প্রায়শ্চিত্ত

ইফতার শেষ করে চা খাচ্ছি এমন সময় আরজুর মৃত্যু সংবাদ পাই। কলটা আসে ভাইয়ার ফোনে। ময়মনসিংহ স্টেশন থেকে কিছুটা দূরে, বেগুনবাড়ি রেললাইনের পাশে দ্বিখণ্ডিত দেহের পাশে পাওয়া ব্যাগে আমাদের বাড়ির ঠিকানা ও ফোন নাম্বার।

সারাজীবন পর্দার আড়ালে থাকা অতি রূপবতী আরজুর দুই ভাগ হয়ে যাওয়া শরীর ঘিরে উৎসুক মানুষের ভীড় লেগেছিল। শরীরে আর কোথাও কোনো ক্ষত নেই। শুধু দ্বিখণ্ডিত আর ডান চোখে গভীর কালো দাগ, যেন একুশ বছরের জীবনের সমস্ত ব্যথার চিহ্ন সেই চোখে ধরে আছে।

স্পষ্ট মনে আছে, স্কুলে পড়ি তখন। একদিন আম্মা বলছিলেন-“দেখছিস, আরজুর চোখগুলায় কী মায়া! কী সুন্দর কাজল চোখ।” আম্মার মুখে ওর প্রশংসা শুনে মন খারাপ হতো। কেন আরজুর চোখ এতো সুন্দর? আমার কেনো না? সেই মন খারাপ অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হতো না। সারাদিন অভুক্ত আরজুর কাজল চোখ বেয়ে যখন জল গড়াতো, ওর ফর্সা মুখে কষ্টের লাল আভা আমার ক্ষুদ্রতাকেই যেন ব্যঙ্গ করতো।

এক বছর বয়সে মা-বাবার বিচ্ছেদের একমাত্র শিকার আরজু পেট ভরে ভাত খেলে কেমন লাগে ভুলে গিয়েছিল বোধহয়। সৎ মায়ের ভৎর্সনা আর বাবার অত্যাচার যতটা না শারীরিক, তার চেয়েও মানসিক যন্ত্রণায় রোজ একবার মৃত্যু হত সেই শৈশব থেকেই। মনে পড়ে, ছয় বছর বয়সেও রাতে কাঁথা ভেজাত ও, সেই ভেজা কাঁথা সকালে আবার নিজের হাতেই ধুতে হতো। আহা! কী অভাগী কপাল নিয়ে জন্মেছিল বোন আমার!

কাকার চোখ ফাঁকি দিয়ে আম্মা লুকিয়ে ওকে খাবার, এটা-সেটা হাতে তুলে দিতেন। কিন্তু অন্যের মেয়েকে কতক্ষণ আর আগলে রাখা যায়, হোক সে দেবরের মেয়ে। যে মেয়ের বাবাই তাকে অচ্ছুৎ মনে করে দূরে সরিয়ে রাখে, স্ত্রীর কথায় মা-ছাড়া মেয়েকে শাস্তি দেয়, নির্মম লাঠিপেটা করে, তার চোখ ফাঁকি দেয়া সহজ কিছু ছিল না। বিচ্ছেদের পর শুধুমাত্র নিজের জেদকে জয়ী করতে মেয়েকে নিজের কাছে রেখেছেন, অথচ একদিনের জন্যও তাকে ভালোবাসতে পারেননি! কাকার নতুন সংসারে আরজু ছিল নিতান্তই আগাছা। কুকুর-বেড়ালেরও তবু ভালোমন্দ জুটতো, ওর না। আমরা চেষ্টা করেও মারের হাত থেকে ওকে বাঁচাতে পারতাম না, এতো অসুরের মতো শক্তি ছিল কাকার গায়ে!

এতো অত্যাচারের মধ্যেও আমার দেয়া পুরনো বই পড়ে কোনোরকম পাশ দিয়ে দিয়ে এসএসসি পার করে আরজু। দিন যায়, আমরা একসাথে শিশু থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবনে পা দেই, তবু অত্যাচার কমে না! শেষের দিকে অনেকটা অপ্রকৃতস্থ হয়ে গিয়েছিল। সোজা কথায় মানসিক রোগী। আধপাগল মেয়েটাকেই চিকিৎসার বদলে শেকলে বেঁধে রাখতেন। মনে প্রশ্ন জাগত, নিজের মেয়েকে এতোটা অত্যাচারের কারণ কি শুধুমাত্র বিচ্ছেদ? নাকি নতুন স্ত্রীকে খুশি রাখার অসুস্থ প্রচেষ্টা?

এক বিকেলে, আরজু তখন কিছুটা সুস্থ। আমাকে বলল-” বিন্তি, গান শুনবি?” ভীষণ অবাক হই। যেই মেয়ে কখনো উচ্চস্বরে কথা বলে না, সে গাইবে গান? আরজু আমার উত্তরের অপেক্ষা করে না। গাওয়া শুরু করে আব্দুল জব্বারের কালজয়ী গান -“প্রতিদিন কতো খবর আসে যে কাগজের পাতা ভরে, জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যায় অগোচরে….তুমি কী দেখছ কভু জীবনের পরাজয়…” গাইতে গাইতে ওর আকাশ কাঁপানো কান্নায় সেদিন বোধহয় গাছের পাতাও কেঁদেছিল! জীবন সত্যি এমন কষ্টেরও হয়, সিনেমার দৃশ্যের মতো?

হ্যাঁ, অসংখ্য খবরের ভীড়ে একদিন সত্যি ওর জীবন পাতার খবর হারিয়ে যায়। স্বেচ্ছায় মৃত্যুর কাছে নিজেকে সমর্পণ করে একুশ বছরের বেঁচে থাকার যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটায় আরজু। চিরকুটে লিখা ছিল-“আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়”।

অনেকগুলো বছর কেটে গেছে আরজু নেই। আমার দাম্ভিক কাকা নিজেকে এক ঘরে বন্দি করেছেন সেও অনেক বছর। মাঝেমধ্যে পাগলামির মাত্রা বেড়ে গেলে শেকলে বেঁধে রাখতে হয়। কখনো মাঝরাতে কাকীর বিলাপ শোনা যায়। ‘আরজু’ বলে চিৎকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন শূণ্যে তাকিয়ে।

এক সন্ধ্যায় আবার আরেকটা ফোন এলো। সেই রেললাইন, সেই বেগুনবাড়ির সুনশান রাস্তা। মধ্যবয়স্ক কাকার দ্বিখণ্ডিত দেহের পাশে পড়ে থাকা চিরকুটে লেখা-“আমার মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী”।

বীথি রহমান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *