গোলাপ বালা

বিভাগীয় এই শহরের হাসপাতালে খুব অল্প বয়সেই পদোন্নতি নিয়ে এলেও আমার ছেলেমেয়ে দুজনের কেউই চায়নি আমি এসময় তাদের ছেড়ে আসি। শুধু আমার স্বামী সুমন্ত বলেছিল, চিন্তা করোনা, আমি সামলে নেবো। সেই যে বিয়ের আগে প্রথমবার দেখা হওয়ার সময়ে আমার বলা কথাটুকু তার পুরো জীবন রেখে যাবে সুমন্ত তা আমি নিজেও কল্পনা করিনি। বলেছিলাম, আমি তোমার সংসার চারদিক থেকে সামলাবো, শুধু আমার ক্যারিয়ারের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবেনা।

যদি না এগোতে দেই?

তবে এই বিয়ে হওয়ার চেয়ে না হওয়াই ভালো। মানুষরূপী কিছু অমানুষের মুখের জবাব দেয়ার জন্য হলেও আমাকে অনেক বড় ডাক্তার হতে হবে জীবনে।

সেই থেকে সুমন্ত আমায় শুধু সামনে হাঁটার পথটাই সহজ করে দিয়েছে।

হাসপাতালের করিডোর দিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে ছেলেকে মেসেজ পাঠাচ্ছিলাম, সরি বলে। আজ বিকালের ফ্লাইটে আমার ঘরে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু বের হওয়ার খানিক আগে হাসপাতাল থেকে আসা জরুরী ফোন আমার নিয়ে রাখা ছুটিটাকে কাজের দিন বানিয়ে দিল। ফোনের ওপারে সিএ প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলছিল, আপা প্লিজ একটু আসেন। এই ছেলেটা আমি আসার পরপরই জয়েন করেছে। এতো ডেডিকেশন দিয়ে কাজ করে যে ফোনে ওর গলার স্বরে আমি বুঝে যাই বড় কোন গড়বড় হয়েছে।

ওয়াশ নিয়ে যখন ওটিতে দাঁড়াই আমার হাত একবার কেঁপে ওঠে, রোগীর স্যাচুরেশন, হার্ট রেট কোনটাই যে স্ট্যাবল না। তবু মাথার ভেতর চলতে থাকে ইমার্জেন্সীর একের পর এক প্রটোকল আর অভ্যস্ত হাত চালিয়ে যেতে থাকে তার কর্মযজ্ঞ। ওটি শেষে বেরিয়ে সিএ আরিফ কে ডাকি রুমে।

রোগীর পার্টির সাথে কথা বলেছো? আমি নিজে কোনভাবেই শিউর না রোগী পোস্ট অপে রিকভার করবে কি না, তুমিও সেটা বুঝতে পারছো নিশ্চয়ই।

জ্বী,আপা।

রোগীর লোককে কাউন্সেলিং করে রাখো।

লোক বলতে শুধু এক মেয়ে। ওকে কাউন্সেলিং করা না করা এক কথা। এতো নার্ভাস হয়েছে যে আমি যা বলেছি শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকেছে।

আমাদের সবাইকে ভীষণ রকম অবাক করে দিয়ে রোগী পারভীন আক্তার পাঁচদিনের দিন দিব্যি বিছানায় উঠে বসেন।
রোগী ডিসচার্জের আগের দিন আমি রাউন্ড শেষে মাত্রই সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করতেই পেছন থেকে আমাকে দাঁড় করায় এক মেয়ে।

আপা, একটা কথা বলবো? পাঁচমিনিট যদি সময় দিতেন।

কি বলেন?

আমি বিশ নাম্বার বেডের পারভীন আক্তারের মেয়ে। ঐ যে আপনি রাউন্ডে বললেন কালকে ছেড়ে দেবেন।

ও হ্যা, কোন সমস্যা?

আপা আপনের বাড়ি কি দৌলতপুর?

কেন বলুন তো?

আমার মা বললো, আপনাকে ওনার খুব চেনা লাগছে, খুব করে জানতে চাইলো তাই জিজ্ঞেস করা। বোঝেনই তো অসুস্থ মানুষ খালি জেদ করে। আমার ঐ মা ছাড়া আর কেউ নাই আপা।

আমার দাদা বাড়ি দৌলতপুর। আমার অবশ্য যাওয়া হয়না।

আপনার বাবার নাম কি মোস্তাফিজুর রহমান?

খানিকক্ষণ মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকি। আমার অতীত জানা মানুষের সংখ্যা যে এই পৃথিবীতে খুবই কম। অবশ্য তেমন সুখকর অতীত হলেতো? কোনরকমে হুম বলে পাশ কাটিয়ে চলে আসি।

আমার বয়স যখন দশ, এক ভরদুপুরে আমার মা বিনা চিকিৎসায় মারা যায় ভীষণরকম রক্তক্ষরণ হয়ে। তখন না বুঝলেও এখন বুঝি মায়ের মিসক্যারেজ হয়েছিল। মেয়ে বাচ্চা ঘরে থাকলে ছেলের আরেকটা বিয়ে দেয়া যাবেনা এই দোহাই দিয়ে আমার দাদী আমাকে পাঠিয়ে দেন নানী বাড়ি। প্রথম প্রথম বাবা এসে দেখে যেতেন মাসে দুমাসে। তারপর বাবার আসাও কমে যায়। নানী বেঁচে থাকার কারণে হয়তো পড়ালেখাটা থেমে যায়না আমার। তবে ঘরের সবার ফুটফরমাশ খেটে তবেই সুযোগ মিলতো পড়ালেখার। কিছু কাজের বেশকম হলেই বাড়ির সবাই শুধু বলতো নিজের বাপ, সৎ মা তো ঘরেও নেয় নাই।আমরা না রাখলে তো রাস্তায় ভিক্ষা করা লাগতো।

মেট্রিক পরীক্ষার আগে আগে একদিন নানীবাড়িতে এক লোক এসে খবর দিয়ে যায় আমার বাবা মারা গেছেন। ততদিনে বাবার সাথে আমার সম্পর্কের সূতো আলগা হতে হতে শুধু কাগজে ছাড়া আর কোনভাবে তেমন একটা ছিলনা। তবু বাড়ির সবাই মিলে শেষ দেখা দেখতে নানী সহ আমাকে পাঠায় আমার দাদাবাড়িতে। সেখানে অবশ্যই আমি কোন আকাঙ্খিত অতিথি ছিলাম না। লোকমুখে শোনা বাবার এই সংসারেও একটা মেয়েই হয়েছে শুনে মনে মনে একটু কষ্ট পেয়েছিলাম মেয়েটার জন্য। ওর ভবিষ্যতও যে আমার মতোই হবে সেটা তো সহজেই অনুমেয়। ফেরার পথে নানী বারবার বলছিল, ‘আমার মেয়ের গোলাপবালা দুইটাও রাইখা দিল? আমার মায়ের স্মৃতি আছিল। মাইয়াটারে দিসিলাম। ভাবসিলাম তোরে দিবো।’ আমার নিজের জীবন নিয়েই সারাক্ষণের চিন্তা, গোলাপবালার স্মৃতি খোঁজার সময় আমার কই তখন?

…………….

পারভীন আক্তারের ডিসচার্জ পেপারটা ইচ্ছে করেই রুমে আনাই। বাড়ির ঠিকানা দেখার জন্য। ভেবে বের করার চেষ্টা করি কোনভাবে এই মহিলাকে কি আমার চেনা উচিত? কাগজটা ফেরত দেবার জন্য পিয়নকে ডাকতেই সে জানায় পারভীন আক্তারের মেয়ে আমার সাথে একটু কথা বলতে চায়। গতকালের কৌতুহল থেকেই তাকে রুমে আসতে বলি।

কি বলবেন বলুন?

আপা, এই বাক্সে আপনার একটা জিনিস আছে। আমার মা দিয়েছে।

আরে কিছু দিতে হবেনা। আপনার মা সুস্থ হয়েছে আমি তাতেই খুশী।

মা বলেছে, এই জিনিসের মালিক নাকি আপনি। আমার বয়স যখন সাত তখন আমার বাবা একদিন হুট করে মারা যায়। ওনার আগের ঘরে একটা মেয়ে ছিল। আমার মা আপনার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।
এটুকু বলে মেয়েটা এক দৌঁড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় এই আমি আস্তে করে গয়নার ছোট বাক্সটা খুলি। পুরোনো দিনের একজোড়া গোলাপ বালা শুয়ে আছে লাল ভেলভেট কাপড়ের ওপর।

পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তা কোন হিসেবেই বুঝি অপূর্ণ রাখেননা। এক কাপড়ে নানীবাড়ির উদ্দেশ্যে বের হয়ে আসা এই আমার কাছে মায়ের স্মৃতি বলতে যে কিছুই ছিলনা এতোদিন।

……………

আতিয়া বানু নামে কেউ থাকেন এ বাড়িতে?

শহর থেকে গাড়ি হাঁকিয়ে আসা দুজন মহিলাকে দেখার জন্য আশেপাশে খানিক ভীড় জমে যায়। লাঠিতে ভর দিয়ে পাশের এক ছনের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন এক বৃদ্ধা।

আমি আতিয়া বানু। তোমরা কে?

আমরা মোস্তাফিজুর রহমান মানে আপনার বড় ছেলের দুই ঘরের দুই মেয়ে। আপনার কাছে একটা প্রশ্নের উত্তর চাইতে এসেছিলাম। আপনি উত্তর না দিলেও হবে। তবে আমার মনের শান্তির জন্য প্রশ্নটা করা?
মেয়ে হয়ে জন্মেছিলাম বলেই বুঝি এমন করে ভিটেমাটি ছাড়া করলেন? আপনি নিজে মেয়ে হয়ে কিভাবে পারলেন এমন করতে? যাদের জন্য এতো সম্পত্তি জমা করে রাখলেন তারা কি আপনাকে খুব ভালো রেখেছে?

আমাদের পরিচয় বৃদ্ধা ও বাড়ির সবাইকে দারুন রকম নাড়িয়ে দিলেও আমি বলে যেতে থাকি তার চোখের দিকে তাকিয়ে। আমার শিক্ষা আমাকে শিখিয়েছে, মানুষকে মানুষ হিসেবে ভালবাসতে হয়। তাই আমার কার্ড আর ফোন নাম্বার রেখে যাচ্ছি আপনার জন্য। কোন বিপদে পড়লে নির্দ্বিধায় স্মরণ করবেন।

পেছনে হতভম্ব বাড়ির লোকদের ফেলে এসে দুই বোন গাড়িতে উঠি। হাতে পরে থাকা মায়ের স্মৃতি জড়ানো গোলাপবালা দুটোতে আলতো হাত বুলিয়ে মনে মনে বলি, মাগো, মেয়ে হওয়ার কারণে যে অবহেলা আমার নিজ রক্তের মানুষজন করেছে তার একটা জবাব দিতে পারলাম আজ শুধুমাত্র তোমার স্মৃতিটুকু ফেরত পেয়ে।

-ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *