পুতুল

আমি পুতুল। পুতুল নামেই সবাই চেনে আমায়। অনেকদিন এই নামটায় আড়াল পড়ে গেছে আমার আসল নাম। কেউ জানে না আমার নামটা যে সোহাগী।কালাপানিতে ঘর আমার। কালশি থেকে সাগুফতার মোড়, ইসিবি ক্যান্টিন পাড় হয়ে হাতের বাঁ দিকে বেশ খানিকটা হেঁটে গেলেই আমার ঘর। অনেকগুলো ঘর ওখানে। ইসহাক মাতবরের জায়গায় গড়ে উঠেছে এই বস্তী। ঘরের সাথে ঘর লাগোয়া, বাথরুমে সকাল থেকেই বিশাল লাইন। রান্নার জায়গাটাও বারোয়ারী। ঘরের চালের ফুটো দিয়ে আকাশ, চাঁদ সবই দেখা যায়। বৃষ্টি বাদলের দিনে নীল রঙয়ের প্লাস্টিক দিয়ে মুড়ে দেই চাল। আর দরজাটা বাতাস ছাড়াই হেলতে দুলতে থাকে। বাতাস এলে তো কথাই নাই। গ্রাম থেকে যেদিন প্রথম মিরপুরে এলাম, সেদিন আয়নালের হাত ধরে অবাক চোখে শহর দেখছিলাম। আয়নাল তাগড়া মানুষ। মনে হতে তার ছায়ায় কোনো ঝড় ঝঞ্ঝা আমাকে ছোঁবে না।
আয়নাল আমার বিয়ে করা স্বামী। আমি বিয়ে বসছিলাম আয়নালের কাছে। গ্রামে কাজ নেই, কাজ আছে তো টাকা নেই। আয়নাল শহরে নিয়ে এলো আমাকে। প্রথম প্রথম মন কাঁদতো। আয়নালের বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতাম। বাড়ীর জন্য আমার পেট পুড়তো। গার্মেন্টসে কাজে ঢুকলাম দুজন। আয়নাল আছে, আমার আর ভয় করে না। লাঞ্চের সময় একসাথে খেয়ে আবার কাজে যাই। গার্মেন্টস মোড়েই তো কাজ করি। বেশী দূরেও নয়। ছুটির দিনে আয়নাল আমাকে রিক্সায় মুসলিম বাজারে নিয়ে যায়। আমরা টুকটাক কেনাকাটা করি।কখনো ফুচকা একটা ভাগ করে খাই। আয়নাল ওভারটাইম করা শুরু করে। রাতে প্রায়ই আসে না ঘরে। টাকা অবশ্য বেশী কামাই করে। কিন্তু আমার খুব একা একা লাগে। আজকাল আয়নাল কেমন জানি রেগে থাকে। কথা বললেই ফোঁস করে। আমার সব কিছুতেই ভুল ধরে।

সেদিন পহেলা বৈশাখ ছিল। আমি লাল সাদা শাড়ী পরে ডিউটি শেষে আয়নালের জন্য অপেক্ষা করি। গরুর মাংস আর গরম ভাত আয়নালের খুব প্রিয়। আয়নাল আসে না। মোবাইলও বন্ধ। রাতে আয়নাল লাল শাড়ী পরা আদুরীকে নিয়ে ঘরে আসে। আদুরী আমার সাথেই কাজ করে। বেশীদিন হয়নি এসেছে ঢাকায়। কখন কি হলো আমি বুঝতে পারি না। আয়নাল বিয়ে করে নিয়ে সোজা ঘরে আসে। গরম ভাত আর গরম নেই। আয়নাল আর আদুরী খেতে বসেছে। একটাই ঘর। নতুন বউ নিয়ে আয়নালের বাসর আজ। আমি তবে কোথায় যাবো!

আমার কোনো রাগ দুঃখ হয় না। গরীবের মন কোথায় থাকে, কে জানে? আমি কাপড় নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসি। ঢাকা শহরে রাত হয় না। রাস্তার কাজ পুরোদমে চলছে। দুপাশে বিহারীদের ঘর বাড়ী। সড়ক বাতির আলোতে আমি হেঁটে চলি। আসবার সময় অবশ্য আয়নাল আমাকে বাঁধা দেয়নি। মৃদু বলেছিল… কই যাস তুই? আমি উত্তর করিনি। সব কথার, সব প্রশ্নের উত্তর হয় না। আর মানুষ কি সব প্রশ্নের উত্তর জানে?

এখন আমি পুতুল রাণী! সেই যে সেই রাতে খুবলে খেয়েছিল যারা আমার নারীত্ব, তাদের জন্যই তো আজ আমি পুতুলনাচে সমাজ নাচাই। আমার কাছে কত লোক আসে, কত ভদ্রলোক, কত কত মানুষ…. সবাইকে আমি সাধ্যমত নাচাই, খেদমত করি। সকাল হলেই তারা আবার সমাজের সাথে মিশে যায়। রাতের আঁধারে তাদের আমি চিনি, দিনের আলোতে বড় অচেনা।

আয়নাল, হ্যাঁ আয়নালও একদিন এসেছিল। নেশার ঘোরে আমার ঘরে আয়নাল এসেছিল। পুতুল রাণীর কাছে এসেছিল আয়নাল। আমি আয়নালকে নাচাইনি, কোনো খেদমতও করিনি! ভালবাসাকে নাচানো যায় না! ভালবাসার মানুষকে পুতুল রাণী খেদমত করতে পারে না। আমি তো আয়নালকে ভালই বাসতাম।

-ফারহানা নীলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *