ধ্রুবতারা (১ম পর্ব )

জানালায় ঠক ঠক শব্দ হতেই চমকে উঠে মিনু ।
ভয়ার্ত গলায় মিনু বলে উঠলো , ” কেরে বারে ? কাই ডাকে ? ”

জানালার ওপাশ থেকে রাজন খুব নিচু গলায় বলে উঠলো , ” হামি রে , জাংলাডা এইটু খুল ! ”

রাজনের গলার আওয়াজ পেতেই মুহূর্তেই মিনু ধরমর করে বিছানার চৌকিতে উঠে বসে। বিস্ময়ে ঘুম ঘুম চোখে জানালার পাল্লা খুলে আবছা অন্ধকারে রাজনের মুখটা দেখে মিনুর মনে কি এক খুশির শিহরণ বয়ে যায়। তবুও মা বাবার ভয়ে কম্পিত গলায় মিনু বলে উঠে , ” আপনে এঁদো আইতে , ফির কি মনে করি ? ”

” কপাটটা খুল্যা বাইরে আসিবার নাগপে। ”

” এ্যাত আইতোত আপনে কিযে জ্বালাতন শুরু করিলেন ! মুনে অয় মা আর বাপে এ্যাকুনো ঘুমাই নিকো ! ”

” লুক করি কপাটা আওজা দিয়া বাইরে আ দেকি। ” চাপা ক্ষুদ্ধ স্বরে বলে উঠলো রাজন ।

রাজনের ডাক শুনা মাত্র মিনুর মনে কি এক শিহরণ খেলে গেল । মুহূর্তেই গাল দুটোয় রক্তিম আভা দেখা দিল । জলদি করে বিছানার নিচে রাখা কেরোসিনের কুপিটা বের করে জ্বালিয়ে দিল । কুপির আলোতে চট করে ঘরের চাটায়ের বেড়াতে ঝুলানো আয়নায় একবার নিজেকে দেখে নিল । বিছানার তোষকের তল থেকে টিপের পাতা বের করে একটা লাল টিপ কপালে লাগালো । জলদি করে কাজলদানি থেকে আঙ্গুলে একটুখানি কাজল নিয়ে দুই চোখে টেনে টেনে কাজলও দিল । শাড়িটা দ্রুত এক পল্লা করে পরা শেষ করে আবারও একবার নিজেকে আয়নায় দেখে ফু দিয়ে কুপির আলোটা নিভিয়ে দিয়ে খুব আস্তে আস্তে দরজার কপাট খুলে বাইরে বের হয়ে এসে আবারও কপাটটা আস্তে করে ভিড়িয়ে দিয়ে পা টিপে টিপে বাড়ির পাশে পুকুর পাড়ে গিয়ে আবছা অন্ধকারে রাজনকে দেখে দুরুদুরু বুকে এগিয়ে চললো । যতই সে রাজনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো ততোই তার বুকের ভিতর ধড়পড়ানি বেড়ে যেতে লাগলো । হাত পা কেমন যেন অবশ হয়ে আসতে লাগলো । মিনু খেয়াল করেছে রাজনের সামনে আজ পর্যন্ত কিছুতেই সে স্বভাবিকভাবে দাঁড়াতে পারে না । তার সামনে দাঁড়ালে কোথা থেকে কি এক লজ্জা এসে তাকে জড়িয়ে ধরে । এমনকি ভাল করে রাজনের মুখের দিকে দুই চোখ মেলে ঠিকমতো চাইতেও পারেনা ।

মিনুর পায়ের শব্দে রাজন এগিয়ে এসে মিনুর একটা হাত ধরে পুকুরের পাড়ে নিয়ে তাকে বসিয়ে দিয়ে নিজে তার পায়ের কাছে নিচু হয়ে বসে একটুখানি হেসে বলে উঠে ,
” কিরে মিনু ক্যামন আছুন ? ক্যারে ঘুমাই পড়ছিলি লা ? ”

” মুই ভালা আচি। থ্যাক্যা থ্যাক্যা আপনে য্যান কি করি বসেন ? বাপ আর মায়ে যদি জ্যাঁনবার পারে তাইলে কি হোবিনে ? ”

” কি আর হোবি , ধরি তর সাতোত বিয়া দিয়া দিবেনে ! ভালাই তো হবি । ”

” একনা কন , কিসক কামের জন্নি ডাকিছিলেন ? ”

” তরে আইজ খুব দেখিবার মুন চাইছেল ! ”
কথাটা শুনামাত্র মিনুর মুখখানি লজ্জায় লাল হয়ে গেল। একবার মনে হলো রাজনের সামনে থেকে এক দৌঁড় দিয়ে পালিয়ে বাঁচে । কিন্তু কি এক অমোঘ আকর্ষণে রাজনের সামনে মাথা নীচু করে বসে থাকলো ।

কোনরকমে মিনু বলে উঠলো ,
” আপনে কি আইতোত কিছু খাইচেন ? ”

” নারে , একনাও খাওন অয় নাই । ” তয় তর সাত দেকা করিয়া ডুব দিয়া মুই খাইম । ”

রাজন একটা ছোট বাজারের ব্যাগের ভিতর থেকে একগোছা কাঁচের চুড়ি , লেইস ফিতা ও একটা তিব্বত স্নোর কৌটা বের করে মিনুর হাতে দিয়ে বলে উঠলো ,
” আইজ হাটোত গেইছিলাম, অটে থ্যাকা লিয়া আচ্চি। ”

চুড়িগুলো দুহাতে নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে মিনু বলে উঠলো , ” এ্যাতগুলান ট্যাকা পায়সা খরচ করি এইল্লা দরকার ছ্যাল ! ”

” কিসক যে খরচ করি তা হামিই জানি। তুই বুঝবু লা ! এলায় নিয়া আচ্চি। কাইল তুই এগল্যান পড়ি ওই পাড়াত বেড়াইবার যাবু , মুই তরে দূর থাকিয়া দুচোখ ভরি দেকমু লা। ”

” চোরের মুতো নুকিয়া দেইকনের কি আচে ? একবারেই তো এলায় তুলি নিয়া যাইবার পারেন ! কে আপনারে ডাংগাইবো? বাঁধাই বা কাই দিবার আসিবে?” কথাগুলো কোনরকমে বলেই রাজনের দেয়া জিনিসগুলো নিয়ে এক দৌঁড়ে তার সামনে থেকে মিনু পালিয়ে বাঁচলো। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে রাজন তার গমন পথের দিকে চেয়ে রইলো ॥
( চলবে )

** নোট :
কিসক : কি কারনে
ডাংগাইব : মারবে
নুকিয়া : লুকিয়ে
দেইকনের : দেখার
এগল্যান : এইগুলো
অটে থ্যাকা : সেখান থেকে
একনাও : এখনও
আইতোত : রাতে
নাগপে : লাগবে

-ফিরোজ চৌধুরী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *