পোট্রেট অফ এ সাইকো (৪র্থ পর্ব)

নিকি ধড়মড় করে উঠে বসলো৷ সকাল হয়ে গেছে৷ গতকাল রাতে ল্যাপটপে চোখ রেখে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে বলতে পারেনি৷ সকালের আলো এসে পড়ছে ঘরের মেঝেতে৷

ওর বাসাটার পেছন দিকে কিচেন৷ কিচেনের পরই ছোট্ট একফালি লন আর শেষমাথায় ছোট্ট একটা আউটহাউস৷ ঘরের লনের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি , বাতিল দু’একটা ফার্নিচার ওখানে রাখা৷
নিকি রোবটা শরীরে জড়িড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসল৷ জেরিনের ঘরের দরোজা খোলা৷ কিচেনের দিকে এগোলো নিকি৷ লনের দিকের দরোজাটা খোলা৷ কফি পারক্যুলেটরের মুখে ধোঁয়া উড়ছে৷ দরোজার ঠিক বামপাশে দুটো চেয়ার আর ছোট একটা টেবিল রাখা৷ ওখানে বেশকিছু ফুলের গাছ লাগিয়েছে নিকি৷ নিকি যথেষ্ট গোছানো৷ এর ছাপ কিচেন লন কিংবা অন্য রুমেও আছে৷
জেরিন কে ওখানে বসে থাকতে দেখল নিকি৷ চেপে রাখা নিঃশ্বাস আস্তে ছাড়ল সে৷ পারক্যুলেটর থেকে কফি নিয়ে দেখল ডাইনিং টেবিলে নাস্তাও রেডি৷ ওরেঞ্জজুস টোস্টেড পাউরুটি আর মাখন৷

লনে বের হবার আগেই জেরিন বলল মর্নিং নিকি!

হেসে জেরিনের সামনের চেয়ারটায় বসতে বসতে জেরিনকেও গুডমর্নিং জানাল নিকি৷

জেরিন কে প্রশ্ন করলো রাতে কেমন ঘুম হয়েছে?
জেরিন বলল নাহ! ঠিকমতোন হয়নি তবে আমি ফিট আছি৷
নিকি একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল হঠাৎ৷
তুমি তো অনেক রাত করে ঘুমিয়েছো মনে হয়!
জেরিন বলল আমার উপর গোয়েন্দাগিরি করছিলে!
নিকি বলল ঠিক তা না৷ এমনিই বললাম৷ আমি আবার ফ্লাই করলে ঘুমাতে পারি না৷
জেরিন বলল তা ঠিক৷ রাতে এই হালকা একটু ব্যায়াম করছিলাম৷
নিকি বলল তাহলে এত সকালে উঠে নাস্তা বানালে , রাতে কসরত করলে ! কাল তো কসরত না করলেও পারতে৷
জেরিন কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল আমার দুটো রিব ভেঙেছে৷ পায়ে চোট৷ হাতেও আছে৷ শরীরটাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিট করতে চাই আর সব ক্ষেত্রে অনুশীলনের বিকল্প নেই৷
তাছাড়া রাতে আমার ভাল ঘুম হয় না৷ সেই সাড়ে চার বছর আগে আলতাফ আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে! দুঃস্বপ্নের মতোই প্রায় প্রতি রাতে হাজির হয়৷
নিকি আশঙ্কার সুরে বলল তাহলে একসময় তুমিও তো সাইকিক হয়ে যেতে পার!
জেরিন কথাটা এড়িয়ে যেয়ে বলল আমি রেডি৷ তুমি রেডি হয়ে আস৷ তোমরা আমাকে যে কাজে ডেকেছো সেটা শুরু করি কি বলো!
নিকি বলল ঠিক আছে ৷গিভ মি টেন মিনিটস৷ আমি তৈরী হয়ে আসছি৷
গাড়িতে ওঠার পরই জেরিন বলল কোন ক্যাফে দেখলে থামিও৷ কফি আমার ঠিক পছন্দ না৷ একটা কড়া চা নিতে হবে…৷

দপ্তরে প্রাথমিক কাজ শেষে ওরা একটা কনফারেন্স রুমে বসল৷ রুমের সামনের দিকে একটা বোর্ড প্রোজেক্টর৷ টেবিলে বোর্ড মার্কার৷ সামনে কিছু চেয়ার রাখা৷ ওখানে দশবার জন লোক বসে৷ নিকি জেরিন কে নিয়ে প্রবেশ করলো সাথে উইলিয়াম নামের একজন৷ সাইকো কেসের দায়িত্বে যিনি আছেন তিনি হলেন উইলিয়াম৷ নিকি জেরিনকে নিয়ে এসে প্রথমে উনার কেবিনেই যায়৷
মিঃ উইলিয়াম ভনিতায় না যেয়ে সবার সাথে জেরিনের পরিচয় করিয়ে দিলেন৷ নিকি পেছনের দিকের একটা চেয়ারে অলরেডি বসে পড়েছে৷ টেবিলের উপরে বেশকটি ফাইল৷ একই রকমের৷
ফাইল গুলো দু’পাশের প্রথম রো এ বসে থাকা দু’জনকে দিলেন মিঃ উইলিয়াম ওরা একটা করে রেখে পেছনে ডিস্ট্রিবিউট করে দিল৷
জেরিন সামনের একটা চেয়ারে বসল৷
মিঃ উইলিয়াম ব্রিফিং শুরু করতে যাবেন ঠিক তখনই একজন বলল আমার একটা প্রশ্ন আছে স্যার উইলিয়াম৷ আমি কি ব্রিফিং শুরু হবার পূর্বে সেটা করতে পারি?
উইলিয়াম বললেন অবশ্যই৷ তবে আমাদের আগত অতিথি যেহেতু আপনার কারও নামই এখনও জানেন না সেহেতু ওর সাথে পরিচিত হবার এটাই বড় সুযোগ, মিঃ স্যাম৷
জেরিন স্যামের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল৷ স্যাম জেরিনের তোলা হাত অবজ্ঞা করল৷ জেরিন মূহুর্তে বুঝে নিল এখানে কাজ করাটা সহজ হবে না৷ এদের কাছ থেকে কোওপারেশান মনে হয় মিলবে না৷ দেখা যাক৷ জেরিন হাসিমুখে উইলিয়াম এর দিকে তাকাল৷
স্যাম বলল আমাদের এত সুশিক্ষিত পুলিশফোর্স এবং গোয়েন্দা বিভাগ থাকতে বাইরের কাউকে পরামর্শক হিসেবে আনা কতটুকু যৌক্তিক মিঃ উইলিয়াম স্যার!?

উইলিয়াম হাসলেন৷ প্রশ্নটা তারই শেখানো৷ স্যামকে! তিনিই বলেছেন স্যামকে এমন প্রশ্ন করতে৷ একটু আগেই তিনি তার উর্ধ্বতন মানুষটির সাথে বচসা করে এসেছেন৷ তার মতে সেই বাংলাদেশ থেকে একজন গোয়েন্দাকে আনা মানে স্রেফ তারদেশের পাউন্ড নষ্ট! বড়কর্তা বলেছেন যা করতে বলা হয়েছে উইলিয়াম সেটা করো৷ ব্রিফিং নাও তারপর একে বিদেয় করো৷ দ্যাটসইট৷
উইলিয়াম নিতান্ত অনিচ্ছা সত্বে বলেছে ঠিক আছে স্যার৷

উইলিয়াম হেসে স্যাম কে বলল স্যাম! উনি আমাদের অতিথি৷ তায় মহিলা৷ রেস্পেকটিভ! ইজিন্ট ইট?

স্যাম দাঁত কেলিয়ে বলল আ’ম স্যরি স্যার বাট কুড ইউ প্লিজ এক্সপ্লেইন৷ উইলিয়াম বুদ্ধি করে বলল এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের অতিথি নিজেই দেবেন৷
জেরিনের দিকে তাকিয়ে সে বলল প্লিজ ম্যাম এখানে আসুন আর স্যাম কে একটু বলুন কেন এখানে আপনাকে আমাদের দরকার?

এমন পরিস্থিতি জেরিন কে মোকাবেলা করতে হয়েছে৷ অনেকবার৷ দেশেও সে এমন কলিগ বা পুরুষ দেখেছে যারা জেরিনের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছিল শুধুমাত্র সে মেয়ে বলে৷ এখানেও একই অবস্থা৷ তারমানে দেশ কাল সময় পাল্টে এরা যতই আধুনিক হোক কেউ ই মেয়েদের কৃতিত্ব দিতে নারাজ৷ এখানে কিংবা ওখানে সব জায়গায় পরিস্থিতি একই৷

জেরিন সামনে এলে উইলিয়াম চেয়ারে বসলেন৷ তিনিও শুনতে চান জেরিনের উত্তর৷

জেরিন শুরু করলো

পৃথিবীতে যত সাইকো কেস আছে, সলভড কিংবা আনসলভড৷ সবক্ষেত্রে একটা কথা অনস্বীকার্য যে যারা এসব সিরিয়াল কিলিং বা হত্যাকান্ড ঘটায় তারা অসুস্থ এবং তারা বুদ্ধিতে আমাদের চেয়ে এগিয়ে৷ আমরা এদের ধরতে অনেকক্ষেত্রে সফল কিন্তু কাঠখড় পোড়াতে হয় প্রতিটি ক্ষেত্রে৷
খোদ এই লন্ডনে আপনারা কতগুলো কেস সলভ করতে পেরেছেন?
দুহাজার ছয় বা সাতে এই আপনাদের লোকালিটিতে একটা কেইস আপনারা সলভ করতে পারেননি৷ যেখানে ব্লন্ড চুলের বেশ ক’জন রমনী খুন হন৷ আপনারা সন্দেহ জনক একজন কে ধরেছিলেন৷ কিন্তু আসল ক্রিমিনালকে ধরছেন সে বিষয়ে আপনাদের সন্দেহ ছিল!
সেসময় আরেকটা ঘটনা ঘটে খোদ এই লন্ডনেই৷ একজন লোক তার দু’বাচ্চাকে নিচে ছুঁড়ে ফেলে নিজে আত্মহত্যার জন্য ঝাপিয়ে পড়ে কিন্তু হাত পা ভেঙে বেঁচে যায়! সেই কেইস ও তো আপনারা সলভ করেননি৷ লোকটাকে অসুস্থ বলে রিহ্যাবিটেশান সেন্টারে পাঠিয়ে দেন৷ পরবর্তিতে এ নিয়ে আপনারা আর মাথা ঘামাননি! ঘামিয়েছেন?
জ্যাক দ্যা রিপার কে আপনারা আজও ধরতে পেরেছেন? পারেন নি৷ খোদ এই লন্ডন শহরে আপনাদের একটা যাদুঘর আছে৷ যেখানে আনসলভ মিস্ট্রি মাডার কেস গুলোর নথিপত্র সংরক্ষিত আছে৷ এর মধ্যে একটা কেইস এমন ছিল একটা ম্যাচের কাঠির মাথায় রক্ত এবং ভিকটিমের হার্টের মধ্যে ফুটো৷ অথচ বাইরে থেকে কোন রক্তক্ষরণ বা মারার কোন চিহ্ন নেই….
সবাই নীরব৷ জেরিন আবার বলতে শুরু করলো,
স্যরি৷ এসব বলার মানে হলো এই যে, ব্যার্থতা সব দেশের সব পুলিশ বা গোয়েন্দা ডিপার্টমেন্টেরই আছে৷ আপনাদের এখানে অনেকেই হয়তো এই প্রশ্নও করেছেন , এই মহিলা তো সাইকোটাকে ধরতে পারেনি৷ ওর হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে, তাহলে ওকে এখানে আনিয়ে কি হবে?
আপনারা এখনও যত এক্সপার্টের পরামর্শ নেন আমারা সেখানে বুদ্ধি খাটিয়ে নিজেদের সমস্যার সমাধান করি৷ নানা প্রতিকূলতা থাকা সত্বেও৷ আমনাদের সবকিছু তো সেই তিনশ চারশ বছর ধরে অর্গানাইজড৷ ডিজিটালাইজড৷ তারপরও আপনারা অনেক মিস্ট্রি সলভ করতে পারেননি৷ অনেক ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নিয়েও পারেননি৷ চারপাশে এত সিকিউরিটি, সিসি ক্যামেরা, পুলিশ গোয়েন্দা, আপনাদের এখানে এসে এই আলতাফ দ্যা সাইকো একে একে তিন চারটা হত্যা কান্ড ঘটিয়ে ফেলল কিন্তু আপনারা তাকে আটকাতে পেরেছেন!? পারেননি৷
আলতাফের সামনাসামনি হয়েছি কেবল আমি৷ তাকে দেখেছি আমি৷ তার সম্পর্কে জানি আমি৷ সেকারণেই আপনাদের সিস্টেম এর ওপরতলা থেকে আমাকে ডাকা হয়েছে সাহায্যের জন্য৷ আমি হয়তো অপ্রাসঙ্গিক ভাবে অনেক কথা এখানে বলে ফেলেছি৷ দুঃখিত৷ তবে স্যামের করা প্রশ্নের জবাব আমি সরাসরি দিব না৷ একটা কাজের মাধ্যমে দেব৷
এখানে এই ঘরে আপনারা যারা আছেন তাদের মধ্যে যে কেউ যদি আমাকে ওয়ান টু ওয়ান কমবেটে হারাতে পারেন তাহলে আমি এই কেইস থেকে এখনই নিজেকে সরিয়ে আপনাদের ছকে বানানো প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেশে ফেরৎ যাব৷ আর যদি না পারেন৷ তাহলে কেইস সলভ হওয়াত্বক আমি এখানে থাকবো৷
মিঃ উইলিয়াম স্যার আপনাদের এখানে একটা ট্রেনিং প্যাড আছে৷ আমাকে নিকি বলেছে৷ চলুন ওখানে৷
….
জেরিন আর রোডি প্রাকটিস প্যাডে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে৷ রোডি তাইকোয়ান্দোতে ভাল প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ৷ উইলিয়াম আর স্যাম ওকেই নড়তে নামিয়েছে৷ নিকি শুধু জেরিন কে বলল কেন পাগলামি করছো জেরিন? ও দারুণ ফাইটার৷ এসব পাগলামি করার মানে কি?
জেরিন হেসে বলেছিল, নিকি কাল রাত থেকে তুমি আমার উপর নজরদারী করছো! আমি জানি৷ তোমাদের লোকেরা, মানে তোমরা আমি আসার পর থেকেই অসহযোগিতা করছো, আমাকে মানতে পারছো না৷ এর একটা বিহিত হওয়া প্রয়োজন৷ নয় কি?
নিকি আর কিছু বলেনি৷ জেরিনের উপর সে নজর রেখেছিল সেটা জেরিন বুঝে গেছে দেখে নিজেই লজ্জিত বোধ করছে নিকি৷
সে বলল আমি স্যরি জেরিন৷ আমাকে যা নির্দেশ দেওয়া হয় সেটা পালন করতে হয়৷ এনিওয়ে গুডলাক…
প্রথম আক্রমণটা রোডিই করলো৷ তাইকোয়ানডো ভাল জানলেও এখানে তাদের ট্রেনিং এর সময় মিক্সড মার্শালআর্টের উপরে জোর দেওয়া হয়৷ সেই মতোই পাঞ্চ করলো রোডি৷
জেরিন ঠেকালো৷ অদ্ভুত ভাবে৷ সবাই ওর ঠেকানো দেখে বিস্মিত বোধ করলো৷ রোডি বুঝেগেল সে শক্তপাল্লায় পড়েছে৷ নারী বলে একে যদি হেলা করে তাহলে আজ দু’চারটা দাঁত পড়ে যাবে!
রোডি পাঞ্চ করার সাথে সাথে অদ্ভুত ভাবে বামহাত ভাঁজ করে কনুই নামিয়ে ব্লক করলো জেরিন৷ রোডির পাঞ্চ সরাসরি কনুই এর জয়েন্ট দিয়ে আটকালো৷ এখানকার সবার ধারনা ব্লক সাধারণত হাতের বাইরের অংশ দিয়ে করা হয়৷ কিন্তু জেরিন করলো কনুই দিয়ে৷
রোডির দেহ অনেকটা জেরিনের শরীরের কাছাকাছি চলে গেছে৷ ডান হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে জেরিন সেটা রোডির সোলারপ্লেক্সে ঠেকালো৷ এরপর কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই রোডি তিনহাত দূরে গিয়ে পড়ল৷ এই মারটা কে ইংরেজিতে বলে জিরো পাঞ্চ৷ যখন আঘাতকারী আর আঘাত গ্রহণ কারির মধ্যে আক্ষরিক অর্থে কোন ডিসটেন্স থাকে না তখন এই পাঞ্চ শরীরে মুষ্ঠি ঠেকিয়ে সোলডারের জোরে করা হয়৷ জেরিন তাই করেছে৷
রোডি একলাফে উঠে দাঁড়িয়েছে৷ জেরিন দু’কদম এগিয়ে রোডি’র সামনে দাঁড়িয়ে আছে রণরঙ্গীনি মূর্তিতে৷ রোডি ডানপায়ে ভর করে কিক চালালো মাথাবরাবর৷ এখানে তার কিক এর প্রচুর সুনাম৷ কিন্তু ফসকে গেল৷
জেরিন বুঝতে পেরেছে প্রতিপক্ষ কিক হানাবে৷ পেছনের পায়ের গোড়ালিতে হালকা মোচড় দিয়ে একপাশে সরে গেল সে৷ নিজের ডান পা তুলে ফস্কে যাওয়া রোডি’র পা , ডান পায়েই প্যাঁচিয়ে ধরলো৷ অনেকটা হাতি যেমন কলাগাছ সুর দিয়ে প্যাঁচিয়ে একটানে তুলে ফেলে তেমন৷ এবার টান দিল জেরিন ডান পা’টা৷
অন্যপায়ে ভর রাখতে না পেরে রোডি ধড়াম করে আঁছড়ে পড়ল ম্যাটে৷
পড়ন্ত রোডির পিঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল জেরিন৷ ক্যামোরা লকে হাতের নিচ দিয়ে নিজের একহাত নিয়ে অন্য হাত ঘাড়ের পেছন দিয়ে বেঁকিয়ে একহাত দিয়ে অন্যহাতের কব্জি ধরে রোডি’র ঘাড়ে প্রচন্ড চাপসৃষ্টি করলো৷ রোডি বাঁকানো ঘাড়ে চোখে সর্ষেফুল দেখে যন্ত্রনায় ম্যাটে টেপ করল মানে হাত দিয়ে বাড়ি দিল৷ যার অর্থ হার স্বিকার করছি৷ ছেড়ে দাও আম্মু!
জেরিন রোডি কে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো৷
ঘড়ির দিকে তাকালো৷ দুমিনিটও হয়নি!
এবার উইলিয়ামের দিকে তাকিয়ে বলল
আপনার এক্সপার্ট আমার সাথে দু’মিনিটও টিকতে পারেনি উইলিয়াম স্যার!
উপস্থিত সবাই অবাক৷ কি হল তাদের বোধগম্য হচ্ছে না৷ জেরিন আরও অবাক করে দিয়ে বলল

আটবছর বয়স থেকে মোয়াইথাই (থাই মার্শাল আর্ট) শিখছি আমি, স্যার৷ এই আপনাদের এয়ারকন্ডিশান ক্লাসরুমে ম্যাটের উপর নয়, থাইল্যান্ডের গভীর পাহাড় আর জঙ্গলে শিখেছি৷ মোয়াইথাই এর এক্সপার্ট মঙপ্রু আমার শিক্ষক ছিলেন৷ সারা জীবন ধরে প্রাকটিস করে আসছি কিন্তু আলতাফকে আমি আটকাতে পারিনি!
ও এক্স আর্মি পার্সন৷ ট্রাকিং আর হাইডিং এ অসাধারণ পটু৷ খালিহাতে মারামারিতে ওস্তাদ৷ তারউপর সে মাথানষ্ট এক সাইকো!
আপনাদের এখানে চারখুনের খুনী যদি আলতাফ হয়ে থাকে সামনাসামনি আপনাদের যে কাউকে কুৎ করে গিলে ফেলার ক্ষমতা সে রাখে৷ একমাত্র আমিই তার সবকিছু জানি৷ এই আপনারা যে রিপোর্ট এনেছেন বাংলাদেশ থেকে তারচেয়েও বেশি৷ ওকে সামনা সামনি আমিই দেখেছি৷ তারমানে হল ওকে ট্রেস করা সম্ভব আমার পক্ষে৷ আপনারা এজন্যই আমাকে ডেকেছেন! কোপারেট করুন আর প্রার্থনা করুন অসহায় আরেকটা মেয়েকে যেন আমরা অলতাফের লোভ আর অসুস্থ মানসিকতা থেকে বাঁচাতে পারি!

রোডি উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিল৷ সসন্মানে জেরিনের সাথে কর্দমন করলো সে৷
ওর দেখাদেখি নিকি আর অন্য সবাইও৷ উইলিয়াম বলল আমি দুঃখিত ম্যাম৷ ক্ষমা করবেন৷ স্যামও এসে জেরিনের সাথে করমর্দন   করলো৷
নিকি বলল দারুণ জেরিন৷
জেরিনের পাঁজর আর পা টনটন করছে ব্যথায়৷ মুখবুজে সহ্য করলো সে৷ ম্যাটের একপাশ থেকে নিজের জ্যাকেট তুলে নিল ও৷
নিকি কে বলল চা’ এর ব্যবস্থা করো নিকি৷ কফি আমার একেবারেই পছন্দ না৷
….
দপ্তরে ব্রিফিং এ এরপর সবাই কোওপারেট করলো জেরিন কে৷ জেরিন হাফ ছেড়ে বাঁচল ওদের আন্তরিকতা দেখে৷ মনে মনে বলল যাক৷ এটলিস্ট ওরা ওকে নিজেদের একজন ভেবে নিয়েছে৷
সমস্ত ব্রিফিং শেষ হলে ঠিক হলো জেরিন ও নিকি সহ অন্য আরও দু’জন অফিসার কাল থেকে খুন হবার জায়গা গুলো আবার জেরিন কে নিয়ে দেখতে যাবে৷ এরপর মর্গে রাখা লাশগুলোর সুরতহাল রিপোর্ট সহ অন্য কাজে হাত দিবে৷
জেরিন মনে মনে চিন্তা করছে এতবড় লন্ডন শহরে আলতাফ কোথায় লুকিয়ে আছে! কিভাবে ধরবে তাকে!

সন্ধ্যেয় নিকি আর জেরিন যখন দপ্তর থেকে বের হলো তখন প্রচন্ড ঠান্ডা পড়েছে৷ পেঁজা তুলোর মতো বরফ পড়তে শুরু করেছে৷

গাড়ি ট্যানেল পার হবার সময় জেরিন বলল নিকি আমার মনে হচ্ছে কেউ আমাদের ফলো করছে!

….
লন্ডনের অন্যপ্রান্তে শুনশান রাস্তা৷ একজন মানব আর মানবী হেঁটে যাচ্ছে৷ মেয়েটার নাম হোলগা৷ রাশিয়ান ইমিগ্রেন্ট৷ সাথের লোকটাকে দেখে এশিয়ানই মনে হচ্ছে৷
হোলগা লোকটার হাতের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে দু’হাত ছড়িয়ে নিঝুম রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে গেল৷ উপর থেকে বরফ পড়ছে৷ হোলগা চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ করে আছে৷ বরফ কণা গুলো ওর মুখে পড়ে ওমে গলে যাচ্ছে৷ ওর মুখখানি ভেজা ভেজা তাই৷
সাথের লোকটা বলল কি হলো হোলগা?
হোলগা বলল বরফ আমার খুব পছন্দ থেরাগ৷ খুব পছন্দ৷ তারপর হোলগা সাথের লোকটাকে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘ একটা চুমু এঁকেদিল ঠোঁটে৷ বলল আই লাভ ইউ থেরাগ!
থেরাগ জড়িয়ে ধরে বলল মি টু! ডিয়ার! মি টু….
হোলগা দেখলো না৷ থেরাগের চোখে একধরণের দ্যুতি খেলা করছে চাপা দ্যুতি! থেরাগ সেই দ্যুতি চোখে নিয়ে অন্ধকারে তাকিয়ে থাকলো৷ তার চোখ দেখে তাকে সাইবেরিয়ান নেকড়ের মতোনই লাগছে…

(চলবে)

-পলাশ পুরকায়স্থ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *