গোধূলিবেলায় ( ৯ম পর্ব )


রশীদ সাহেব অফিস থেকে বেরিয়ে একটা রিক্সায় চড়ে সোজা সাহেব বাজারের দিকে যেতে লাগলেন। রিক্সায় যেতে যেতে শার্টের বাম পকেটে হাত দিয়ে স্পর্শ করা মাত্রই টাকাগুলোর অস্তিত্ব টের পাওয়ায় তার মনটা তৃপ্তিতে ভরে উঠলো। অনেকদিন ভালমন্দ বাজার করা হয় না। আজ যেহেতু পকেটে অনেকগুলো টাকা আছে তাই অফিস থেকে বেরিয়েই সোজা বাজারের দিকে রওনা দিয়েছেন। প্রতিদিনই রাতে ভাত খেতে বসে রিমি আর খোকার আমিষ শূন্য ভাতের থালার দিকে চোখ যেতেই কষ্টে তাঁর বুকটা ফেটে যেতে থাকে। বাবা হয়ে তাদের পাতে ভালমন্দ কিছু তুলে দিতে পারেন না এরচেয়ে বড় কষ্ট আর কিইবা হতে পারে।

সাহেব বাজারে পৌঁছে রিক্সা থেকে নেমে সোজা মাছের বাজারের দিকে হেঁটে চললেন। অন্যান্য দিন মাছের বাজারে প্রবেশ করে ছোট জাতীয় মাছ কিনতে গেলেও আজ তিনি বড় সাইজের মাছ দেখতে লাগলেন। এভাবে কিছুক্ষণ দেখার পর অবশেষে বড় সাইজের একটা চিতল মাছ পছন্দ হওয়াতে কিনে ফেললেন। এতো টাকা দিয়ে তিনি জীবনে কোনদিন মাছ কিনেছেন কিনা মনে করতে পারলেন না। পরক্ষণেই মাথা থেকে ওসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে মাছের বাজার থেকে বের হয়ে এসে আরও কিছু কাঁচা বাজার করে একটা কুলিকে ডেকে তার ডালিতে কাঁচাবাজার গুলো তুলে দিয়ে সন্তুষ্ট চিত্তে বাড়ির দিকে যাত্রা করলেন।

বাড়িতে প্রবেশ করে রশীদ সাহেব কুলির মাথা থেকে ডালিটা নিজেই নামিয়ে দিয়ে তাকে ভাড়া দিতে দিতেই জোরে হাঁক ছেড়ে উঠলেন, ” কইরে তোরা কোথায় গেলি রে সব? কত কি বাজার নিয়ে এসেছি দেখে যা। কইরে মা রেবেকা কোথায় গেলি? ”

রশীদ সাহেবের হাঁকডাক শুনে বাড়ির উঠোনে সবাই এসে জড়ো হতেই রিমি দৌঁড়ে এসে চিতল মাছটা তুলে বেশ বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
” এই বড় মাছটা তুমি কিনেছো বাবা? ও …মা .. দেখো বাবা কত্ত বড় একটা মাছ কিনেছে! ”
এদিকে খোকাও বাজার থেকে আনা জ্যান্ত মুরগী দুইটা হাতে নিয়ে খুশিমনে রেবেকার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো,
” বুবু , দেখো বাবা কি সুন্দর দুইটা মুরগী কিনে এনেছে! আমি এই মুরগী দুইটা পুষবো কিন্তু! কথাটা বলেই খোকা পরম আনন্দে মুরগীগুলোর গায়ে হাত বুলাতে লাগলো।
খোকার কথা শুনে রশীদ সাহেব একগাল হেসে ছেলের মাথায় স্নেহের হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
” দূর পাগলা এইসব তোদের খাওয়ার জন্য কিনে নিয়ে এসেছি। আজ তোর মা চিতল মাছটা রান্না করুক, কাল নাহয় মুরগীর মাংশ দিয়ে ভাত খাস। ”
কথাটা বলেই একটু দূরে আয়েশা বেগমকে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রশীদ সাহেব বেশ বিরক্ত মুখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ” বোকার মতো হা করে দাঁড়িয়ে থেকে কি দেখছো? যাও, বাজার গুলো তুলে রান্নাঘরে নিয়ে যাও। ” স্বামীর কথা কানে যেতেই আয়েশা বেগম রেবেকার দিকে একবার তাকিয়ে গম্ভীর মুখে হেঁটে এসে কাঁচা বাজার গুলো তুলতে তুলতে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাসা করলেন, ” এতসব বাজার করার টাকা কোথায় পেলে? লটারির টিকিট থেকে পেয়েছো নাকি? ” স্ত্রীর কথা শুনে এক মুহূর্ত থমকে থেকে রশীদ সাহেব একবার কেশে গলাটা একটু পরিষ্ককার করে উত্তর দিলেন, ” আজ রেবুর বিয়ের জন্য অফিসের ফান্ড থেকে লোন তুললাম। ভাবলাম অনেকদিন হলো বাচ্চাদের জন্য ভালো কিছু বাজার করতে পারিনি। তাই অফিস ছুটির পর মনমতো একটু বাজার করে নিয়ে আসলাম। ”
স্বামীর কথা শুনে আয়েশা বেগমের পেশীতে একটু ঢিল পড়লো। তিনি খুশি মনে বাজারগুলো হাতে নিয়ে রেবেকাকে ইশারায় ডাক দিয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে লাগলেন।

রেবেকা মায়ের পিছন পিছন হেঁটে যাওয়ার উদ্দ্যোগ নিতেই রশীদ সাহেব তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
” কিরে মা ওই দিকে আবার কোথায় যাচ্ছিস? বাইরে থেকে আসলাম, আমাকে লুঙ্গি গামছা দিবি না? ”

রেবেকা গম্ভীর মুখে রিমির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ যা, জলদি করে হাতটা ধুয়ে বাবাকে লুঙ্গি গামছাটা এগিয়ে দে। ”
রিমিকে কথাটা বলেই সে বাবার দিকে ফিরে বললো,
” তুমি হাত মুখ ধুয়ে ঘরে বসো বাবা আমি তোমার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসছি। ”

রেবেকার গম্ভীর মুখখানা রশীদ সাহেবের নজর এড়ালো না। তিনি কিছুটা শঙ্কিত মনে ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। তার তিন সন্তানের মধ্যে রেবেকাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসলেও মনে মনে তার ব্যক্তিত্বকে তিনি খুব ভয় করেন। মেয়েটা ঠিক তার দাদীর স্বভাব পেয়েছে। তার দাদীও ঠিক এইরকমই ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। রশীদ সাহেব পৃথিবীতে যদি কাউকে ভয় পেতেন তা একমাত্র তার মাকেই পেতেন। দাদীর ছায়ায় বেড়ে উঠা রেবেকাও ঠিক দাদীর মতোই হয়েছে।
রশীদ সাহেব হাত মুখ ধুয়ে ঘরে এসে বসতেই রেবেকা এক কাপ চা ও পিরিচে করে কয়েকটা বিস্কিট নিয়ে এসে বাবার হাতে দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো। রশীদ সাহেব চা খেতে খেতে মেয়ের দিকে এক নজর তাকিয়ে নরম গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ” কিছু বলবি রে মা? ”

” তুমি আগে চা খেয়ে নাও তারপর বলবো। ”

” যা বলার বলে ফেল। চা খেতে খেতে নাহয় শুনি। ”

” তুমি অফিস থেকে কত টাকা ধার করেছো শুনি? ”

” ওসব জেনে তুই কি করবি রে মা? ”

” না আমার শোনার দরকার আছে। ”

” এই ধর লাখ দেড়েক মতো টাকা তুলেছি। ”

” তুমি একটা কাজ করো বাবা, কাল রমজান ভাইকে সাথে করে নিয়ে গিয়ে বিয়ের সম্মন্ধটা ভেঙ্গে দিয়ে আসো। ”

” তুই এইসব কি বলছিস রে মা? বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে আসবো মানে! কি সব উল্টাপাল্টা বকছিস? ”

” ঠিকই বলছি বাবা। আমি চাই না আমার কারণে আমার ছোট দুইটা ভাইবোন পথে বসুক। কি দরকার এতো কিছু করার। এরকম বিয়ে না করলে কি হয়? তুমি বুকে হাত দিয়ে বলোতো বাবা, এই ধারের টাকা তুমি কতদিনে পরিশোধ করতে পারবে? তোমার চাকরির বয়সই বা আছে কতদিন! এমনিতেই সংসার চালাতে গিয়ে প্রতিমাসেই দেখি তুমি হিমসিম খেয়ে যাও। আর সামনের মাস থেকে তোমার মাইনে থেকে যে টাকা গুলো কেটে নিবে, তখন এই অল্প টাকা দিয়ে কি করে মাসটা পার করবে? একবারও কি সেটা ভেবে দেখেছো? মোট কথা এতগুলো লোকের বুকের উপর দাঁড়িয়ে আমি কারও ঘরে যেতে রাজি নই বাবা। আমার কপালে যা লেখা আছে তাই হবে। ”

রশীদ সাহেব খালি কাপটা টেবিলের উপর রেখে রেবেকার সামনে এসে তার মুখখানা দুই হাতের তালুতে নিয়ে ধরা গলায় বললেন, ” আমি সব সহ্য করতে পারবো রে মা, কিন্তু তোর কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবো না। আমি জানি তোকে পাঠিয়ে দেওয়ার পর আমার খুব কষ্ট হবে। তবুও জেনে রাখ মা, একজন বাবার কাছে এরচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত আর কিছুই হতে পারে না। আমার হয়তো কিছুদিন সংসার চালাতে একটু কষ্ট হবে, সেটা হোক। সারাটা জীবন তো কষ্টই করে আসলাম। নাহয় আরও দুইটা দিন কষ্ট হবে। ও নিয়ে তোকে অতো চিন্তা করতে হবে না। তুই এখন যা। গিয়ে তোর মাকে একটু সাহায্য কর গে যা। খুব ক্ষুধা লেগেছে। রান্না হলে সবাই এক সঙ্গে বসে মজা করে খাবো। ”
বাবার কথা শেষ হতেই রেবেকা চোখদুটো মুছে কাপ পিরিচ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

রাতে খাওয়া দাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে পান চিবুতে চিবুতে রশীদ সাহেব স্ত্রীকে বললেন, ” আলমারিতে পঞ্চাশ হাজার টাকা রাখা আছে। তুমি কাল তাড়াতাড়ি রান্নাবান্না শেষ করে রমজানের বৌকে সাথে করে স্যাকরার দোকানে গিয়ে রেবু মার গয়নার অর্ডারটা দিয়ে আসো। এসব হাতের কাজ। বানাতে অনেক সময় লাগবে। তাই আগে ভাগেই অর্ডার দিয়ে রাখো। যেনো বিয়ের আগেই গয়না তৈরী করে তোমাকে দিতে পারে। আর আসার সময় বিয়ের মেইন জিনিসপত্রের দাম গুলো একটু জেনে এসো। ”

রশীদ সাহেবের কথা শেষ হতেই আয়েশা বেগম একটু ভীতু গলায় জিজ্ঞেস করলো, ” একটা কথা সত্য করে বলোতো, এই এতগুলো টাকা তুমি কি অফিস থেকে তুলেছ না অন্য কারও কাছ থেকে ধার করেছো? আমার কেমন জানি ভয় করছে। ”

” আহ থাম তো। একবার তোমার মাথায় কোন কিছু ঢুকলে তা আর বের হতে চায় না। কাল নাহয় বাড়ির বাইরে গিয়ে নিজেই একবার দেখে আসো কেউ তোমাকে পাঁচটা টাকা দিয়ে সাহায্য করে কিনা? যত্তসব আজগুবি কথাবার্তা। ” কথাটা বলেই রশীদ সাহেব পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন।
(চলবে)

-ফিরোজ চৌধুরী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *