একটি নাকফুলের গল্প ( ৪র্থ পর্ব )

বিয়ে করার পরে শিমুল সেদিন বিকেলেই আমাকে গ্রামে নিয়ে আসে। মেসে থাকাতো কোনভাবেই সম্ভব নয় আমারপক্ষে, আবার শহরে বাসা নিয়ে থাকাটাও ছিল সাধ্যের বাইরে সেই সময়। গ্রামে শিমুলের পুরো পরিবার থাকে। ভীষণ সুন্দর একটা একান্নবর্তী সুখী পরিবার তাদের। বাবা মা, কলেজে পড়া একটা ভাই আর স্কুলে পড়ুয়া ছোট বোন এবং আরো আছেন ঘরের মায়ার এক বিশাল খুঁটি দাদি। গ্রামে আসার পর শিমুলের বাবা আমাদের দুজনকে ডেকে বসায়। শিমুলের মা আর দাদিও ছিলেন সেদিনের সেই পারিবারিক বৈঠকে। বাবা গম্ভীর স্বরে আমাদের উদ্দেশ্যে বলেন,

“তোমরা যা করেছ, তোমরা কি মনে কর যে ঠিক করেছ? জীবনটা অদ্ভুত একটা লম্বা একটা রাস্তা। আঁকাবাঁকা, ছোট বড় গর্তওয়ালা একটা রাস্তা। এই রাস্তায় ভেবেচিন্তে নামতে হয়”। তারপর তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “ মা, এখনো সময় আছে। তুমি চাইলে ফিরে যেতে পার। আমি নিজেই তোমাকে দিয়ে আসব তোমার পরিবারের কাছে। আমার ছেলের হয়ে আমি তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিব। আমি চাইনা ছোট্ট একটা আবেগের কারণে তোমার পুরো জীবনটা ধ্বংস হয়ে যাক”! আমি বাবাকে ছোট্ট করে সেদিন বলেছিলাম, “আমার সারাটা জীবনটা গিয়েছে বুকভরা হাহাকার নিয়ে। সবকিছু থাকার পরও আমার কিছু ছিলোনা। আমার বাবা মা যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন কিন্তু কারো সংসারে বা বুকে আমার জন্য এতটুকু স্থান ছিল না! ছোট্ট একটা কামরা কেউ আমার জন্য দিতে পারেননি তাদের সুখ দুঃখের সংসারে!! আমি বাবা মা, ভাইবোন ভরা একটা সংসার খুঁজেছি এবং আমি পেয়েছি এতদিন পর। কেন আমি তাদের ছেড়ে যাব!! আমি কোথাও যাব না”। আমি জানিনা আমার কণ্ঠে কি এমন ছিল। আমার কথা শেষ হবার সাথে সাথে দাদি আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বলেন, “তোর কোথাও যেতে হবেনারে পাগলী। তুই আজ থেকে আমার ভাঙা ঘরের লক্ষ্মী”।

সেদিন থেকে আমি একটা ছায়া আর মায়া দিয়ে তৈরি কাঁচাপাকা ঘরের মায়া মায়া একদল মানুষের একজন হয়ে গেলাম। বাবা আমাকে “মা” ডাকতে শুরু করলেন। মা আমাকে অসীম এক মমতা মাখা কণ্ঠে “এটা কর, ওটা কর” বলে সংসার শিখাতে শুরু করলেন। দাদি কথায় কথায় বিড়বিড় করে দোয়া পড়ে পড়ে মাথায় ফু দিয়ে দোয়া করতে শুরু করলেন। রাতুল আর রাসু আমাকে ভাবি ভাবি বলে তাদের একজন করে নিলো এক নিমেষেই!! আমার চব্বিশ বছরের জীবনের প্রথমবারের মত আমি পৃথিবীটাকে অসম্ভব রকমের সুন্দর মনে হতে লাগল! দাদির পাশে উনার জায়নামজে বসে হাজার বছর যেন এই মানুষগুলোর কাছে বেঁচে থাকতে পারি, সেই প্রার্থনা করতাম সৃষ্টিকর্তার কাছে। আমার মামা আর বাবা একদিন আমাকে দেখতে আসে। মামা আমাকে বলেন, উনারা আমাকে নিয়ে যেতে এসেছেন। বাবা বলেন, শিমুল চাইলে উনি একটা ভাল চাকুরীর ব্যবস্থা করে দিবেন। এই জীর্ণ অবস্থায় আমাকে দেখে উনারা স্বস্তি পাচ্ছেননা। আমাকে নিয়ে উনাদের শত শত হতাশা আর কষ্টের কথা বলতে লাগলেন মামা আর বাবা। আমি সব শোনার পরে দুজনকে একটা কথাই স্পষ্ট করে বলেছিলাম শুধু, “আমি আকাশে ওড়ার স্বপ্ন দেখিনা ধপ করে পড়ার ভয়ে! আমি শব্দহীন ব্যাথাকে ভয় পাই। আমি মাটির সাথে দোস্তি রেখেই আকাশ দেখতে স্বস্তি পাই”। বাবা আকুলভাবে আমাকে বুঝাবার চেষ্টা করলেন, “আমরা তোমার সুখের কথা চিন্তা করছি। এখানে, এই পরিবেশে তুমি সুখী হতে পারবেনা”। আমি বাবাকে কঠিনভাবে বলতে চেয়েছিলাম, “আমার সুখের জন্য তোমরা কোনদিন ভাবোনি। তোমরা সারাটা জীবন শুধু তোমাদের কথাই ভেবেছ! এখনো তোমাদের সামাজিক স্ট্যাটাসের কথা নিয়েই তোমরা চিন্তিত, আমাকে নিয়ে নয়! তুমি যখন তোমার সংসারে তোমার বাচ্চাদের হাতে ধরে ছবি আঁকা শিখাতে তখন কি একবারও মনে পড়ত, ঠিক সেই বয়সটাতে আমি মামার ঠিক করা আর্ট টিচারের কাছে ড্রয়িং শিখতাম! তুমি যখন স্কুল ছুটির পর স্কুল গেঁটে দাঁড়িয়ে তোমার বাচ্চাকে বাসায় নেবার জন্য অপেক্ষা করতে, তখন কি একবারও মনে পড়ত তোমার, আমি প্রতিদিন ড্রাইভার মামার সাথে স্কুল থেকে ফিরতাম!! আমার বুকের হাহাকারের এই বিশাল সমুদ্র কি একদিনের”!! আরো কত লক্ষ, হাজার অভিমান আর অভিযোগের পাহাড় জমে ছিল আমার বুকের মাঝখানটায়, বাবা আর মা কে বলার জন্য! কিন্তু কিছুই বলা হয়না আমার। আমি শুধু বলি, “আমার যা কিছু দরকার সবকিছুই এখানটায় আছে। আমি সুখেই থাকব। আমার আর কিছু বলার নাই”। বাবা আর মামা সেদিন খালি হাতে ফিরে যায়। আমি আমার সংসার নিয়ে ভীষণ রকমের ব্যস্ত হয়ে পড়ি। মা আর দাদির কাছে রাত দিন সংসার কি শিখতে শিখতে আমি শিখে যাই, জীবন মানে মানিয়ে চলা অথবা মানিয়ে চলতে চলতে একসাথে সুখী হওয়া! আমি প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে শিখতে থাকি, জীবন মানে অপূর্ণতার মাঝে পূর্ণতার স্বাদ খুঁজার চেষ্টা করে যাওয়া! প্রতিদিনই মায়ের হাত ধরে সংসার করতে গিয়ে কত শত অদ্ভুত জিনিস আমি শিখতে থাকি! আমার মনে হতে থাকে, একটা মধ্যবিত্ত সংসার হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে বড় পাঠশালা! একদিন ঘরে বাজার না আসলে আমার শাশুড়িমা কত সুন্দর এবং হাসিমুখে সেই অপূর্ণতাকে উপভোগ্য করে তুলতেন দেখে দেখে আমি শুধুই অবাক হতে থাকি! মা বলত, প্রতিদিন পেঁয়াজ রসুন দেয়াটা জরুরী নয় রান্নাতে। পেঁয়াজ আর রসুন বিহীন তরকারি পাঁচফোড়নে বাগাড় দিয়ে অসাধারণ স্বাদের আর ঘ্রাণের তরকারি বানাতেন উনি! আমি শুধু মুগ্ধ আর অবাক চোখে দেখে দেখে ভাবতাম, ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি মামি পেঁয়াজ রসুন আর নানান গন্ধের, নানান বর্ণের মসলা ছাড়া প্রতিদিনের রান্নার কথা ভাবতেই পারতেননা! মা হাসিমুখে কি ভীষণ ব্যস্ত ভাবে সংসারকে উপভোগ করতে দিনরাত!! বাড়ির উঠোনে নানারকমের শাক সবজির বাগান করতেন, ঘরের পিছনটায় হাঁস মুরগীর যত্ন করতেন, অলস দুপুরটাতে নিপুণ হাতে সুই সূতোর নকশা আঁকতেন কাঁথায়। কি এক অপূর্ব শান্তি দেখতেও! আমি শুধুই ভাবতাম! নিজের বাগানের তাজা সবজির তরকারির সাথে প্রতিদিন গরম ভাতের পাতে হাতে চটকানো ভর্তাও তুলে দিতেন মা। অপূর্ব স্বাদের সেই ভর্তাটি উনি বানাতেন সেদিনের সেই সবজিরই খোসা দিয়ে। একটা পরিবার মানে সামান্য খেতে বসেও যে একটা স্বর্গীয় আনন্দ উপভোগ করা সেটা আমি আবেগাপ্লুত হতে হতে দেখতাম! গরমের দুপুরগুলোতে ঠাণ্ডা মাটির মেঝেতে পাটি পেতে ভাতঘুমে যখন আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসতো, তখন মা আর দাদি পালা করে মাঝে মাঝে আমাকে ঘুমন্ত ভেবে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতেন। আমার তখন বুক ফেটে কান্না আসত। লুকিয়ে চোখ মুছতে মুছতে আমি নিজেকে প্রশ্ন করতাম তখন, লাখ টাকার এসির বাতাস কি দিতে পারে এই মায়াভরা শান্তির শীতল বাতাস!! না পারেনা। সংসার এক ভয়ংকর সুন্দর মায়ার বন্ধন যদি সংসারের মানুষগুলো একজন আরেকজনের না বলা কথাগুলো বুঝতে পারে।

ভয়ংকর রকমের সুন্দর এক মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে যেতে যেতে আমিও সংসারী হয়ে উঠতে থাকি। আমি শিখে যাই কিভাবে তেল নুন মরিচের আধিক্য ছাড়াও তৃপ্তি নিয়ে চেটেপুটে খাওয়া যায়, কিভাবে বিলাসিতা থেকে গা বাঁচিয়েও মাথা উঁচু করে সমাজে সুখী হওয়া যায়! কিভাবে অসহ্য গরমের দুপুরগুলোতেও মাটিতে শীতলপাটি পেতে আরামে ভাতঘুম দেয়া যায়! আমি শিখে যাই, কিভাবে কনকনে শীতের সকালগুলোতে চুলোর পাশে বসে মমতা ভরা ধোঁয়া ওঠা পিঠার সাথে সাথে জীবনের উষ্ণতাও নেয়া যায়! আমি ভীষণ রকমের সংসারী হওয়া শিখতে থাকি। আমি বাবা আর মায়ের সাথে সাথে বাড়ির পাশের খোলা জমিতে সবজি ফলানো শিখতে থাকি। একসময় বাবার উপদেশ অনুযায়ী গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে চাকুরীর জন্য আবেদন করি। আমার গা ভর্তি দামি কোন গয়নাগাটি হয়ত থাকেনা, আমার পরনে হয়ত সাদামাঠা সূতির শাড়ি জড়ানো থাকে, কিন্তু আমার মাথার উপরে একটা বিশাল ছাতা নিয়ে একজন পিতা থাকেন জীবনে এগিয়ে চলার উপদেশ দেবার জন্য। একটা মমতাময় হাত থাকে গরম ভাতের পাশে চামচে করে ডিমের ঝোল তুলে দেবার জন্য। একটা অভিজ্ঞ মুখ থাকে দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পাওয়া মলিন মুখে ফু দিয়ে ভয় উড়িয়ে দেবার জন্য। একজোড়া ভাইবোন থাকে সাধারণ সব গল্পকে হাসি আর খুনসুটি দিয়ে অসাধারণ করে তোলার জন্য। একজন ভালবাসার মানুষ থাকে চোখ বন্ধ করে চুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে ভালবাসার জন্য!!

সোনাদানার গয়নাগাটি অথবা হীরাজহরত না থাকুক, আমার সংসারের জন্য আমার মুখে তৃপ্তিময় হাসিতো লেগে থাকে! আমার আরো থাকে, আমার লাল নীল সংসারের সুখগুলো সব বুকে নিয়ে আলো করে থাকা অমূল্য একটা সাত পাথরের নাকফুল।

-তাসলিমা শাম্মী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *