ডিনার ফর টু ( ৪র্থ পর্ব )

‘ম্যাম, ইয়োর লাগেজ?’ অপলা ক্যাবের কাছে ফিরে যেতেই ড্রাইভার অপলার লাগেজ বের করে সামনে এগিয়ে দিল। ‘ও মাই গড! আই’ম সো সরি। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।’ বলেই অপলা পার্স খুলে ক্যাবিকে কিছু এক্সট্রা টিপস দিয়ে দিল। ক্যাবী খুশি মনে চলে যেতেই সে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। হাসানের বাড়ির সামনে এসে অপলা এতটাই আবেগাপ্লুত হয়েছিল যে সে ভুলেই গিয়েছিল তার লাগেজের কথা। অপলা মনে মনে ক্যাব ড্রাইভারকে আবার একটা ধন্যবাদ দিল।

রুবেলকে বিদায় করে দিয়ে হাসান লিভিং রুমটা একটু পরিপাটি করে নিচ্ছিল—শেষ মুহূর্তের পরিচ্ছন্নতার ছোঁয়া যাকে বলে আর ঠিক সেই মুহূর্তে দরজায় নক হলো। খুবই মৃদু শব্দে। হাসান একটু ভাবল,রুবেল কি এখনো যায় নি তাহলে? এবার ডোর বেল বাজল। সে বিরক্ত কণ্ঠে বলল, ‘আশ্চর্য, ছেলেটা পারেও বিরক্ত করতে’ বলে সে দরজা খুলতে গেল। হাসান দেখল সত্যিই সত্যিই অপলা দাঁড়িয়ে আছে—দরজার সামনে। একটু থতমত খেয়ে সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল অপলার মুখের দিকে। অপলার মুখে একটা স্মিত হাসি। হাসান চুপ করে আছে—অপলাও। কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। কিংবা বলতে পারল না।কিছু সময় পার করে অপলা নীরবতা ভেঙ্গে বলল, ‘হাই, হাসান! ইটস বিন অ্যা হোয়াইল!’ হাসান সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, অনেকদিনই তো। দু’বছরতো আর কম সময় নয়! দেখতে দেখতে বছর কেটে যায়।’ হাসানের দৃষ্টি সরাসরি নিবদ্ধ অপলার ওপর, সে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থেকে বলল, ‘অপলা, ইউ লুক গ্রেট। অনেক সুন্দর হয়েছ তুমি ভেরী প্রিটি!’ অপলা হেসে দিয়ে বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ। ইউ লুক ভিনটেজ এণ্ড গ্রেট টু!’ অপলার প্রশংসায় হাসানের হাসি প্রসারিত হলো। সে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, ‘এসো, ভেতরে এসো।’ অপলা ভেতরে ঢুকে ব্যাগটা রেখে কয়েক পা এগিয়ে গেল সামনে। চারিদিকে একনজর চোখ বুলিয়ে ঘুরে দাঁড়াল হাসানের দিকে। হাসান হঠাৎ বুঝতে পারল তার হাতের ব্রাউন প্যাকেটের দিকে অপলা তাকিয়ে আছে। সে অপ্রস্তুত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে হাত পেছনে নিয়ে গেল। অপলা বলল, ‘আর ইউ ওকে?’ ‘ইয়েস, ইয়েস আই’ম ফাইন।’ হাসান বোকার মত হেসে বলল। অপলা মিটি মিটি হাসি দিয়ে বলল, ‘তো এই তোমার সেই ড্রিম হাউজ! যার জন্যে তুমি…’ হাসানের মুখে অপরাধীর হাসি। সে বলল, ‘শুধু আমার একার নয়, তোমারও…’ ‘হুম, ওকে। তাহলে চলো, আমাকে ঘুরিয়ে দেখাও।’ অপলা চোখ ঘুরিয়ে তাকাল হাসানের দিকে। ‘অবশ্যই দেখাব। তার আগে তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। তারপর না হয় দেখাব সব। তুমিতো নিশ্চয়ই এখনি চলে যাচ্ছ না। চলো আমি তোমাকে তোমার রুম দেখিয়ে দিচ্ছি।’ ‘বেশ, চলো।’ হাসান অপলার ক্যারিং লাগেজটা সিঁড়ি বেঁয়ে ওপরে নিয়ে গেল। অপলা উঠে এলো পিছে পিছে। বেশ পরিপাটি করে সাজানো বড় একটা ঘরে অপলাকে নিয়ে এসে কোথায় কী আছে দেখিয়ে দিল হাসান। বিশাল একটা বাথরুম—বাথটাব, সাথে ওয়াকিং ক্লোজেট। ক্লোজেট ভর্তি অপলার রেখে যাওয়া কাপড়-চোপড়। অপলা সারা ঘর একবার দেখে নিয়ে এসে দাঁড়াল হাসানের সামনে। ‘ইউ মাস্ট বি টায়ার্ড।’ অপলা সামনে এসে দাঁড়াতেই হাসান জিজ্ঞেস করল। অপলা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘হুম, একটু!’ ‘তাহলে রেস্ট নাও।’ ‘রেস্ট নিতে হবে না—আমি একটু ফ্রেশ হয়েই আসছি।’ ‘ঠিক আছে তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি দেখছি, ডিনারের কী অবস্থা।’ বলেই হাসান দ্রুত বের হয়ে গেল। প্রথমেই বাথটাবে পানি ছেড়ে দিল অপলা। তারপর গরম আর ঠাণ্ডা পানির তাপমাত্রা ঠিক করে কিছুটা লিকুইড সাবান ঢেলে দিল পানির মধ্যে। সাথে সাথে বাথটাব সাবানের ফেনায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল। অপলা কাপড় ছেড়ে বাথটাবে গা এলিয়ে দিল। তার শরীর থেকে ভ্রমণের ক্লান্তি দূর হয়ে যেতে থাকল—আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে এলো তার।

হাসান ডাইনিং রুমে এসে দেখল সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। সে ডাইনিং টেবিলের দু’পাশে দুজনের জন্যে প্লেট, ছুঁড়ি, কাঁটা চামচ, ন্যাপকিন সুন্দর করে সাজাল। একটা শ্যাম্পেনের বোতল ন্যাপকিন দিয়ে পেঁচিয়ে টেবিলের পাশে শ্যাম্পেন স্ট্যাণ্ডের উপর রাখল। ডাইনিং টেবিলের ঠিক মাঝ বরাবর ঝুলে থাকা ঝালর বাতিটি জ্বালিয়ে আলো কমিয়ে দিল। তারপর অনেকগুলো ক্যাণ্ডেল জ্বালিয়ে একবার তাকিয়ে দেখল—পরিবেশটা রোমান্টিক হলো কিনা। তার চোখে-মুখে একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। সে দ্রুত চলে গেল তার রুমে ডিনারের জন্যে ফরমাল ড্রেস পরার জন্যে। বিছানার উপর কয়েকটি লং ড্রেস ছড়িয়ে অপলা তাকিয়ে আছে—সে ঠিক করতে পারছে না কোন ড্রেসটা পড়বে। যদিও তার পছন্দের পোশাক শাড়ি কিন্তু সে আজ হাসানের পছন্দের একটা আউটফিট পরবে বলে মনস্থির করল। কিছুক্ষণ ভেবে সে তার প্রিয় জর্জিও আরমানির নীল রঙের গাউনটিই তুলে নিয়ে গায়ে চড়াল। নিজেকে পরিপাটি করল সময় নিয়ে। সুন্দর করে সাঁজল। অনেকটা প্রথম ডেট নাইটের মতোই অনুভূতি হচ্ছে তার। স্লিভলেস লং ড্রেসের সঙ্গে একটি জিরকন ডায়মণ্ডের নেকলস পড়ল। হাতে ব্রেসলেট। ড্রেসের সঙ্গে মিলিয়ে হাতের ব্যাগ। দেখে মনে হবে যেন কোনো বিশেষ পার্টিতে যাচ্ছে সে। বেডরুমের লম্বা আয়নায় একবার নিজেকে তাকিয়ে দেখল অপলা—ক্লাসিক ও সেক্সি লুকের মিশ্রণে তাকে দেখতে লাগছে গ্রীক দেবীদের মতো। আয়নায় কিছুটা সময় তাকিয়ে থেকে একটা তৃপ্তির হাসি দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলো সে।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে এদিক ওদিক তাকাল। ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখল হাসান দাঁড়িয়ে আছে ডাইনিং টেবিলের পাশে। অপলা জোরে বলল, ‘সো হোয়াটস ফর ডিনার?’ হাসান কয়েক পা এগিয়ে এসে দাঁড়াল। মাথা তুলে দেখল অপলাকে। তার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল—বিস্ময়ে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ সে। অপলাকে দেখতে লাগছে অস্কার অনুষ্ঠানে ঝাঁ চকচকে লাল গালিচার উপর দিয়ে হেঁটে আসা হলিউড সেলিব্রিটিদের মতো। তার রূপ যেন উপচে পড়ছে। হাসান একটা ছোট্ট নিঃশাস ফেলে অস্ফুটে বলল, ‘ওয়াও!’ তারপর এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘লেট’স চেক ইট আউট।’ সৌন্দর্যের দ্যুতি ছড়িয়ে অপলা নেমে এলো নিচে। হাসান মুগ্ধ নয়নে বলল, ‘ইউ লুক বিউটিফুল। মনে হচ্ছে অস্কারে যাচ্ছ এওয়ার্ড নিতে।’ ‘তাই?’ বলেই একটু হাসল অপলা। সেই হাসির আড়ালে সামান্য বিষাদ। তাতে কিছু স্মৃতি, কিছু বিস্মৃত সুখ, কিছু আড়াল করে রাখা কষ্ট। কিছু লুকিয়ে রাখা সময়। সব যেন ক্ষণিকের জন্যে ভেসে উঠল একসাথে। হাসান হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সামান্য ইতস্তত করে হাসানের বাড়িয়ে দেয়া হাত ধরল অপলা। হাসান তাকে এস্কর্ট করে নিয়ে এলো ডাইনিং টেবিলে। অপলা দেখল সুন্দর করে সাজানো ডাইনিং টেবিল—দুজনের জন্যে। মনে হচ্ছে কোনো পাঁচ তারকা হোটেলের ফাইন ডাইনিং রেস্টুরেন্ট। হাসান চেয়ার সরিয়ে অপলাকে বসতে সাহায্য করল। অপলা বসতেই সে প্রফেশনাল ওয়েটারদের মতো ন্যাপকিনটির ভাঁজ খুলে অপলার হাতে দিল। তারপর ফ্রেঞ্চ উচ্চারণে বলল, ‘Would that be “dinner for two” mam?’ অপলা মজা পেল। সে হেসে দিয়ে বলল, ‘Yes! Thank you.’ ‘Okay then, may I offer you a glass of champagne?’ একই রকম ফ্রেঞ্চ উচ্চারণে বলল হাসান। ‘Yes you may.’ অপলা আবারো হাসল।হাসান অনভ্যস্ত হাতে শ্যাম্পেন বোতলের কর্ক খুলতে চেষ্টা করল পেশাদার ওয়েটারদের মত একটা ভাব নিয়ে। কিন্তু অনভ্যস্ত হাতে কর্ক খোলা মাত্রই অতিরিক্ত বুদবুদ তৈরী হয়ে বোতল থেকে উপচে পড়ল শ্যাম্পেন। অপলা হেসে ফেলল। হাসান অপ্রস্তুত ভাবে হাসল। সে খুব ধীরে একটা গ্লাসে কিছুটা শ্যাম্পেন ঢেলে এগিয়ে দিল অপলার হাতে। তারপর নিজের জন্যে একটা গ্লাসে ঢেলে নিয়ে বসল তার নির্দিষ্ট চেয়ারে। শ্যাম্পেন গ্লাস উঁচু করে ধরে হাসান বলল, ‘চিয়ার্স!’ অপলা তার গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে হাসানের গ্লাসে আলতো করে একটা ছোঁয়া দিয়ে বলল, ‘চিয়ার্স!’ একটা হালকা চুমুক দিয়ে শ্যাম্পেন গ্লাস নামিয়ে রাখল অপলা। তাকাল হাসানের দিকে।হাসানকে কিছুটা নার্ভাস মনে হলো, কেন কে জানে। সে শব্দ করে কয়েক সিপ শ্যাম্পেন গলায় ঢেলে দিল। অপলা মৃদু হেসে বলল, ‘Thirsty?’ হাসান খানিকটা অপ্রস্তুতভাবে বলল, ‘একটুতো বটেই।’ ‘আমিও।’ হেসে বলল অপলা। এবং বড় করে এক সিপ শ্যাম্পেন মুখে নিল। হাসান খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে এলো। অপলা প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে এমন একটা ভাব নিয়ে বলল, ‘কোথায় তোমার ডিনার? আনো দেখি, আর সহ্য হচ্ছে না। অনেক ক্ষিধে পেয়েছে।’ ‘এক্ষুনি আনছি।’ বলেই হাসান ঘুরে পাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘Waiter, we’d like to have our dinner now.’ ভাবটা এমন যে সেখানে একজন ওয়েটার দাঁড়িয়ে আছে। হাসানের কাণ্ড দেখে হেসে ফেলল অপলা। সে হাসতে হাসতে বলল, ‘And tell him to get me a huge dish, completely full.’ ‘Will do, mam.’ বলেই হাসান উঠে চলে গেল ভেতরে। কিচেন থেকে ডিশটা বের করতে যাবে ঠিক তখনই তার চোখ পড়ল, কিচেনের জানালার ওপাশে রুবেল দাঁড়িয়ে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। হাসানের সাথে চোখাচোখি হতেই সবগুলো দাঁত বের করে দিল সে। রুবেলের দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে হাসান অন্যমনস্কভাবে গরম ওভেনে হাত ঢুকিয়ে দিল।

(চলবে…)

-ফরহাদ হোসেন.

লেখক,নির্মাতা। ডালাস,টেক্সাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *