গলা আরও একটু উপরে ওঠে – কইলা না, হা ভাইত্তার ঘরের হা ভাইত্তা।

কেকা উত্তর দিতে পারে না শুধু চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। সেই কান্নাও কাউকে দেখাতে সাহস পায় না, মাথা নিচু করে থাকে যেন কান্নার ছাপ গালে লেগে না যায়, যেন কারও চোখে না পড়ে, যেন চোখ থেকে টুপ করে পড়েই সেই কান্না মিলিয়ে যায় বাতাসে।
কথা আরও হয়, সব কথা কেকার কানে পৌঁছায় না। শুধু যখন কেকা শোনে শ্বাশুড়ি বলছে, তোর বউ তো একটা চোর। প্রতিদিন রাতে তুই ঘুমিয়ে গেলে খাবার টেবিলের উপর থেকে ফল চুরি করে খায়।
কথাটা শুনে এত অবাক হয় কেকা! এক ঝটকায় মাথাটা তুলে সজলের দিকে তাকায়। মনে মনে অপেক্ষা করে সজল নিশ্চয়ই বলবে – না মা, ও চুরি করবে কেন? আমিই তো ওকে নিতে বলি।

কিন্তু কেকা অবাক হয়ে দেখে সজল কোন কথাই বলে না, এই কথা যেন তাকে স্পর্শই করে নি, কথাটা মনে হলো সজলের কানেও পৌঁছায় না। কেকা আবারও মাথা নিচু করে, আবারও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আসামীর মতো মাথা নিচু করে খুব মনোযোগ দিয়ে নিজের পায়ের আঙ্গুল গুলো দেখতে থাকে, এমন ভাবে দেখে যেন চোখের অশ্রু গুলো সারসরি মাটিতে পড়ে মিলিয়ে যায়, গালে যেন কান্নার দাগ না লাগে।
কিন্তু মনের দাগ? সেটা থাকুক। সময়ের হাতে মনের গভীরে। কেকা শুধু একটা কথা বোঝে। সব অপমান গায়ে মাখতে নেই, সব কথা সব সময় বলতে নেই। কিছু কথা সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে হয়।
কেকা আরও বোঝে এই সংসারের যুদ্ধটা তার একার, শুধুই একার।

সবার ভাগ্য হয়তো কেকার মতো হয় না, আবার অনেকেরই হয়। কিন্তু কেকাদের কথা বলতে নেই, কথা বলা অন্যায়।

কেকারা জানে সব কথার উত্তর দেয় কেবলই- সময়।
তাই সময়ের হাতেই সব কথা ছেড়ে দিতে হয়।
জীবন একসময় উল্টো স্রোতে চলতে শুরু করে।

কেকার গল্প কিন্তু এখানেই শেষ নয় মাত্র শুরু, কেকার যুদ্ধ জয়ের গল্প লিখবো অন্য কোন দিন।

চলবে……

-শামীমা হক ঝর্না

https://m.facebook.com/groups/1749042645384412?view=permalink&id=2111152362506770

https://m.facebook.com/groups/1749042645384412?view=permalink&id=2117423651879641

https://m.facebook.com/groups/1749042645384412?view=permalink&id=2130754293879910

https://m.facebook.com/groups/1749042645384412?view=permalink&id=2136447666643906



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *