নির্বাচিত পাঁচ অণুগল্প

১. বুড়ির বোচকা
আমরা কেউ তাকে চিনতে পারলাম না। না আমি, না আমার ভাই, না আমাদের গ্রামের অন্যকেউ। সবাই শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলো আর বলতে লাগলো- বুড়িটার বাড়ি কই? থাকে কোন দেশে?
বুড়ির সেই দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই। সে আপন মনে রাস্তা বেয়ে চলতে লাগলো। মাথার ওপর তার নিজের ওজনের চেযেও বড় একটা পুটুলি। সবাই প্রথম দেখায় তাকে পাগলীনি বলে ধরে নিলো। বুড়ি শাস্ত স্থীর চোখে তাকায় সকলের দিকে। সমস্যা একটাই। সে কোনো কথার জবাব দেয় না। নানান জন জিজ্ঞেস করল- বুড়ি তোমার বাড়ি কই? এত বড় বোচকা মাথায় যাইবা কই? বোচকার মধ্যে কী?
বুড়ি পাথরের মত চুপ। ফ্যালফ্যালে চোখের চাউনি। গাঁয়ের লোক চারদিকে গোল করে দেখছে তাকে। যেন এমন মানুষ জগতে আর দেখে নাই তারা। উল্লার বউ এক খিলি পান হাতে এগিয়ে এল তার কাছে। বুড়ি পানের দিকে তাকাইলো চোখ ঘুরিয়ে। হাতে নিলো না। আসকানের বউ এক বাটি মুড়ি খেজুরের পাটালী গুড় সমেত হাজির করল। বুড়ি সেইদিকেও তাকালো। হাতে নিলো না। সকলের পীড়াপীড়িতে অবশেষে বুড়ি মুখ না খুলে বরং তার মাথার পুটুলিটা নামিয়ে সেটা খুলতে লাগলো।
গাঁয়ের লোকের সবার তৃষ্ণার্ত চোখগুলো বুড়িকে ঘিরে আছে তখন। বোচকার মধ্যে কি? বোচকার মধ্যে কি?
বুড়ি আস্তে আস্তে একটা করে পুটুলির কাপড়ের গিট খোলে সকলের চোখ আরো তৃষ্ণার্ত হয়। কি আছে এই রহস্য বোচকার মধ্যে? নিজের ওজনের চাইতেও বেশি বড় এ বোচকা বুড়ি কেন বহন করে চলেছে মাইলের পর মাইল? বছরের পর বছর!
পোটলার প্রথম পার্ট খোলা হইলে ভেতরে একটা মোড়ানো কাঁথা বের হলো। কাঁথার ভাঁজ খুলতেই আমাদের গাঁয়ের লোকের চোখেমুখে একটা হতাশা ফুটে উঠল- ও! তেমন হাতি ঘোড়া তো কিছু না! বই!
বুড়ির চেহারায় এইবার হাসির রেশ দেখা গেল। সে একটা করে বই বের করে আর একজনের দিকে এগিয়ে দেয়। গাঁয়ের লোক ধরি কি ধরি না করতে করতে হাতে হাতে নিতে লাগলো। সবার হাতে বই পৌছানো শেষ হইলে এবার বুড়ি মুড়ির বাটি সামনে টেনে নিল। সকলে তখন বইয়ের পাতা উল্টাইতে ব্যস্ত। এমন আহামরি কোনো বই না। বাচ্চাকাচ্চার পদ্যর বই। প্রথম পদ্যটা জোড়ে জোড়ে পড়ল আক্কাসের বাপ- সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি!

২. ভালো-মন্দের হিসাব নিকাশ
লোকটা হাতে এক টুকরা সাদা কাপড় নিয়ে ঘুরতেছে। লোকজন বলবালি করতেছে- এর হাতে এইটা সব সময়ই দেখা যায়। এইটা শুধু সাদা কাপড় না। এইটা কাফনের কাপড়।
আদৌ এইটা কাফনের কাপড় কি না সেই ব্যাপারে কোনো ব্যাখা লোকটা কোনোদিন কাউরে দেয় নাই। এই জ্ঞান পাবলিকের কল্পনাপ্রসূত। যেহেতু কাপড় খানা সাদা, এইটা দিয়া সে চোখমুখও মোছে না, কোনে কাজেও লাগায় না, অকাজে সাদা কাপড় বহনের মানে কি? সুতরাং এইটা কাফনের।
আমি অবশ্য লোকটারে সাদা কাপড়ের টুকরাটা অন্যকাজে ব্যবহার করতে দেখলাম। সে রাস্তায় এরে তারে থামায়া কাপড়টা দেখায়া জিজ্ঞেস করতেছে- এইখানে কি রং আছে কও দেখি?
লোকেরা বলতেছে- এইটাতো এক্কেরে সাদা। রং কই? এইখানে কোনো রং নাই।
লোকটা ফ্যা ফ্যা করে হাসতে হাসতে বলতেছে- আছে আছে। রং বিনে সাদা হয় না। কোনো রং নাই মানে কালো। সব রং একটু একটু আছে মানে সাদা। অথচ এইটা চোখে পড়ে না কারো! সব শালা হিপোক্রেট!
পাবলিক চিন্তিত মুখে বিষয়টা ভাবার চেষ্টা করতেছে। এর মধ্যেই একজনের গলা পাওয়া গেল- ব্যাডায় ঠিকই কইছে। আমরা সাদা চোখে কিছুই নাই নাই করি। তলে তলে বহুত কিছু আছে। কালো মানেই বুড়া না। সেইখানেই বরং কিছুই নাই, হইতে পারে।

৩. লালু পাগলা নাই যে দেশে
আমাদের পাড়ায় লালু পাগলা নামে একটা লোক ছিল। লোকটা কাজ কর্ম কিছুই করত না। কাওরে কোনো দিন মার ধর করছে বলেও কেউ কোনোদিন শোনে নাই। তার কাজ ছিল কেবল হাঁটা আর বসে থাকা। সকালে গ্রামের এই মাথায় তো বিকালে ওই মাথায়। রাতে দেখা মিলত ত্রি-মোহনীর বটগাছের তলায়। সবাই যখন তাকে দেখত, হয় সে বসে আছে, নয়তো হাঁটছে। গ্রামের বাইরেও যাইত না কখনো। এই ছিল তার পাগলামী।
তো একবার ঘটনা ঘটল কি, একদিন রাতে গ্রামে একটা চোর ধরা পড়ল। সিঁধেল চোর। ময়জুদ্দি প্রমানিকের বড় দেয়াল ঘরে সিঁধ কেটেছে। আনুমানিক রাত তিনটার দিকে। তবে ঘরে ঢুকতে পারে নাই। সিঁধ কেটে যেই ঢুকতে গেছে, অর্ধেক শরীর কেবল গর্তের ভেতর ঢুকিয়েছে, অমনি লালু পাগলা এসে জাপটে ধরেছে পেছন থেকে।
লোকজন বলে পাগল ছাগলের গায়ে থাকে অসুর শক্তি। লালু পাগলার গায়েও ছিল বোধহয়। তাছাড়া এমন গাট্টাগোট্টা একটা চোরকে অমন হালকা পলকা লালু পাগলার ধরে রাখার কোনো কায়দাই ছিল না। হৈচৈ চেঁচামেচিতে সারা পাড়ার সকলের ঘুম ছুটে গেল। একাব্বর আলী খানিক আগে ঘুম ভেঙে উঠে কেবল তার বউয়ের উরুতে হাত বুলাতে আরাম্ভ করেছিল। এর মধ্যেই হৈচৈ পড়ে গেল। সে নতুন বউকে একলা ঘরে রেখে দৌড়ায়া বের হয়ে এলো।
সবাই বের হয়ে দেখল লালু পাগলা চোরটাকে চিপে ধরে আছে। অনেকেই এসে টানাটানি করছে। লালু পাগলা ছাড়ে না। তার এক কথা, আমি ধরছি একলা। কারো হাতে তুইলা দিতে রাজি নাই।
সেই থেকে আমার পাড়ার লোক বুঝল, পাড়ায় একটা লালু পাগলা থাকার দরকার আছে। আজকাল দেশে যেইটার বড় অভাব।

৪. বাংলার কবি ও কাকের বাচ্চা
আমার বন্ধু আয়নালের একবার সখ হইল সে কাক পুষবে। শুধু সখ করেই সে ক্ষ্যান্ত হলো না। একদিন সকাল বেলা হাতে করে একটা কাকের বাচ্চা নিয়ে ঠিকই হাজির হলো। আমি তখন দাওয়ায় বসে কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ যোগে পান্তা খাইতেছিলাম। সে খুশিতে গদগদ গলায় বলল- দোস্ত পাইছি।
কি পাইছে সেটা আর জিজ্ঞেস করার দরকার পড়ল না। কারণ তার হাতে থাকা কাকের বাচ্চাটা তখন আমার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম- পাইছিস ভালো কথা। এখন পুষতে থাক। তো এইখানে কি?
সে দন্ত প্রসারিত করে বলল- না এমনি, তোরে দেখাইতে আনলাম।
তার কথা শুনে মনে হলো, কাকের বাচ্চা দেখা বিনে আমার বুঝি পান্তা কাঁচামরিচ গলা দিয়ে নামতেছে না। আমি একবার তার দিকে আর একবার কাকের বাচ্চার দিকে তাকিয়ে গাট্টা পেঁয়াজে কচ করে একটা কামড় দিলাম।
আয়নাল এবার মুখটা কেরোসিনের তেলের শিশির মত ছোট করে বলল- দোস্ত, তোরে একখান দায়িত্ব পালন করতে হবে। অনেক ভাইবা দেখলাম এই কাজ তুই ছাড়া আর কাউরে দিয়া হইব না। তোর বাংলায় জানাশোনা ভালো। আমার কাকের বাচ্চাডারে তুই বাংলা শিখাবি।
আয়নালের কথা শুনে বারান্দার খড়ের চালা ভেঙে আমার মাথায় পড়ল যেন। কয়েকটা খড় যেন এসে পড়ল পান্তার পাতে। আমিও তখন একটা গ্রাস দিতেছিলাম মাত্র। কিছু খড় পান্তার সাথে মুখের ভেতর সেঁধিয়ে গেল। পান্তা আর গেলা গেল না। গলায় আটকায়া গেল। প্রকান্ড বিষম খেলাম একটা। কোনো রকমে শ্বাস নিয়ে বললাম- দোস্ত, আমার কোন পাপের শাস্তি দিতেছিস এইটা?
সে হেসে বলল- জগতে অধিকাংশ শাস্তি পায় নিরাপরাধ লোকজন। পাপীরা শাস্তি পায় না।
তারপর আয়নাল আরো কি যেন বিড়বিড় করতে করতে কাকের বাচ্চাটি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমার এখন দুইটা কাজ। এক, দুইটা একটা পইদ্য লেখা। দুই, কাকের বাচ্চাটারে কথা শেখানো।

৫. আমি ও আমার ফরাসি গার্লফ্রেন্ড
আমার গার্লফ্রেন্ডের নাম মার্গারিট। এটা অবশ্য তার আসল নাম না। আমি দিয়েছি। ওর আসল নাম ইসাবেলা তারান্তানা সোফিয়া। ফরাসি এই নারীর সাথে আমার যেদিন অনলাইনে প্রথম পরিচয় হয় সেদিনই আমি তাকে বলেছি- এইসব নাম কিন্তু তোমার চলবে না। তোমার নাম হবে মার্গারিট।
মার্গারিটের প্রেমে পড়েছি আমি সুনীলের সেই ছবির দেশে কবিতার দেশে পড়ে। তখনই ভেবে রেখেছিলাম, কখনো যদি ফরাসি কোনো নারীর সাথে প্রণয় হয়, তাকেও আমি মার্গারিট বলে ডাকব। অবশেষে সেই সুযোগ এল। সোফিয়া আমার কথা শুনে হাসির ইমো পাঠিয়ে জানালো যে, আমি যদি চাই মার্গারিট হতে তার আপত্তি নাই। সেই থেকেই শুরু।
মার্গারিটের সাথে আমার কথাবার্তা চলে ইংরেজিতে। আমি ফ্রেঞ্চ জানি না। মার্গারিট বাংলা জানে না। আপাতত ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানীর ভাষাই আমাদের মধ্যে যোগাযোগ ঘটার একমাত্র মাধ্যম। তবে মার্গারিট যখন রেগে যায় সে রীতিমত হাবড়জাবর করে ফ্রেঞ্চ ঝাড়তে থাকে। আমি তার মাথা-মুন্ডু কিচ্ছু বুঝি না। আমিও সেই সুযোগে বাংলা ঝাড়তে থাকি। সে-ও তার ধর-পশ্চাত কিচ্ছু ঠাহর পায় না।
একদিন হলো কি, মার্গারিটের সাথে আমার সেইরকম লেগে গেল। যাকে বলে একেবারে আদায় কাঁচকলায়। মার্গারিট রীতিমত ফ্রেঞ্চের ঝড় বইয়ে দিচ্ছে। আর আমি দিচ্ছি বাংলায়। দুইজনের সেইরকম চলছে। কেমন চলছে তার নমুনা দিলেই বুঝবেন-
মার্গারিট বলছে- তু এচ আন মেনতিউর। পুওরকুঁয়ি তু ফাইচ কা পুওর মঁই? লা ফ্রান্স ইস্ট আন বিউ পেইস। সেইস তু ছেলা?
এইসব শুনে মেজাজ ঠান্ডা থাকে? আমিও রেগেমেগে একেবারে বাংলা তো বাংলা ডাইরেক্ট আমার লোকাল নাটোরী ঝেড়ে দিলাম- ঘোড়ার আন্ডা! তোমারে ফোরাসিরেক আগে তো ভালো মানুষ বুইলিই জানিচি, একন দেখি খাচ্চরের খাচ্চর। আগা গোড়াই দুই নম্বরী। তোমারে ওইরকম শিল্পসাহিত্য আমরা খ্যাতা কাপড় বানায় বিছনিত পাইরি শুই। সোঁটা দিয়া কাঁইচি কত শুকাই রইদে। যত্তসব এন্তুপেন্তুজেন্তু ভাষা কতে লাগিচে!
আমার বাংলার ঝড়ে অবশেষে মার্গারিটের ফ্রেঞ্চের পতন ঘটে। সে ফ্রেঞ্চ বিদায় করে আবার ইংরেজিতে ফেরে- হোয়াত ইউ আর তকিং এবাউট। আই এম নত আন্দাস্ট্যান্দিং এনি অব দিস। হোয়াট ইজ খ্যাতা?
আমি এইবার ফরাসী রাজ্য জয়ের স্বাদ মুখে নিয়ে বললাম- খ্যাতা? খ্যাতা ইজ আ বেড সিট। আই মিন ওয়ার্ম ক্লোথ ওন দ্য বেড। ইউ নো খ্যাতা ইজ খ্যাতা।
ধেত্তেরিকার কি বলতে কি বলি। খ্যাতার ইংরেজি বলতে গিয়ে আমার ইংরেজি জ্ঞান একেবারে হাঁটুতে নেমে গেল। সারা দুনিয়া তালাশ করেও খ্যাতার ইংরেজি মনে পড়ল না। অবশেষে ওয়ার্ম ক্লোথ বলেটলে কোনো রকমে পার পেলাম। মার্গারিট আমার নাকানিচুবানি দেখে সেদিনের মত ক্ষ্যান্ত দিলো।
অবশ্য সব সময় যে আমাদের ঝগড়াঝাটি চলে তা না। সম্পর্কটা বেশ ভালোই বলতে হবে। ইদানিং অবশ্য মার্গারিট তার মত বদলেছে খানিকটা। আমার সাথে আর ফ্রেঞ্চ ঝাড়তে আসে না। উল্টো সেদিন তো বলেই বসল- আই ওয়ান্ত তু লার্ন বেঙ্গলি। ডু য়্যূ হেল্প মি?
আমি গর্বে গদগদ হয়ে বললাম- ইয়াহ, আই’ল হেল্প য়্যূ হানি। কোত্থেকে শুরু করবে?
মার্গারিট হেসে বলল- ফ্রম দ্যাট ওয়ার্দ। ওই যে খ্যাতা..।
আজকাল আমি মার্গারিটকে বাংলায় খ্যাতাবালিশ শেখানোতে ব্যস্ত। সেই ফাঁকে একটু ফরাসীদের ভাষাও শিখে নিচ্ছি। নমুনা দেব? এই দিচ্ছি- কমেন্ত আলেজ ভউস- তুমি কেমন আছ? রেস্তার বিঁয়েন- ভালো থেকো।

-রবিউল করিম মৃদুল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *