পাতকী অর্থ

আজ অনেকদিন পর বিকেল বেলা বাসায় চলে এলাম অফিস থেকে। শেষ কবে পাঁচটার মধ্যে বাসায় ফিরেছি মনে করতে কষ্টই হয়। ভেবেছিলাম বাসার সবাই মিলে একসাথে বিকেলের নাস্তা খাবো বারান্দায় বসে। বাসায় ফিরে দেখি কেউ বাসায় নেই। কাজের মেয়ে জানালো রোকেয়া, মানে আমার স্ত্রী বাইরে গিয়েছে দুপুরে খাওয়ার পর, কখন ফিরবে কিছু বলে যায়নি। বাসার মানুষদের সারপ্রাইজ দিতে এসে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম।

একটু ফ্রেশ হয়ে ফোন দিলাম রোকেয়া কে। অনেকক্ষন বাজার পর ফোন উঠালো অন্য কেউ।

– হ্যালো, রোকেয়া?

– না, ম্যাডামতো ফেশিয়ালে আছেন। এখন কথা বলতে পারবেন না। ওনার কাজ শেষ হলে আপনাকে ফোন দিবে বলেছে।

ফোন ছেড়ে দিয়ে ছেলেকে ফোন দিলাম। সেই ফোন ও তুললো ছেলের বন্ধু।

– স্লামালিকুম আংকেল? দীপ্ত তো মাত্রই বীচ থেকে ফিরে শাওয়ারে গেছে, বের হয়ে ফোন দিবে বলেছে।

ও আচ্ছা বলে ফোন রেখে দিলাম। আমার একমাত্র ছেলে বন্ধুদের সাথে কক্সবাজার গিয়েছে আমি কিছুই জানিনা?

……………….

ঢাকা শহরে শীত আসি আসি করছে। এসময় বিকেলগুলো কেমন একটু ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে থাকে চারদিক। অনেকটা স্বপ্নদৃশ্যের মতো। বারান্দায় একাকী গিয়ে বসলাম। কাজের মেয়েটা এক কাপ চা রেখে গিয়েছে। আর কিছু দিতে আমিই নিষেধ করেছি। বয়স হয়েছে, এখন ভাজাপোড়া খেলেই কেমন যেন এসিডিটি হয়। তারপরও ওরা বাসায় থাকলে হয়তো কিছু খেতাম একসাথে।

দখিনা খোলা বারান্দায় শীতের শেষ বিকেলের আলোয় একলা বিকেলটুকু কেমন বিষন্নতায় মনটা ভরে দিল। অথচ একটা সময় এই বিকেলগুলো কতই না মধুর ছিল। রোকেয়ার সাথে আমার বিয়ের পরপর মা বাবা জোর করেই তাকে পাঠিয়ে দেয় গ্রাম থেকে শহরে, আমার সাথে থাকার জন্য। আমার তখন নতুন চাকুরী। খুবই জুনিয়র পোস্ট। মাসশেষে সামান্যই বেতন পাই। দু’কামরার এক ছোট্ট সংসার। রোজ অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে কোন না কোন পথের পাশের ভাজাপোড়া খাবার নয়তো কোনদিন রোকেয়ার জন্য এক ডজন কাঁচের চুড়ি, কোনদিন একটা প্রসাধনী নিয়ে বাসায় ফিরতাম। আমার ফেরার পথের দিকে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকতো রোকেয়া। একটু দেরী হলেই সদর দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো। তারপর কোনদিন মুড়িমাখা, কোনদিন পিঠা বা এরকম কিছু সাথে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম চা। আহা! কি মায়া আর ভালোবাসায় ভরা একেকটা বিকেল! যেন কোন স্বপ্নদৃশ্যের মতোই।

কয়েক বছরের মাথায় আমাদের ঘর আলো করে এলো দীপ্ত। ততদিনে আমার দুটো প্রমোশন হয়েছে। একটু বড় ঘর নিয়েছি। বিকেলে অফিস থেকে ফিরে ছেলের সাথে কথা বলে, খেলা করে কেটে যেত অনেকটা সময়। রোকেয়া তখন ছেলেকে নিয়ে আগের চেয়ে ব্যস্ত থাকলেও আমার দিকে লক্ষ্যটুকু ঠিকই রাখতো। ছেলের ভবিষ্যত, নিজেদের আরেকটু ভালো থাকার নিমিত্তে শুরু করলাম চাকুরীর পাশাপাশি ব্যবসা। ব্যবসা দাঁড় করাতে কেটে গেছে অনেকটা সময়। কোন কোন রাতে হয়তো বাসায় ও ফিরতে পারতামনা ব্যবসার কাজে। রোকেয়া সাহস দিত, ‘আমিতো আছি; তুমি চেষ্টা করো।’

তারপর কয়েক বছর ঘুরতেই ব্যবসাটা বেশ দাঁড়িয়ে গেলো। লাভের মুখ দেখতে লাগলাম। ফ্ল্যাট কিনলাম। ছেলের পড়ালেখা, স্কুল এসবের সুবিধা হবে ভেবে গাড়ি কিনলাম। কিন্তু এই সময়ের ব্যবধানে কেমন করে যেন একটা দূরত্ব তৈরী হয়ে গেল আমার প্রিয় মানুষ দুটোর সাথে। হবে নাই বা কেন? কোন পারিবারিক অনুষ্ঠান, কোথাও বেড়াতে যাওয়া সবখানে আমার অনুপস্থিতি। এমন কি একবার ছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমি এসেছিলাম সব অতিথি চলে যাবার পর।

মানুষ বোধহয় সব কিছুতেই মানিয়ে নিতে শিখে যায়। আমার স্ত্রী আর ছেলেও আমাকে ছাড়াই মানিয়ে নিতে শিখে গেল। যে যার নিজের জগৎ গড়ে নিল, যেখানে আমার কোন ঠাঁই হলোনা। না ভুল বললাম আমার হয়ে ঠাঁই নিয়েছে আমার ক্রেডিট কার্ড আর ব্যাংক ব্যালেন্স।

হঠাৎ ফোনের শব্দে চমকে বাস্তবে ফিরে আসি। রোকেয়ার ফোন।

– হ্যালো, শফিক, ফোন দিয়েছিলে কেন?

– না আজ একটু আগে বাসায় চলে এসেছিলাম, ভাবলাম একসাথে বিকেলের নাস্তা খাই।

– আশ্চর্য্য তুমি আমাকে বলবে না তুমি আজ বাসায় তাড়াতাড়ি আসতে পারো। আমার আজ কিটি পার্টি আছে, ফিরতে রাত হবে। তুমি কিছু খেয়ে শুয়ে যেও। মেয়েটা কে বললে তোমার খাবার দিয়ে দিবে।

– দীপ্ত কক্সবাজার গিয়েছে, বলোনি তো?

– তোমার আজ কি হয়েছে, শফিক? গতমাসেই না তুমি ওকে টাকা দিলে যাওয়ার জন্য। ও তোমাকে তারিখ বলেনি সেটা আমি কিভাবে জানবো? আর তুমি এতো রাতে ফেরো সে কারণেই হয়তো বলা হয়নি। আচ্ছা শোনো ফোন রাখছি। রাতে জেগে থাকলে কথা হবে।

…………..

বিকেলের রোদটা পড়ে গিয়ে হুট করেই সন্ধ্যে নেমে এলো অনেকটা জীবনের শেষবেলার মতো।
সন্ধ্যে নেমে যাওয়ার সেই ঘোর লাগা মূহুর্তে মনে হলো আজ আমার যদি খারাপ কিছু হয়ে যায় আমার প্রিয়জনেরা কেউ বুঝি জানবেনা। সবাই যে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। আমরা তিনজন মানুষ এক ছাদের নীচে থেকেও যেন এখন তিন ভিন্ন গ্রহের মানুষ।

যে সুখ আর সাচ্ছন্দ্য কেনার জন্য আমি অর্থের পেছনে ছুটলাম সেই অর্থ এলো,স্বাচ্ছন্দ্য এলো কিন্তু শুধু সেই ভালোবাসা ভরা সুখটুকুই বুঝি হারিয়ে গেল জীবন থেকে। আহা আমার স্বর্নালী বিকেলগুলো, অর্থ নামক মরীচিকার পেছনে কি অনাড়ম্বরভাবেই না এক জীবনের তরে হারিয়ে গেলো।

 -ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *