একটি অমিমাংসিত রহস্য ( ১ম পর্ব)

ছপ ছপ শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো রাজিবের। মনে হচ্ছে কে যেনো ভেজা পায়ে হেঁটে আসছে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে তাই যে আসছে সে নিশ্চিত ভিজে এসেছে। কিন্তু এতো রাতে এখানে কে আসবে। এই বাংলোটা শহর থেকে বেশ দূরে। অজপাড়া গাঁ বলা যায়। এটা একটি পরিত্যক্ত চা বাগানের বাংলো। হিন্দু সম্পত্তি, বহুদিন একজনের দখলে ছিল। বর্তমান সরকার সম্পত্তিটা উদ্ধার করলেও কোনো সুযোগ্য লোক খুঁজে পায়নি এটার দায়িত্ব দেয়ার জন্য।
তাই বাগানটা এক প্রকার পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এই বাংলোটা আপাতত জেলা পুলিশ মাঝে মাঝে ব্যবহার করে। তদন্তে আসা অফিসাররা এটাতে রাত্রি যাপন করেন। মাদক চোরাচালানের একটা তদন্তে এখানে এসেছে রাজিব। গত তিন মাসে চার টি খুন ও দুটি নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে অত্র এলাকায়। নিখোঁজের তালিকায় একজন সাংবাদিক ও একজন পুলিশ অফিসার আছেন। সন্দেহের তীর এই এলাকার চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমানের উপর। কিন্তু তার চলা ফেরা উঠাবসায় তা কোনো ভাবেই প্রমান করা সম্ভব না। অত্যন্ত জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি তিনি।। গত তিন তিনবার বলতে গেলে প্রায়  বিনা  প্রতিদন্ধিতায় জয় পেয়েছেন। এখানকার  সব শ্রেণীর মানুষই এই সুপুরুষ, মিষ্টভাষী ও অমায়ীক মানুষটিকে অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা করে। বয়স খুব একটা বেশি নয়, অথবা তার শারীরিক গঠনই এমন যে তাকে যুবকই মনে হয়। তিনি এই এলাকায় একাই থাকেন, স্ত্রী সন্তান সবাই দেশের বাইরে। তিনিও থাকতেন। হঠাৎ কি খেয়াল হলো জনসেবা করবেন। তাই তার এখানে বসবাস। সচরাচর জন প্রতিনিধিদের যে বদনাম থাকে এটা তার নামে নেই, উল্টো সরকার দুটাকা দিলে তিনি তার কাছ থেকে উল্টো আরও দুটাকা বাড়িয়ে দেন। এই অজপাড়াগাঁয়ে যথেষ্ট উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। তাই এখানকার মানুষ তার উপর বেজায় খুশী। তার নামে কোনো কিছু বললে এ এলাকার কাক পক্ষীও বিশ্বাস করবে না। সমস্যা টা এখনেই।
রাজিব এখানে এসেছে দুদিন হলো। এই দুদিন সে শুধু এলাকাটা ঘুরে বেরিয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে খুব শান্ত জনপদ মনে হলেও কোথাও যেন একটা অস্বাভাবিকতা লুকিয়ে আছে।
এই বাংলোটার চারপাশ জঙ্গল হয়ে আছে অথচ কোনো জংলী জানোয়ারের কোনও আওয়াজ পাওয়া যায়না। এমন কি শেয়ালের একটা ডাক শোনেনি এখন পর্যন্ত। এ বাংলোটা দেখাশোনা করে এখানকারই একজন। নাম তার সুরেন্দ্র। একসময় এই বাগানেই কুলির কাজ করতো। বয়স হয়েছে, তবে এখনও শক্তপোক্ত শরীর।সে ই এই বাংলো দেখাশোনা করে, যে আসে রেঁধেবেড়ে খাওয়ায়। লোকটা যেহেতু স্থানীয় তাই রাতে এখানে থাকতে চায়না।একটা মেয়ে আছে ঘরে। মেয়েটাকে সাথে নিয়েই বুড়োটা আসে। মেয়েটা রান্নাবান্নায় বাবাকে সাহায্য করে। রাতে খাওয়া হলে সবকিছু গুছিয়ে বাপ মেয়ে দুজনে বাড়ী চলে যায়। আজও দুজনে চলে গেছে তবে একটু তাড়াতাড়ি কারন সন্ধ্যা থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। আটটা নাগাদ খাওয়া হয়ে গেলে রাজিব নিজেই ওদের বাড়ী চলে যেতে বলেছে। এদিকে সরকারী বিদ্যুৎ নেই, পল্লি বিদ্যুৎ। কখন আসে, কখন যায় তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। ওরা দুজন চলে যাবার পর চারদিক আরও নীরব
হয়ে যায়। ধুমপানের অভ্যাস কখনও করা হয়নি তাই একাকী এই মুহূর্তগুলোতে খুব বিপদে পড়ে যায় রাজিব। রুমে ঢুকে ল্যাপটপ নিয়ে বসে পুরো ব্যাপারটি খতিয়ে দেখার জন্য।
চারজন খুন হলো গত অাটমাসে, দুজন নিখোঁজ। সম্ভবত এই দুজনের কোনো খোঁজ হয়তো আর মিলবে না। তার মানে দাঁড়ালো ছয়জন। এই ছয় জনের মধ্যে একজনের পেশার সাথে অন্যজনের কোনো মিল নাই। পুলিশ অফিসার ও সাংবাদিক বাদে চারজনই এলাকার লোক। এরা কারো সাতেপাঁচে থাকত না। এদের খুনের মোটিভ কেউই বলতে পারেনি, কারন এরা এতোই নিরীহ ছিল যে এদের সাথে কারো কখনও ঝগড়াও হয়নি। সাংবাদিক ছেলেটিও ছিল একটি অখ্যাত পত্রিকার সাংবাদিক। তবে যেহেতু সাংবাদিক তাই তার হারিয়ে যাওয়াটা একটু আলোড়ন তুলেছিল পুলিশ মহলে। তার আগের পুলিশ অফিসার সেটা তদন্ত করতে এসেছিল। দিন দশেক এখানে কাটিয়ে ফিরে গিয়েছিল হেডঅফিসে।।ছেলেটি রাজিবের আন্ডারে কাজ করতো। খুবই মেধাবী। এটাই ছিল তার প্রথম কাজ। ফিরে গিয়ে বলেছিল যার দিকে সন্ধেহের তীর তার কথা বলা যাবেনা, এলাকার লোক ছিঁড়ে খাবে। সবগুলো খুনই একসুত্রে গাঁথা। এ  খুন গুলো শুধু শুধু হয়নি এর পেছনে আরও বড় ব্যাপার আছে। বলেছিল আমি কাজগুলো গুছিয়ে এনেছি আর অল্প একটু বাকী। এটুকু শেষ হলেই আপনার সাহায্য লাগবে স্যার। এক দুদিনের ব্যাপার। সেই এক দুদিন আর আসেনি। যাওয়ার পথে এই বাগানেই ওর জিপটা দুর্ঘটনায় পড়ে। কিন্তু ওকে আর পাওয়া যায়নি।
যেহেতু তার আন্ডারের অফিসার তাই এই দায়িত্ব আর কাউকে না দিয়ে নিজেই এসেছে রাজিব। এই মামলার তদন্তে।
ছপ ছপ পায়ের শব্দটা এসে থামলো তার দরজার বাইরে। তারপর টোকা পড়লো দরজায়।

চলবে…….

-জাহেদা মিমি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *