নপুংসক ( ১২তম এবং শেষ পর্ব )

নানা বাড়িতে অনেকগুলো বিস্ময় অপেক্ষা করেছিল আমার জন্য। একে একে আমি সবগুলোর সামনাসামনি হলাম। এ বাড়িতে আমার জন্য যে এত ভালবাসা জমা পড়ে ছিল, কে জানতো? যেন আকাশ থেকে চাঁদ নেমে এসেছে,আর সে আনন্দে সবাই দিশেহারা। সবার সেই ভালবাসার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আমার নিজের প্রতিই লজ্জা হতে থাকলো। মনে হচ্ছিলো এক জীবনে কত না প্রাপ্তি মানুষের!!

নানীজান অসুস্থ ছিলেন। তিনিও আমাকে পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমাকে বুকে জড়িয়ে কতক্ষণ কাঁদলেন। নিজ রান্না করতে গেলেন আমার জন্য। রান্নাঘরে কাঠকাঠির উনুনের কাছে বসা নানীজানের পাশে বসলাম। কি মমতার উষ্ণতা নানীজানের স্পর্শে!!
অনেক গল্প হতে থাকলো আমাদের। অধিকাংশই নানাজান আর আমার মায়ের স্মৃতিগত। আমার অনুভব হলো যেন, নানী তাদের দু’জন কে হারিয়ে ভিতরে ভিতরে কত শূন্য,একা হয়ে গেছেন!

সব কিছুর মাঝে আমি কেবল আমার মা’কে খুঁজতে লাগলাম। উঠোনে দাঁড়িয়ে মনে হলো, মা কতো না এ উঠোনে ঘুরেছেন। এখানে তার কত পদচিহ্ন আছে!
বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনে হলো, এখানে হয়তো গরমের কত বিকেল তিনি একা বসে থেকেছেন!
মামা-মামী আমাকে পেয়ে উতলা হলো। তারা নানারকম গল্প করতে লাগলো আমার সাথে। তাদের এ্যালবাম খুঁজে মায়ের যে কয়টি ছবি পাওয়া গেল, সব নিয়ে এলো সামনে। সব ছবির পিছনের গল্প শুনতে লাগলাম আমি।

বিকেল বেলায় নানীজান মায়ের ছোট্ট ঘরটা খুলে দিলেন। আমি সে ঘরে ঢুকতেই মায়ের গায়ের গন্ধ পেলাম নাকে। ঠিক সেদিনের সেই গন্ধ,মা যখন লুকিয়ে মাঝে মাঝেই আমার স্কুলে গিয়ে আমাকে কোলে নিয়ে আদর করতেন আর কাঁদতেন।

আমি তার বিছানা,ছোট্ট টেবিলে রাখা তার চশমা,ঔষধের বাক্স আর কাঠের পুরানো আলনায় রাখা মলিন কিছু কাপড়-চোপড়ে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। আহ্ কি শান্তি এখানে! যেন সব ক্লান্তি আমার মিটে গেল।

আলনায় রাখা মায়ের শাড়িটা তুলে আমি নাকে ধরলাম,মুখ ডুবিয়ে নিলাম কাপড়ের ভাঁজে। এই প্রথম আমার চোখ বেয়ে তার জন্য কাঁন্না চলে এলো।
মায়ের বিছানায় শুয়ে দিয়ে নানীজান মায়ের শেষ সময়টুকু নিয়ে গল্প করছিলেন। জীবনের অজস্র দুঃখ পার করে তিনি শেষ বেলায় কিছুটা উন্মাদের মতো আচরণ করতেন। খেয়ালে ডুবে থাকতেন, এলোমেলো কথা বলতেন। বাবার সংসারে তার উপস্থিতির অনুভবে চলতেন। নিজের ভাতের প্লেট সামনে রেখে বসে থাকতেন। নানীজান জিজ্ঞাসা করতেন,

‘তুই ভাতের প্লেট নিয়ে বসে আছিস্ কেন?’

মা বলতেন, ‘দেখতে পাওনা, তোমার জামাই খেতে বসেছে।’
নানীজানের কাছে গিয়ে বলতেন,
‘মা একটা পান দাও, তোমার জামাই পান খাবে।’

অনেক রাতে মায়ের ঘরে কথা শুনে নানীজান জানালার কাছে দাঁড়াতেন। দেখতেন, মা বসে বসে একা একা হাত নেড়ে কথা বলছেন’

নিজের সংসারের ধ্যানে ডুবে থাকা মায়ের আচরণে বাড়ির সবাই হাসাহাসি করত। কিন্তুু নানীজান মেয়ের মনের বেদনায় প্রতিনিয়ত আহত হতেন বারবার। নানীজানের চোখের পানি বেয়ে বুকের শাড়িতে টুপ টুপ করে পড়ছিল কথাগুলো বলতে গিয়ে। আমি নিজের ভিতরে নিজে পুড়ছিলাম। বুকের ভিতর যন্রণা হচ্ছিল। বললাম,

‘নানীজান, মা কে ডাক্তার দেখিয়েছিলে?’

‘হ্যা, ডাক্তার দেখিয়েছিলাম। ডাক্তারের পরামর্শে দেওয়া ঘুমের ঔষধ মুঠোভরে খেয়েই তো এক রাতে তোর মা এই বিছানায় ঘুমিয়ে থাকলেন,কেউ জানলোই না। ‘

নানীজান বলেই চললেন,
বাবাকে খোঁজ দেওয়া হয়েছিল তার সব পরিস্থিতির। তিনি তবুও কখনও আসেননি। শেষে আমাকে, বাবাকে ছেড়েই তাকে কবর দেয়া হয়েছে।

আমি নিজের ভিতরে নিজের খেই হারিয়ে ফেললাম। কিসের যেন আক্রোশ আমাকে অস্থির করে তুললো। নিজেকে শান্ত করতে আমি মায়ের কবর পাশে গিয়ে দাড়ালাম সূর্য মিলিয়ে যাওয়ার কিছু আগে। বাঁশের বেত দিয়ে ঘিরে রাখা এই সামান্য জায়গাটুকুতে কত কিছুরই না কবর হয়ে গেছে। নিজের সবটুকু অস্তিত্ব সবার কাছ থেকে গোপনে একা তুলে নিয়ে এখানে এসে লুকিয়ে আছেন আমার মা। আমি সেখানে বসে রইলাম কতক্ষণ আমি জানিনা।

বড় মামা আমাকে ডেকে নিয়ে এলেন যখন তখন অনেক রাত। মামার বলা কোন কথাই আমার কানে এলোনা। আমার পৃথিবী কেমন শূন্য লাগতে শুরু করেছিল।

রাতে আমি মায়ের ঘরে তার বিছানায় একা ঘুমাতে গেলাম। ঘুমিয়েছিলাম কিনা জানিনা। খুব নরম আর শীতল হাত আমার কপালে অনুভব করতেই বুঝলাম, মা এসেছেন।

‘তুমি এসেছো বাবা?’

‘মা, বড় দেরি হয়ে গেল আসতে, তাইনা?’

‘এত কষ্ট পেয়োনা। যা আমি সয়েছি,তা তো জীবনের কাছে আমার পাওনা ছিল।’

‘শুধু কি তোমার একার পাওনা?’

মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,

‘তোমার বাবা তোমার কথায় কষ্ট পেয়েছেন। সে তোমার সাথে কোন অন্যায় করেনি।’

আমি মায়ের কথার জবাব দিলাম না। প্রশ্ন করলাম,

‘তুমি প্রতিশোধ চাওনা মা?’

মা উচ্চস্বরে হাসলেন। আমি এমন করে কখনও কাউকে হাসতে দেখিনি। যে হাসি আমার দহনকে শতগুণে বাড়িয়ে দিচ্ছিল। আমার ভিতরে আক্রোশ ফেটে পড়ছিল।

আমি চিৎকার করে বললাম,

‘আমি প্রতিশোধ চাই মা। আমি অবশ্যই প্রতিশোধ চাই।’

নানীজান দরজায় ধাক্কাধাক্কি করছেন বাহিরে। ঠিক রুনুর মতো নানীজান বলছেন,
‘বেড়িয়ে আয় দাদা,দরজা খোল।’

আমি খুলনায় তানিয়ার কাছে চলে গেলাম পরদিন । তানিয়ার কাছে শোনা গল্প অনুসারে খোঁজ নিয়ে সেই হাসপাতালে ভর্তি হলাম। যেখানে তরিকুল এক সময় তানিয়া হয়ে গিয়েছিল। খুব সামান্য একটা অপারেশন। আমার ভিতরে আমি পুড়েই যাচ্ছিলাম। সেই আমার আমিকে পুনরায় সুস্থ করতে চেয়েছি কেবল। এই অপারেশন আমাকে নপুংসক নয় মানুষ বানিয়েছে। আমি প্রতিশোধ নিয়েছি নিজের সাথে নিজের। এই প্রতিশোধ আমাকে শান্ত করল তবে কষ্টের মুক্তি দিলনা।

তানিয়া আন্দাজ করে বুঝতে পেরে রুনুকে খোঁজ দিয়েছিল আমার। শুনে আমাকে মতিন নিয়ে এলো ওদের বাড়িতে আজ। রুনুর বিয়ের পর প্রথম এলাম আমি রুনুর সংসারে। কি সুখী সুখী লাগছে রুনুকে। রুনু পেরেছে আমার মা পারেনি যা। কি ভালোই না লাগছে তা ভেবে!

সবাই আমাকে দেখতে এসেছে। বিছানার পাশে সবাই দাঁড়িয়ে। বাবা বোধহয় দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না, কাঁপছিলেন দেখে মতিন চেয়ার টেনে তাকে বসিয়ে দিল।
বাবাই প্রথম কথা বললেন,

‘কেন এমন করলি বাবা?’ তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। আমি বিছানায় আধাশোয়া হলাম। বাবার হাতটা ধরলাম।

‘আমার মা নষ্টা নয় বাবা, তার রেপ হয়েছিল। তুমি তাকে রেপ করিয়েছো। মা কতটা বোকা ছিল, বুঝতেই পারেনি তুমি আলতাফ চৌধুরীকে কেন লেলিয়ে দিয়েছো তার দিকে?’
বাবা হুঙ্কার দিতে চাইলেন-

‘একথা ঠিক নয়’

আমি শান্তস্বরে বললাম,

মা বারবার বলার পরেও ঐ পিশাচটাকে মায়ের সংস্পর্শে এনেছো তুমি,যেন ঋণের দায় তোমাকে না পোহাতে হয়। একথাটা তো ঠিক বাবা।’

আবার বললাম, জানিস্ রুনু, তানিয়া একজন হিজড়া হয়ে মামুনের প্রতিশোধ নেবার সাহস করেছিল। আমার মাও আইনের আশ্রয় নিতে চেয়েছিল। বাবা তাকে তা করতে দেয়নি। ‘

বাবার হতবিহ্বল চোখ উপেক্ষা করে বললাম,
কেন জানিস? কারণ ঐ লোকটা বাবাকে বলেছিল,
‘মুখ বন্ধ রাখলে সমস্ত ঋণ থেকে তাকে মুক্ত করে দেয়া হবে।’ বলে আমি অল্প হাসলাম।

‘তারপর মা’কে বাবা আর গ্রহন করলেন না। বরং দিনের পর দিন তাকে অপমান আর লাঞ্চনা সহ্য করতে হয়েছে। নিজের অপরাধ উল্টো তার ঘাড়ে চাপিয়েছো তুমি বাবা। কি অসহ্য যন্রণাদায়ক ব্যবহার করেছ তার সাথে! কি জঘন্য কথা তুমি তাকে শোনাতে!

তারপর সবার কাছে সে নষ্টা হয়ে গেল। স্বামী যদি তার স্ত্রীর চরিত্রে আঙ্গুল তুলে তবে সমাজ তাকে নষ্টাই তো বলে, তাইনা বাবা?
তবুও তোমার সহ্য হলোনা। হয়তো তুমি জানতে, তার থেকে মুক্ত হতেই তুমি বিয়ে করে আনলে ছোটমাকে।’

কেউ কোন কথা বলছিলনা। নিরবতায় কাটলো কিছুক্ষণ।

ছোটমা, মতিন, রুনু, মীরা, মতিনের বাবা,তানিয়া সবার বিস্ফোরিত চোখ আমার বড় অসহ্য লাগছিল।
বাবা অসহায় কাঁন্নায় ভেঙ্গে পরে বললেন,

‘তুই কেন?’ শাস্তি আমাকে দিতে পারতিস্।’ আমি বাবার হাতটা আমার মুঠোর মধ্যে নিলাম-

‘আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি বাবা। তুমি জগতের সবচেয়ে ভাল বাবা।

মৃদু স্বরে আবার বললাম,
‘শাস্তি তো তুমি পাচ্ছ,যতদিন বেঁচে থাকবে পাবে। তোমার একমাত্র ছেলে সন্তান নপুংসক, একি কম শাস্তি?’

-বেলা প্রধান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *