নাকফুল

অনুর ঘুম ভেঙ্গে গেলো লোকটির ধাক্কাতে। এই শুনছো হঠাৎ করে আমার স্ত্রী রাতের ফ্লাইটেই চলে এসেছে। এই নাও তোমার সারা রাতের পেমেন্ট। তুমি চলে যাও। আর হ্যাঁ, যাবার সময় লিফটে যেও না। সিঁড়ি দিয়ে যেও।

অনু লোকটির কথা গুলো শুনে তাড়াতাড়ি উঠে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো। ঘাড়ের ব্যাগের চেইন খুলে টাকা গুলো রেখে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো। অনুর চোখে এখন ঘুমঘুম ভাব। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে এক পা আরেক পায়ের সাথে লেগে গড়িয়ে পড়তে গিয়েও সে নিজেকে সামলে নিলো। এখনো চারতলা নামতে হবে। সে একটুর জন্য থেমে আবার ব্যাগ থেকে তার মোবাইল বের করে সময় দেখলো। রাত তিনটা বেজে ২৫ মিনিট।

অনু আবার সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো। নিচে নেমেই সে গেইট দিয়ে দ্রুত বের হয়ে রাস্তায় চলে এলো। শীতের রাত। ঘরের তাপমাত্রার সাথে বাইরের তাপমাত্রার বিস্তর তফাৎ। চারপাশে হালকা কুয়াশা থাকার কারনে চারপাশে বেশ খানিকটা দেখা যাচ্ছে।
রাস্তার চারপাশ একদম ফাকা। কোনো মানুষজন দেখা যাচ্ছে না। চারপাশটা অনুর কাছে কেমন যেন অপার্থিব লাগছে। অনু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো কোনো রিকশা অথবা সিএনজির আশায়। কিন্তু কোনো কিছুর দেখা নেই।

হঠাৎ অনুর পিছন থেকে একটা কান্নার শব্দ ভেসে এলো। কেউ যেন কাঁদছে। হ্যাঁ, অনুর ঠিক পিছনে দেয়াল ঘেঁষে কেউ একজন বসে আছে। অন্ধকার থাকার কারনে অনুর চোখে এই মানুষের অস্তিত্ব জানান দেয়নি। অনু এগিয়ে দিয়ে দেখলো একটা মেয়ে কাঁদছে । অনু ব্যাগ থেকে ফোন বের করে তার ফ্ল্যাশ লাইটের আলো মেয়েটির উপর ফেলতেই ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো। মেয়েটার মাথায় কোনো চুল নেই। সম্পূর্ণ শরীরে ঘা, পরনে জামা থাকলেও তার প্রায় সম্পূর্ণ ছেঁড়া। ফলে মেয়েটির স্তনের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। মেয়েটার শরীর থেকে পঁচা পঁচা গন্ধ ভেসে আসছে। মেয়েটা অনুকে দেখে দুই হাত দিয়ে বুকের ছেঁড়া অংশ টুকু ঢাকার চেষ্টা করতেই অনু ব্যাগের মধ্যে থেকে কাল রাতে ওর বোনের জন্য ফুটপাত থেকে কেনা শীতের লাল সোয়েটার মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিলো। মেয়েটা একবার অনুর হাতের দিকে আরেকবার ওর মুখের দিকে তাকিয়ে অনুর হাত থেকে সোয়েটারটা প্রায় কেড়ে নিলো।

এমন সময় একটা আলোর দেখা পেয়ে অনু সেটার দিকে এগিয়ে গেলো। আলোটা ঠিক অনুর সামনে এসে বন্ধ হয়ে গেলো। অনু খেয়াল করলো আলোটা আসলে ছোট একটা পুরানো দিনের মাইক্রোর । ইঞ্জিন বন্ধ হবার সাথে সাথেই অনুর পাশে থাকা জানালার গ্লাস খুলে গেলো। গ্লাস খোলার সাথে সাথেই গাড়ির মধ্যে থেকে ভেসে এলো কড়া মদের গন্ধ। অনুর এই গন্ধের সাথে পরিচয় আছে। গাড়ির মধ্যে অন্ধকার থেকে ভেসে এলো একটা পুরুষ কন্ঠস্বর।

-এই যাবি?

কণ্ঠ শুনে অনু কয়েক পা পিছিয়ে এলো।

-কিরে লজ্জা পাচ্ছিস নাকি? এই লাইনে নতুন?

অনু চুপ করে রইলো। কোনো উত্তর দিলো না। ভয়ে ওর পা কাঁপছে।

-দেখ, ভয় পাসনে। আমরা তিনজন আছি। টাকা পয়সার কোনো সমস্যা নেই। যা চাস তাই পাবি।

অনু ওখান থেকে কয়েক পা পিছিয়ে গাড়ির পিছনের দিকে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

হঠাৎ গাড়ির ইঞ্জিন আবার চালু হলো। গাড়ির ইঞ্জিন চালু হলে অনুর মনের ভয় কেটে গেলো। অনু ভাবলো গাড়িটা হয়তো এবার চলে যাবে। কিন্তু কয়েক মিনিট হয়ে গেলেও গাড়িটা স্থির হয়েই দাঁড়িয়ে রইলো। অনু ভয়ে আরো কিছুটা গাড়ির পিছন দিকে এগিয়ে গেলো।

ঠিক তখনি গাড়ির দরজা দুই পাশ থেকে খুলে গিয়ে চারজন লোক বেড়িয়ে এলো। অনু ভয় পেয়ে গেলো, ওরা বলেছিল তিনজন, অথচ লোক আছে চারজন। অবশ্যই ওদের বদ মতলব আছে। ভয়ে অনুর মেরুদণ্ড দিয়ে একটা শীতল হাওয়া বয়ে গেলো। ও দ্রুত হাঁটতে লাগলো । লোকগুলোও ওর পিছুপিছু দৌঁড়াতে লাগলো। একসময় অনুও দৌড় শুরু করলো। কিছুক্ষণ দৌঁড়ানোর পর অনুর পায়ের সাথে কিছু একটা লেগে রাস্তায় পরে গেলো। ওর কপালের অনেকটা যায়গা কেটে গিয়ে সেখান থেকে রক্ত পড়তে লাগলো। এরমধ্যে লোকগুলো এসে অনুকে ধরে ফেললো। লোকগুলো ওকে এমন ভাবে ধরেছে যে ও সামান্য নড়াচড়া করার শক্তি নেই। মুখ দিয়ে চিৎকার করবে তারও কোনো সুযোগ নেই। কারণ লোহার মতো একটা হাত ওর মুখের উপর চেপে ধরে আছে।

অনু অনেক চেষ্টা করলো লোকগুলোর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার ৷ কিন্তু চারজন পুরুষের কাছে একজন নারীর শক্তি কোনো ভাবেই পেরে উঠলো না। লোকগুলো প্রায় ওকে নিয়ে গাড়ির কাছে চলে এসেছে। অনু নিজের মাথা নড়াচড়া করার চেষ্টা করতেই সামান্য একটু হাত মুখের উপর থেকে সরে গেলো। অনু সেই সুযোগ হাতছাড়া করলো না। বসিয়ে দিলো সেই লোহার হাতের উপর এক শক্ত কামড়। লোকটা দ্রুত অনুর মুখে থেকে হাত সরিয়ে নিলো আর সেই সুযোগে অনু পৈশাচিক এক চিৎকার দিয়ে কয়েক বার বলে উঠলো ” বাঁচাও”। এবার একটা শক্ত হাত নেমে এলো অনুর নাক বরাবর। একবার, দুইবার, তিনবার, অনুর আর কিছু মনে নেই। শুধু বুঝলো তার নাক ফেটে গেছে এবং সে জ্ঞান হারাচ্ছে।

চোখ খুলে অনু দেখলো সে হাসপাতালে শুয়ে আছে। খানিকটা সময় লাগলো ওর সবকিছু মনে করতে। ও ঠিক বুঝতে পারছে না ও ওখানে কেন। ওর মনের মধ্যে থেকে বলছে ওর ঠিক হাসপাতালে থাকা উচিৎ ছিল না। ওর স্থান ছিল অন্য কোথাও। ডান হাতটা ওর মুখের উপর দিতেই বুঝলো চোখ মুখ ছাড়া সম্পূর্ণ মুখ ব্যান্ডেজ করা। সেই রাতের কথা মনে হতেই ওর দুচোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো।

এমন সময় কয়েকজন ছেলে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। একজন এগিয়ে এলো ওর দিকে। এসেই বললো “এখন কেমন বোধ করছেন”?

অনু উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো আমি এখানে কেন?

ছেলেগুলো পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর অনুর সামনে বসা ছেলেটি বললো, আজ থেকে তিনদিন আগে এক রাতে আমরা বন্ধুরা মিলে পিকনিক থেকে ফিরছিলাম। হঠাৎ গাড়ির সামনে একটা ধস্তাধস্তি চোখে পরলো। গাড়ি থেকে নেমেই দেখি একটা পাগল চারজন ছেলেকে একটা বাঁশ দিয়ে এলোপাথাড়ি ভাবে মারছে। আমরা গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে যেতেই লোকগুলো গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায়। আর আমরা আপনাকে সেখানে পড়ে থাকতে দেখে তুলে নিয়ে এসে এই হাসপাতালে ভর্তি করি।

কথাগুলো শুনে অনুর চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে লাগলো। অনু নিজেকে সামলে নিয়ে ছেলেটিকে বললো ” আপনারা ঐ পাগলকে ওখানেই ফেলে এসেছেন”?

ছেলেগুলো অনুর প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে গেলো। আবার পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে রইলো। কিছুক্ষণ চারপাশের পরিবেশ একদম নীরব হয়ে রইলো। তারপর অনুই মুখ খুললো। আসলে ওটা ছেলে ছিল না, মেয়ে ছিল। আর সম্ভবত ও পাগলী ছিল না। কারণ আমি ওকে কিচ্ছুক্ষণ দেখেছি৷ রাতের অন্ধকারে আপনারা হয়তো বুঝতে পারেননি। তাই পাগল ভেবেছেন।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই অনু সেদিনের জায়গাতে ছুটে গেলো। গিয়ে চারপাশে সেদিনের সেই মেয়েটাকে খুঁজতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজার পর মেয়েটিকে না পেয়ে অনু যখন চলে যেতে লাগলো তখনি দুজন দোকানদারের কথা কানে এলো “পাগলীটা যে ওভাবে মরে আছে তার একটা ব্যবস্থা করা লাগতো না”।

অনু দোকানদারদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো ” কোথায় সেই পাগলী”?
একজন দোকানদার অনুর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললো ” সামনে গলির ডানপাশের চিপায় “।
অনু দৌঁড়ে সেইদিকে এগিয়ে গেলো। হ্যাঁ, লাল সোয়েটার পরা একজন মেয়ে সেখানে শুয়ে আছে। চারপাশের মানুষ নাকে হাত দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। অনু লাশটার পাশে গিয়ে বসে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো। তারপর নিজের গায়ের ওড়না দিয়ে লাশটাকে ঢেকে দিলো। একটা লাশের ইজ্জত জীবিত লাশের চেয়ে বেশি।

সন্ধ্যার আগে আগে মেয়েটার মাটি হলো। কবর দিলো মাত্র চারজন। অনু, একজন হুজুর, যে কবর খুঁড়েছে, আর একজন মহিলা। অনু মাটি দিয়ে চলে আসার সময় মহিলাটি ডেকে বললো, ” লাশের কোমরে পলিথিনে বাঁধা একটা ছোট্ট ব্যাগ ছিল, ওটাতে ছিল এই ছবি আর এই নাকফুল”। দিনের শেষ আলোতে অনু ছবিটা একবার দেখে নিলো। কি নিষ্পাপ একটা মুখ। অপলক চেয়ে আছে। নাকফুলটা সূর্যের আলোর দিকে ধরে মনে মনে ভাবলো” হয়তো এই নাকফুলে জড়িয়ে আছে কোনো অন্ধকার এক ইতিহাস “।

রিফাত আহমেদ


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *