নিষাথৈ

১.
টিউশনির বেতনে এই প্রথম নিজের জন্য কিছু কিনেছে অথৈ। শাড়ি। ভ্যাপসা গরমের ম্যাড়মেড়ে ঘামে মাড় লেপ্টে যাচ্ছে হাতে, ঘাড়ে, কোমরে। ফুটপাতের ধারে, কাঠবাদাম গাছটির নিচে, দাঁড়িয়ে আছে সে। নিষের জন্য।

কাঠবাদাম গাছে, হাঁপাতে-হাঁপাতে উড়ে এসে বসলো বিহ্বল কাকটি। এতোক্ষণ কী দেখলো সে!

২.
বাসের দরোজার ভিড় ঠেলে নেমে এলো নিষ। পিছনে কন্ডাক্টরের গালাগালি। ভাড়া দিতে পারেনি সে। বাসের ভিতরেই মানিব্যাগ হাওয়া! লজ্জায় লাল হয়ে এসে দাঁড়ালো অথৈয়ের সামনে। দেরি করে ফেলার লজ্জা, সাথে কন্ডাক্টরের গালাগালি প্রেয়সীর কানে পৌঁছে যাওয়ার লজ্জা!

নিষকে দেখেই একটি হার্টবিট মিস করলো কাঠবাদাম গাছে তখনো হাঁপাতে থাকা কাকটি। এ-ই তো সে!

৩.
পরপর দু’টি হার্টবিট মিস হলো অথৈয়ের। মনে হলো, বুক ধরে আসছে তার! হাঁটু অবশ হয়ে আসছে। বারবার চোখ চলে যাচ্ছে নিষের নিষ্পাপ মুখটির দিকে, অথচ তাকাতেই পারছেনা! ওদের একান্তে প্রথম সাক্ষাৎ আজ। দু’জনেরই লজ্জা করছে। দু’জনেই ভুল করছে। দু’জনেই বুঝতে পারছেনা।

কাকটি দ্বিতীয় বার নিষের দিকে তাকিয়ে, অত:পর তাকালো অথৈয়ের দিকে। মেয়েটির সর্বনাশ হতে যাচ্ছে!

৪.
চোখ ভিজে এলো নিষের। এমন নিষ্পাপ কন্যা তাকে কেনো ভালোবাসে? দু’বেলা ভাত জোটেনা। দিনশেষে পকেটে পড়ে থাকে আধুলির ভার। মেসের ভাড়া দিলে হেঁটে যেতে হয় টিউশনিতে। এমাসে ভাড়া না-দিলে একজোড়া স্যাণ্ডেল কেনা হতো। নিজের স্যান্ডেলের দিকে একবার তাকিয়ে অথৈয়ের স্যাণ্ডেলের দিকে দৃষ্টি ফেরালো। উভয়ের স্যান্ডেলই বহু সেলাইয়ে মলিন।

কাকটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিষের দিকে। ফিরে যাও যুবক!

৫.
ছোট্ট ব্যাগটিতে রাখা মোট টাকা হিসেব করছে অথৈ। এমাসের টিউশনির অর্ধেক শেষ সদাইয়ে। শাড়িটায় শেষ বিশাল অংশ। এমাসের হোস্টেল ভাড়া বান্ধবীর কাছ থেকে ধার করেছে। অল্প খেয়ে আজকের মুহূর্তগুলোর জন্য সযত্নে জমা রাখা টাকাগুলো সমেত ব্যাগটি বুকের সাথে আরেকটু চেপে ধরলো সে। এ সম্পত্তি ওদের দু’জনার। নিষের মানিব্যাগ খোয়া গেছে। তো কী হয়েছে! ওরা তো উভয়েরই।

ডাল পরিবর্তন করলো কাক। ভুল কোরোনা কন্যা!

৬.
একটু দাঁড়াতে বলে, দ্রুত রাস্তার ওধারের দোকানগুলোর দিকে চলে গেলো নিষ। ঢুকে গেলো মানুষের ভিড়ে। বুকটা কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগলো অথৈয়ের। ‘মানুষ কেনো একা ফেলে রেখে যায় মানুষকে!’ চোখ জলে ভরে ওঠে কন্যার। হন্তদন্ত ফিরে আসে নিষ। মুখে লাজুক হাসি। বুকে হাঁপরের মতো উথালপাথাল শ্বাস। দেহ ঘামে নাওয়া। চোখে অটুট আশ্বাস। ‘ছেড়ে যাবোনা তো!’

তীক্ষ্ণ এক চিৎকার দিতে গিয়েও থেমে যায় কাক। ভুল করছো কন্যা, চরমতম ভুল!

৭.
রিকশায় উঠে পড়ে উভয়ে। কাঁধের একটুখানি ছোঁয়ায় কেঁপে ওঠে অথৈ। চুলের আলতো পরশে নিঃশ্বাস দ্রুততর হয় নিষের। দু’টি দরিদ্র অথচ অমল হৃদয় স্বপ্ন বুনছে একটি ছোট্ট কুটিরের, একটি ঝকঝকে উঠোনের, টলোমলো পায়ের খিলখিল সন্তানের, হলুদ ডালে মাখা একপাত শাদা ভাতের, পৃথিবীর সমস্ত কলরোলের আড়ালে কুলুকুলু বয়ে চলা শান্ত একটি নদীর।

শেষ চেষ্টাটি করে কাক। হাওয়া চিরে তীক্ষ্ণ এক চিৎকার দেয় সে- ‘জীবন বড়ো বিষাদের হে অবোধ কন্যা! কেনো অমন তীব্র মায়ায় দুঃখকে বুকে টেনে নিলে! ফিরে যাও! ফিরে যাও! ফিরে যাও! এ-যুবক আগুন! এ-পৃথিবী আগুনকে সহ্য করেনা।’

৮.
তখনই কোপটা মারলো ওরা, নিষের ঘাড়ে। রিকশার পাশের মোটরসাইকেল থেকে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই অথৈয়ের পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো নিষ, অদৃশ্য হয়ে গেলো মোটরসাইকেল, অবাক চেয়ে রইলো অথৈ প্রিয়তম পুরুষটির গলগল রক্তে ভাসা উপুড় দেহটির দিকে। নিষের বুকপকেট থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পড়ে রইলো প্রিয়তমার সাথে অল্প কয়েকটি ক্ষণ কাটানোর বাসনায় অল্প আগে রাস্তার ওধারের দোকানে সস্তা মোবাইলফোনটি বিক্রির বিনিময়ে পাওয়া অল্প কয়টি টাকা।

একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো কাকটির চোখ বেয়ে। বলেছিলাম; বড়ো দরকারি আগুনটুকু ঠিকই নিভিয়ে দেয় এ-সোঁদা সময়!

৯.
আধঘণ্টা পূর্বের স্মৃতি ভাসতে থাকে কাঠবাদাম গাছে বসে অশ্রুতে ভাসা কাকটির ছোট্ট মস্তিষ্কে-

অন্ধগলির ডাস্টবিনটির মাঝে বসে ছিলো সে। তখনই গোঙানি! কিশোরীর মুখ চেপে গলির ভিতরে ঢুকিয়ে ফেললো ওরা তিনজন। হাতপা চেপে খুলে ফেললো সব। তখনই, গলির ওমাথা থেকে এগিয়ে এলো অতি সাধারণ এক যুবক। তাকিয়ে রইলো সে কিছুক্ষণ ওদের দিকে। ওরা পাত্তাই দিলোনা। ওরা জানে, কাকও জানে, কী হবে? না-দেখার ভান করে নিজের পথ ধরবে যুবক। কিন্তু, না! ভুল হলো, ওদের, কাকেরও। অস্থির নষ্ট সময়ের আবর্তে, ওরা ভুলে গিয়েছিলো, এ-পৃথিবী স্পার্টাকাসেরও, পুরুরও, চেরও, আলেকজান্ডারেরও। এই মিইয়ে থাকা স্যাঁতসেঁতে পৃথিবী মূলত এই সকল আগুনেরই। যদিও এঁরা অল্প আয়ু নিয়ে জন্মান। এবং, নপুংসক পৃথিবীকে লজ্জায় ভাসিয়ে দিয়ে যান, কতক শতাব্দী অন্তর।

যুবক, হাতের কাছে পেলো, ভাঙা ভ্যানগাড়ির উঠে যাওয়া একটি তক্তা। তিনজন পশুকে যখন পিটিয়ে প্যান্ট খুলে রেখে গলি ছাড়া করলো যুবক, জীবনের অপরূপতম ঘটনাটি দেখে ডাস্টবিনের ভেতর থেকে বিস্ময় ও উল্লাসে হাঁপাতে-হাঁপাতে নিজের কাঠবাদাম গাছটির দিকে উড়ে চলা একটি বিহ্বল পাখির কণ্ঠ চিরে একটি শব্দ উচ্চারিত হতে থাকলো- ‘আগুন-মানব!’

১০.
হ্যাঁ। নিষ মারা গেলো। অথৈ, পেয়েও হারিয়ে ফেললো একজন মানবোত্তম পুরুষের সংসার। জীবন এ-ই।

হ্যাঁ। কাকটি ঠিকই বলেছিলো- ‘বড়ো দরকারি আগুনটুকু ঠিকই নিভিয়ে দেয় এ-সোঁদা সময়!’

-সালাহ্ উদ্দিন আহমেদ জুয়েল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *