কদম বিলাসী

শহর পরিষ্কার করার লোকজনও তখন ঘর থেকে বের হয় না, যখন ঘর থেকে বের হয় মিতু!! এত সকাল সকাল ঘর থেকে বের হয়েই শুরু হয় তার টিউশনি করা!! এই টিউশনির টাকা দিয়েই সংসার চলে মেয়েটার!! এত কষ্ট করে রোজগার করা টাকা থেকে মাঝে মাঝেই আমার জন্য এটা সেটা কিনে সে!! খুব রাগ হয় আমার!! আবার সেই উপহার না নিলে তার রাগ হয় অনেক!! অবশ্য আজকের এই নীল শার্টটা আমার বিদেশ যাওয়া উপলক্ষে কিনেছে সে, আজ আর রাগ করতে পারি নাই তার উপর, বিদায়ের বেলা রাগারাগি করে সময়টা খারাপ করতে চাই না বলেই অনেক কথা বলা হলো না তাকে!! প্লেনের টিকেট কাটা শেষ, হাতে আছে দুই দিন মাত্র সময়!! অথচ তাকে বলতে পারলাম না আজকের দেখাই মনে হয় আমাদের শেষ দেখা হবে!! কি মুখেই বা দেখা করবো সামনে?? কি মুখেই বা বলবো তাকে?? এত স্বার্থপর আমি কিভাবে হলাম?? মিতুর দিকে তাকালে মায়ের বলা কথা গুলা মনে পরে!! হাতটা ধরে মা আমার কাছে সংসারের দায়িত্ব দিয়ে দিল!! অভাবের সংসার করতে করতে ক্লান্ত মহিলা একটু সচ্ছলের সংসার দেখতে চাইলো আমার কাছে!! শেষ বয়সটায় আর নাকি কষ্ট সহ্য করতে পারছেন না তিনি!! বাবা প্যারালাইজড হয়ে যাওয়ার পর থেকে আমেরিকায় থাকা বড় চাচার পাঠানো টাকাতেই এতদিন আমাদের সংসার চলতো!! বাবার চিকিৎসা, মায়ের সংসার চালানোর খরচ, আমার আর ভাই বোনদের পড়া লেখার সব খরচ চাচাই বহন করেছেন এতদিন!! বড় চাচাই সব ব্যবস্থা করে আমাকে আমেরিকা নিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু শর্ত জুরে দিলেন বলা যায় চাপিয়েই দিলেন তার বড় মেয়ের সাথে আমার বিয়ের!! আমেরিকায় পাত্রের অভাব নাই তবে আমার মত ঘর জামাই মনেহয় পাবেন না আর চাচার বড় মেয়ে শুনেছি কেমন জানি!! বলে সহজ সরল কিন্তু মায়ের মুখে শুনেছি মানসিক সমস্যা আছে তবে ঠিক হয়ে যাবে নাকি একদিন!! চাচার কথার অবাধ্য আমি হতে পারতাম কিন্তু মা বাবা পারেননি!! আমার হাতটা ধরে মা কেঁদে বললেন চাচাকে মানা করলে এতদিন আসা টাকাটা পাঠানোও বন্ধ হয়ে যাবে তখন ভাই বোন বাবা মা নিয়ে কি করবো আমি?? সবে মাত্র পাশ করা আমাকে কেই বা দিবে চাকুরী?? ভাই বোন গুলাকে দেখিয়ে বললেন এদের প্রতি কি কোন দায়িত্ব নাই আমার?? প্যারালাইজড বাবার শরীর নড়ে না কিন্তু চোখ বেয়ে পড়া পানি আমার কাছে কি চাচ্ছে??

-কি বাবু মশাই আমেরিকা চলে যাবেন তাই খুব খুশি?? আমেরিকা গিয়ে সাদা চামড়ার মেয়ে দেখলে আমাকে ভুলে যাবেন না তো আবার??

-মিতু আমি না যাই?? চল তুমি আমি কোথাও চলে যাই!! পাসপোর্টটা ছিঁড়ে ফেলে দেই?? আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না একা একা!!

-বাবু মশাই ইমোশনাল না হয়ে বাস্তব চিন্তা করো!! তুমি সেখানে গেলে কত দ্রুত বড় হইতে পারবা!! টাকা কামাইতে পারবা!! আমিও এই ফাকে সংসারটা একটু গোছাই!! তুমি একটা ভালো পজিশনে গেলে আমাদের কি তখন এত দুঃখ কষ্ট থাকবে বল?? আর যদি সাদা চামড়ার কাউকে বিয়ে করে ফেলো তাহলেতো আর কথা নাই!!

-তখন তুমিও ভালো দেখে কাউকে বিয়ে করে ফেলো!!

-ওহ!! তাহলে সত্যি সত্যি আপনার মনে সাদা চামড়ার মেয়ে বিয়ে করার খায়েশ আছে?? ভালো ভালো!!

-মিতু তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরি?? আমার না খুব কষ্ট লাগছে!!

-দেরী করছো কেন?? কষ্ট বুঝি আমার লাগছে না??

বাড্ডা গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ফারহানা আফরিন মিতুর আজ বাতের ব্যথাটা খুব বেড়েছে!! অবশ্য তিনি আজকে ব্যথা হওয়াতে খুব একটা অখুশি না, কারন আজ শুক্রবার স্কুল বন্ধ!! স্কুল খোলা থাকলে ব্যথা হইলে স্কুল কামাই দেয়া লাগতো যা তার খুব অপছন্দ!! স্কুল প্রধান হয়ে স্কুল ফাঁকি দিলে ছাত্রীরা কি শিখবে তার কাছ থেকে?? অবশ্য ব্যথাটা আরো না বাড়লেই হইলো!! আজ কোন এক ছেলে জানি আসবে তার সাথে দেখা করতে!! দুইবার ছেলেটা এসে ফিরে গেছে তাকে বাসায় না পেয়ে!! তিনি তার বাসায় থাকা তার ভাগনিকে বলেছেন, এরপর ছেলেটা আসলে শুক্রবার আসতে বলবি বিকালের দিকে!! পরিচিত কেউ হলেতো ভাগনির চেনার কথা!! নাকি কোন স্টুডেন্টের গার্জিয়ান হবে!! স্কুলের মেয়ে গুলার কারো রেজাল্ট খারাপ হলে গার্জিয়ান গুলা বাসায় পর্যন্ত চলে আসে বিভিন্ন সুপারিশ নিয়ে সে রকম কেউ হলে দেখাই করবেন না তিনি!!

-আমি রিজওয়ান!! আমি…

-তোমাকে দেখে খুব চমকে গেছি আমি!! ভয়ও পাইছি একটু!! তুমি জহিরের ছেলে ঠিক না?? তুমি দেখতেতো একদম তোমার বাবার মত হইছো!! এত মিল!! ভেতরে আসো!!

-হ্যাঁ!! সবাই বলে এই কথা!! আব্বার আগের একটা ছবি আছে আমার কাছে, আমারও তাই মনে হইছে!! অনেক মিল আব্বার সাথে!!

-তুমিই এর আগে দুই দিন আসছিলে আমার খোঁজে??

-জ্বী, আপনি বাসায় ছিলেন না!!

-কেমন আছো বল?? আমি বাবা স্কুল শিক্ষিকা, সারাদিন স্কুলেই থাকতে হয়!! আজ বন্ধ বলেই ভাগনি কে বলেছিলাম তোমাকে আজ আসতে!! আচ্ছা চা খেতে খেতে গল্প করি কেমন?? চা খাওতো??

-জ্বী চা খাই!! আদা চায়ের সাথে লেবু পাতা আমার খুব প্রিয়!! তবে আপনি চাইলে যেকোন চা-ই দিতে পারেন!!

-যতটুকো মনে পরে তোমার বাবারও খুব পছন্দ ছিল এই চা!! আমার নিজেরও খুব পছন্দ!! গেটের পাশেই আমার একটা লেবু গাছ আছে ওই গাছের পাতা আমি সব চা বানিয়ে শেষ করি!!

-জ্বী, ঢুকতেই দেখেছি গাছটা!! আর আব্বার কাছ থেকেই চা খাওয়া শেখা আমার!! আব্বা সব সময় চা খাওয়ার সময় পিরিচে করে চা দিত আমাকে!! সেই থেকেই চায়ের অভ্যাস আমার!!

-বস তুমি, আমি চা নিয়ে আসি!! কিংবা আমার সাথে আসতে পারো কিচেনে!! ঘুরে দেখ আমার বাসাটা!!

-নাহ আমি এখানেই বসি!!

-চিনি হয়েছে??

-জ্বী পারফেক্ট!! আচ্ছা লেবু গাছটার পাশেই একটা কদম গাছ দেখলাম!! গাছটায় ফুল আসে নাই?? এখনতো কদমের সময়!!

-সবাই বলে গাছটা নাকি বাঁজা!! তাই ফুল দেয় না!! তবে আমার কেন জানি মনেহয় একদিন এই গাছে ঠিক ফুল আসবে!! গাছ ভেঙ্গে যাওয়ার অবস্থা হবে কদমের ভারে!!

-আব্বার খুব প্রিয় ছিল কদম ফুল!!

-হুম পাগল হয়ে যেতো তোমার আব্বা কদম ফুল দেখলে!! গাছে যখন ঝাঁকে ঝাঁকে কদম ফুঁটে থাকতো সে বলতো, দেখ মনে হচ্ছে শত শত সূর্য আলো ছড়াচ্ছে!! বর্ষার পানি মাখা কদমে সূর্যের আলো পরলে সে রকমই লাগে!! আচ্ছা তোমার বাসার সবাই কেমন আছে?? তোমার বাবা, মা, ছোট বড় ভাই বোন কেউ আছে তোমার??

-সবাই ভালো আছে!! আমার ছোট একটা বোন আছে!! আপনার বাসায় কে কে থাকেন?? আপনার ছেলে মেয়ে??

-আমার মেঝো ভাইয়ের মেয়েটা থাকে আমার সাথে!! এখানে থেকেই ভার্সিটিতে পড়ে!! তুমি দেখেছিলে তাকে!! সেই তোমাকে আজ আসতে বলেছে!! আর ছোট ছোট ভাই বোনের দায়িত্ব ছিল আমার ঘাড়েই!! মাতো মারা যান অনেক আগেই!! বাবা অসুস্থ ছিলেন অনেক দিন!! পরে এক সময় তিনিও চলে যান ভাই বোনের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে দিয়ে!! দায়িত্ব পালন করতে করতে একসময় দেখি চুলে পাক ধরেছে!! তাই আর সংসার করা হয় নাই!! এভাবেই বেশ ভালো আছি!!

-আব্বার একটা চিঠি ছিল আপনার নামে!!

-তুমিতো আমাকে আবার চমকে দিলে ছেলে!! এই বয়সে তোমার বাবা আমাকে চিঠি দিল?? এত বছর পর?? কত হবে?? ছাব্বিশ বছর ছুঁই ছুঁই মনে হয়!!

-আমার আব্বাকে আপনি ক্ষমা করে দিবেন প্লিজ!! আব্বার উপর আপনার অনেক ক্ষোভ তাই না??

-তুমি তোমার বাবার আমার কথা জানো সব?? একটা সময় যে অনেক ক্ষোভ কষ্ট রাগ ছিল না, তা না!! অনেক কষ্ট হইতো আমার!! একবার আমাকে বললেই পারতো!! একবার আমাকে বলে গেলেই পারতো!! জানো আব্বা মারা যাওয়ার সময় আমার পাশে কেউ ছিল না!! কোন সান্তনার হাত আমার মাথার উপর ছিল না!! অথচ তোমার বাবার থাকার কথা ছিল আমার পাশে!! অনেক কষ্ট হইতো আমার!! ঘরে কাঁদতেও পারতাম না ছোট ভাইবোন গুলার মাঝে!! ভাই বোন গুলা ঘুমিয়ে পরলে একা একা চলে যেতাম ছাদে!! সবাই ঘুমে রাত পার করতো আর আমি চিৎকার করে কেঁদে!! কেন আমাকে আবার সেই পুরানো কথা মনে করালে বাবা?? কেন সেই পুরানো কষ্ট গুলা নতুন করে দিতে এলে??

-জানেন আমার আব্বা আপনাকে খুব মনে করতেন!! খুব অপরাধবোধ কাজ করতো আব্বার ভেতরে!! খুব ইচ্ছে ছিল একবার আপনার মুখোমুখি হবেন!! বলবেন, একপাশে ছিল বাবা মা ভাই বোনের উপর দায়িত্ব, তাদের ভবিষ্যৎ আর আরেক পাশে ছিলেন আপনি!! কিন্তু আপনার মুখোমুখি হতে ভয় ছিল খুব!! ছিল খুব লজ্জা!! আমার মা খুব সহজ সরল ছিল বলে আব্বার কোন কাজে কখনো বাধা দেয় নাই, আর মায়ের উপর কোন ক্ষোভ ছিল না আব্বার!! ক্ষোভ ছিল দায়িত্বের উপরে!! ক্ষোভ ছিল পরিবারের উপরে!! তবুও ক্ষোভ মনেই দায়িত্ব পালন করে গেছেন ভাই বোন বাবা মায়ের!! দায়িত্ব পালন করে গেছেন সংসারের তবে নিজের ভালোবাসা ত্যাগ করে!! বছর পাঁচেক আগে আব্বা দেশে চলে আসেন!! তার নাকি আমাদের মাঝেও খুব একা একা লাগতো!! আমেরিকা নাকি অসহ্য লাগছিল তার কাছে!! আব্বা চলে আসলেও আমরা আমেরিকাতেই ছিলাম!! আমি মাঝে মাঝে দেশে আসতাম আব্বার সাথে দেখা করতে!! শেষ বছর যখন আসি আব্বা বলল, খোকা একটা চিঠি দিবো তোকে একজনের কাছে পৌঁছে দিবি তবে এখন না, সময় হলেই বলবো তোকে!! আর যদি কখনো বলতে না পারি তাহলে তুই পৌঁছে দিস চিঠিটা সময় করে!! চিঠিটা হাতে দিয়েই আপনার গল্প করলো আমার কাছে!! আব্বা আমার হাতটা ধরে বললেন, জানিস খোকা আমার খুব কষ্ট হয়!! আমার খুব লজ্জা করেরে!! নিজেকে খুব ছোট লাগে!! যখন চলে আসি মেয়েটার আমি ছাড়া কেউ ছিল নারে!! খুব করে বলেছিলাম, আমি তোমার পাশে থাকবো সারা জীবন!! আমি পারি নাই বাবা!! তুই আমার হয়ে তার কাছে ক্ষমা চাইবি, তার মুখোমুখি হতে আমার খুব লজ্জা করেরে!! আমার আব্বার খুব কষ্ট হইতো!! খুব চেষ্টা করলাম আবার আমেরিকা নিয়ে যাওয়ার কিন্তু তিনি রাজি হলেন না!! আব্বা সবসময় একটা স্বপ্নের কথা বলতো আমাকে, বলতো, জানিস খোকা একদিন বিশাল যায়গা নিয়ে একটা কদমের বাগান করবো!! শত শত কদমের মাঝে একটা ঘর বানাবো!! তুই খালি একবার ভেবে দেখ বর্ষায় শত শত কদম ফুলের মাঝে বাপ বেটা বারান্দায় চেয়ারে বসে চা হাতে গল্প করছি আর বৃষ্টি দেখছি!! বুঝছিস আমি মরে গেলে তুই আর তোর বউ মিলে গল্প করতে আসবি সেই কদম বাগানে!! বাগানের মাঝে ঘর করা আর হয়ে উঠে নাই আব্বার!! তবে বাগান ঠিক করেছিলেন!! সে কদম বাগানে এখন ঝাঁকে ঝাঁকে কদম ফুটেছে!! বাগানে শত শত কদমের মাঝেই আব্বার কবর দেই!! জানেন আমার আব্বার খুব কষ্ট হইতো!! অনেক অপরাধ বোধ ছিল, লজ্জা ছিল!! আমার আব্বাকে আপনি ক্ষমা করে দিবেন প্লিজ!! আমার আব্বাকে আপনি ক্ষমা করে দিবেন প্লিজ!!

ছেলেটা চলে যাচ্ছে!! খুব ইচ্ছে করছে ডেকে বলি আমি তোমার বাবাকে অনেক আগেই ক্ষমা করেছি ছেলে!! খুব ইচ্ছে করছে তার চোখটা মুছে কপালে একটা চুমো দেই!! সে আমার জহিরের সন্তান তাকে ডেকে একটু নাহয় জড়িয়ে ধরি??

মিতু কেমন আছ তুমি? জানি দায়িত্ব পালন করতে করতে খুব ক্লান্ত তুমি!! মনে আছে একটা কদম বাগানের স্বপ্ন দেখতে তুমি?? সংসার করতে করতে ক্লান্ত তোমার আমার সেই বাগানে একটা ঘর করে বিশ্রামের কথা ছিল!! কথা ছিল বৃষ্টি হলে চা হাতে গল্প করতে করতে সারারাত পার করবো সেই বাগানে তুমি আর আমি!! আমি না একটা বাগান করেছি কদমের!! খুব ইচ্ছে ছিল একটা ঘর করবো এই বাগানের মাঝে!! কিন্তু সেই ঘর বানানোর সময় আমার হাতে আর নেই!! যদি কখনো সময় হয় আমার কদম বাগানে আসবে তুমি?? যদি কখনো ক্ষমা করতে পারো আমাকে, এসে ঘুরে যেও আমার কদম বাগানটায়!! আমি এখন এই বাগানেই মিশে আছি!!
ইতি
জহির!!

আজ বহু বছর পর কানের কাছে চুলে পাক ধরা মিতু কিশোরীদের মত কেঁদে যাচ্ছে!! মধ্যরাতের স্তব্ধ নগরীতে ছড়িয়ে যাচ্ছে তার চিৎকার!! বাঁজা কদম গাছটায় কি ফুল এসেছে নাকি?? নাহয় আজ কেন বাতাসে এত কদমের সুবাস?? নাকি এ সুবাস ভেসে আসছে দূরে কোথাও কোন কদমের বাগান থেকে??

-মোঃ ফজলে খোদা রায়হান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *