“একজন বীরাঙ্গনা” ( ২য় এবং শেষ খন্ড)

৫.

রাতে বালিশ নিয়ে জয়নব বেগমের পাশে চুপচাপ শুয়ে পড়ল নিতু।

‘তুই আইজ সকালেও অই বাড়িতে গেছিলি? আমি মানা করছিলাম তরে।’ জয়নব বেগমের গলায় স্পষ্ট অসন্তুষ্টি।

নিতু উঠে বসল, ‘ভয় পাও তুমি, গেলে কঠিন সত্য জেনে যাব তাই?’

জয়নব বেগম আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে রইলেন।

‘জেনেছি আমি, সব জেনেছি। যুদ্ধের সময় দাদাজান কী করেছেন, সব জেনেছি।’

‘চুপ থাক। কে কইছে এইসব তোরে?’

নিতু একটা কথাও বলল না আর, দীর্ঘ সময়ের নীরবতা আর গভীর নিঃশ্বাস জানান দিল, ঘুমিয়ে গেছে সে। জয়নব বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি জানতেন, এই সত্য একদিন সামনে আসবে। মনের জোর কমে যাচ্ছে আজকাল, মনের জোর টিকে থাকে শরীরের ওপর। শরীর দুর্বল হচ্ছে ক্রমশ।

পুকুর ঘাটে বসল নিতু, বেশ কুয়াশা চারদিকে। ঠান্ডা লাগছে তার। ‘এত সকালে পুকুরঘাটে কী করছ?’ জামি এসে বসল পাশেই।

‘কিছু না, ঘুমভেঙে গেল সকাল সকাল; তাই।’

‘তুমি কি কোনো কারণে চিন্তিত? গতকাল বিকেল থেকে দেখছি কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে আছ। কোনো সমস্যা?’

‘একটা অদ্ভুত বিষয় কি জানেন? সৃষ্টিকর্তা আমাদের জীবনের প্রতিটি বিষয় অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ঘটান, আমরা হয়তো লক্ষ্য করি না বলে বুঝতে পারি না। সূক্ষ্ম ভাবে খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন বিষয়টা; সেটাই ভাবছিলাম এতক্ষণ।’

কপালে ভাঁজ পড়ল জামির, ‘বুঝলাম না! আমি সোজাসুজি কথা বলি নিতু, এরকম ভাববাচ্যের কথা ঠিক বুঝতে পারিনা।’

নিতু হাসল, ‘জামি সাহেব, আমি ভয়ঙ্কর অস্থিরতায় আছি, বিষয়টা একান্তই আমার পারিবারিক। আপনাকে বলা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না। কিন্তু আমি এই মানসিক চাপ নিতে পারছি না। কাউকে বলা দরকার।’

‘তুমি নির্দ্বিধায় বলতে পার। কথা দিচ্ছি বলবনা কাউকে।’

এক নিঃশ্বাসে সব বলে গেল নিতু, হাফ ধরে গেছে তার। জামি চুপ করে রইল বেশ কিছুক্ষণ, ‘গতকাল সকালে যে আমগাছটার নিচে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম, ঐ বাড়িটা, তাই না?’

‘হ্যাঁ , ঐ বাড়িটাই। যেবু ফুপু কী যে সুন্দর! জানেন? এত মায়া তার চোখে!’

হাসল জামি ‘তোমার চোখেও অনেক মায়া, নিতু। চল, আর একজোড়া মায়ার চোখ দেখে আসি। আজকের সকালটা শুরু হোক মায়াময় বিহ্বলতা নিয়ে।’

নিতু হাসল, ‘কী সুন্দর বাংলা বলেন আপনি!’

দ্বিধা কাটিয়ে দরজায় হাত রাখল নিতু, মৃদু টোকা দিল দুবার, ‘ভালো আছ, ফুপু?’

‘কী হয়েছে। তুমি এ সকালে?’ যেবু আতঙ্কিত কিছুটা।

‘তোমার কাছে এসেছি। ভেতরে বসি? উনি বাবার ছাত্র। দেশের বাইরে থাকেন। আমাদের সঙ্গে এসেছেন।’

দরজা থেকে সরে দাঁড়াল যেবু, চুপচাপ কেটে গেল অনেকক্ষণ। নিতু বুঝতে পারছেনা ঠিক কী বলা উচিত, অদ্ভুত আবেগে গলার কাছটা শুধু আটকে যাচ্ছে বারবার। যেবু হাত ধরল, ‘কাঁদতেছ কেন, নিতু মা?’ গলা শুকিয়ে যাচ্ছে যেবুর। সে ক্যামেরা হাতে ভদ্রলোকের দিকে অস্বস্তি নিয়ে তাকাল একবার।

‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব? দেশ স্বাধীন হবার পর কোথায় চলে গিয়েছিলেন আপনি, কেনই বা গিয়েছিলেন? এখানে থাকলে তো বাবার সঙ্গে দেখা হতো আপনার।’

যেবু খানিকটা অপ্রস্তুত, ‘এসব কথা কে বলছে তোমারে? যাও, বাড়ি যাও, তুমি। আমি কোনো জটিলতা চাই না, কেন এসব জানতে চাও! আর তোমার মায়ের কথা ভাবো, জীবনের এই পর্যায়ে এসে সে যদি এসব জানতে পারে তখন তার মনের অবস্থা কী হবে? তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে, তোমার কাছে অনুরোধ এসব কথা নিয়ে নাড়াচাড়া করবা না। তাতে সমস্যা বাড়বে। কথা দাও আমারে।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিতু উঠে দাঁড়াল, ‘যাচ্ছি আমি।’

‘আবার এসো নীতু।’

দরজায় পা দিয়ে পেছন ফিরল, ‘আমি কি একবার আপনাকে জড়িয়ে ধরতে পারি ফুপু ?’

ধরে থাকা চেয়ারের হাতলটাকে আরও শক্ত করে চেপে ধরল যেবু, সংযত থাকবার দীর্ঘদিনের অভ্যেসটা আজ কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বারবার। নিতু জড়িয়ে ধরল তাকে, উত্তাল হলো আবেগ। যেবু আজ আর পারল না নিয়ন্ত্রণের শক্ত প্রাচীরে নিজেকে আটকে রাখতে, আবেগাচ্ছন্ন হলো জামিও। কিছুক্ষণের জন্য সে ভুলেই গিয়েছিল এই অতি অসাধারণ মুহূর্তটাকে ফ্রেমে বন্দি করতে।

খালিদ সাহেব খুবই উদ্বিগ্ন। জামিকে দেখেই এগিয়ে গেলেন, ‘জামি, কিছুক্ষণ আগে টিচার্স ক্লাব থেকে ফোন এসেছিল। বড় ধরনের একটা ঝামেলা হয়েছে ডিপার্টমেন্টে। কাল সকালেই যেতে হবে আমাকে। উপায় নেই।’ বেশ আহত গলায় বললেন তিনি।

‘অসুবিধা কী? কাল সকালেই রওনা হব আমরা।’

খালিদ সাহেব আপন মনে বিড় বিড় করতে করতে চলে গেলেন, তাকে বেশ অস্থির মনে হচ্ছে।

জামির পাশে এসে দাঁড়াল নিতু, ‘বাবার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে জানেন। কী যে ভালো একটা মানুষ! একজীবনে একটা মানুষ নিজেকে কতবার উৎসর্গ করতে পারে, বলেন তো? বাবার সঙ্গে মায়ের বিয়ের ঘটনাটা জানেন আপনি?’

‘না তো। কীভাবে জানব?’ জামি অবাক হলো।

‘বাবার পরিচিত মহলের প্রায় সবাই জানে, তাই ভাবলাম জানতেও পারেন। বাবার ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধু ছিল রাশেদ। ঢাকার জুরাইনে থাকতেন তিনি, ব্যবসায়ী। যুদ্ধ শুরু হবার বেশ কিছুদিন পর একদিন গভীর রাতে পাকিস্তানি মিলিটারিরা তাদের বাড়িতে হামলা করে। ইনফরমেশন ছিল যে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক সাহায্য দিচ্ছেন। পুরো পরিবারকে গুলি করে মেরে ফেলে পাকিস্তানিরা। গুলি লাগলেও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তার একমাত্র বোন, তিনিই আমার মা মালিহা আহমেদ। যুদ্ধ শেষ হবার অনেক পরে বাবা খোঁজ পান তার। বাবার বন্ধু রাশেদ আসলে বাবাদের গ্রুপটাকেই টাকা দিতেন। বন্ধুর আত্মত্যাগের প্রতিদান দিতেই বাবা মায়ের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।’

জামি নির্বাক, স্তব্ধ। আসলে বলার মতো কিছুই নেই। প্রতীয়মান একটি বড় যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে অনুষঙ্গ হিসেবে ছোট ছোট অনেক যুদ্ধ চলে, তার হিসাব হয়তো কারোরই জানা থাকে না।

৬.
সকাল থেকে প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে জয়নব বেগমের। নিজের অসুস্থতার কথা বলে বেড়াতে ভালো লাগে না, চুপচাপ শুয়ে আছেন সেই সকাল থেকেই । ভয় পাচ্ছেন তিনি, কেন জানি মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে চলেছে। আজকাল শরীর অসুস্থ হলেই আজগুবি যত চিন্তা মাথায় চলে আসে।

‘খেতে চলুন। মা ডাকছে।’ চমকে উঠল জামি।

‘তোমার কথাই ভাবছিলাম এতক্ষণ। একটু বসবে, জাস্ট পাঁচ মিনিট।’

নিতু বসল, ‘পাঁচ মিনিটই কিন্তু! রাতে দেরি করে খেলে মা রাগ করেন।’

‘দেখ, আমি জানি তোমার মানসিক অবস্থা ভালো নয়। তাই একবার ভেবেছিলাম বলব না, কিন্তু বলাটা দরকার, নিতু।’

এত পেঁচাচ্ছেন কেন? সোজা করে বলেন না!’

‘সকাল বেলা আমি তোমার আর ঐ ভদ্র মহিলার কিছু ছবি তুললাম না? ছবিগুলি দেখছিলাম এতক্ষণ। আমি খুবই আশ্চর্য। তোমার যেবু ফুপু আর তোমার চেহারার কী আশ্চর্য মিল, নিতু! চোখ, নাক, ঠোঁট এমনকি গালের ডান পাশে তিলটা পর্যন্ত।’

নিতু হাসল, ‘কই দেখি।’ গভীর মনোযোগ দিয়ে সে ছবিগুলি দেখল। ‘সত্যিই তো! কি অদ্ভুত! এইটা কীভাবে হয় বলেন তো?’

জামি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিতুর দিকে তাকিয়ে রইল, তার মনে গভীর শঙ্কা। তার ধারণা যদি সত্যি হয় তবে নিতুর সামনে অনেক কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। এত অল্প বয়সে এই ধাক্কা মেয়েটা সামলাবে কী করে?

‘কী ভাবছেন? চলুন খেতে চলুন।’

খাওয়া শেষ করে চুপচাপ নিজের ঘরে চলে এল জামি। অস্থিরতা বাড়ছে ক্রমশ। ভাবতে ভাবতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হলো সে, চমকে উঠল নিতুর ডাকে।

‘আপনি উঠুন তো, উঠুন! ক্যামেরাটা দিন এক্ষুনি, তাড়াতাড়ি।’ প্রায় ছোঁ মেরে ক্যামেরাটা নিয়ে নিল সে।

জামি তাকিয়ে রইল। প্রচন্ড বিব্ধস্ত দেখাচ্ছে নিতুকে।

‘এটা কীভাবে সম্ভব বলেন তো? এত অস্বাভাবিক একটা বিষয় আপনার চোখে পড়ল। আর আমি কিছু বুঝলামই না, এত গাধা কেন আমি! কী করব আমি বলেন তো? আমার সমস্ত শরীর কাঁপছে, হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। আপনি আমার হাত দুটো ধরেন তো, শক্ত করে ধরেন, প্লিজ!’ নিতু কেঁদে ফেলল।

জামি হাত ধরল, ‘সাহস রাখো, শক্ত হও নিতু।’

নিতু উঠে দাঁড়াল, টলছে সে, ‘আপনি যাবেন একটু আমার সঙ্গে? হাঁটতে পারছিনা আমি।’

জামি হাত ধরল, ‘এসো, কোথায় যাবে তুমি?’

জয়নব বেগমের ঘরটায় অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা। ধীর পায়ে কাছে এসে মাথায় হাত রাখল নিতু। ‘দাদী!’

‘বিকাল থেইক্যা তো একবারও আইলি না। আমার শরীরডা অনেক খারাপ। আমার কাছে একটু থাক না! কাল তো চইলা যাবি।’

শান্ত করল নিজেকে নিতু, প্রচন্ড ঘামছে সে, ‘মাথায় তেল দিয়ে দেব দাদি?’

‘কিছু লাগবে না। তুই শুধু আমার কাছে বইসা থাক। আরে কানতেছিস ক্যান তুই! আমি কি মইরা গেছি? শরীরডা খারাপ লাগতেছে একটু। ঠিক হইয়া যাবে, চিন্তা করিস না।’

অনেকটা সময় পার হয়ে গেল। নিতু ডাকল, ‘দাদিজান!’

জয়নব বেগম হাসলেন, ‘আছি, মরি নাই। এখন একটু ভালো লাগতেছে।’

‘আমি একটা কথা জানতে চাই।’

‘হুম, ক।’

‘সত্যি করে বল, আমার মা কে?’

জয়নব বেগম চুপ করে রইলেন, দীর্ঘশ্বাস ফেললেন একটা, ‘তোর বুদ্ধি ভালো, এই প্রশ্ন যে তুই একদিন করবি জানতাম আমি। যেদিন থেকে যেবুর বাড়িতে যাস তুই, সেদিন থেকেই এই আতঙ্ক আমার মনে।’

‘আর আমার বাবা?’

‘তুই যা এইখান দিয়া! আর কোনো কথার জবাব দিমুনা আমি; আমার শরীর খারাপ লাগতেছে।’

‘এই প্রশ্নের উত্তর না নিয়ে আমি কোথাও যাবো না। বল তুমি! কই বলো! তুমি না বললে আমি এক্ষুনি বাবার কাছে যাব।’

প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে জয়নব বেগমের, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা ধরতে গিয়ে পড়ে গেলেন তিনি। কেঁপে উঠল নিতু, শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার দিলো।

রাত প্রায় দুটা। ধীরে ধীরে চোখ খুললেন জয়নব বেগম,শঙ্কিত চোখে তাকিয়ে আছে সবাই। নিতু শব্দ করে কেঁদে উঠল। ছেলেকে চোখের ইশারায় ডাকলেন, ‘বাবারে আমারে একটু ধইরা বসাইয়া দে।’

যত্ন করে মাকে বসিয়ে দিলেন খালিদ সাহেব। পেছনের বালিশে মাথা এলিয়ে দিলেন জয়নব বেগম। মালিহার দিকে তাকালেন, মেয়েটাকে অত্যন্ত পছন্দ করেন তিনি। কতগুলি কঠিন সত্য আজ এই পরিবারের ভিতটাকে নড়বড়ে করে দিবে, তারপরও তিনি নিরুপায়। মালিহাকে কাছে ডাকলেন তিনি, ‘আমি আমার ছেলে আর নিতুর সঙ্গে একটু একলা কথা কইতে চাই। মনে কষ্ট নিও না, তুমি অন্য সবাইরে নিয়া এই ঘর থেকে চলে যাও মা।’

বুক ভরে দম নিলেন জয়নাব বেগম, ‘খালিদ, তর মাইয়ার মনে ঝড় উঠছে, সে তার পরিচয় জানতে চায়।’

অসহায়ভাবে মেয়ের দিকে তাকালেন খালিদ সাহেব।

‘শোন নিতু, আমার স্বামী মুক্তিযুদ্ধের সময় যে কাজ করছে তা যে অন্যায় আমি বুঝতাম। কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না আমার। যুদ্ধশেষ হবার পর ক্যাম্প থেইকা যে মেয়েগুলা ছাড়া পাইল তারা তো অপরাধী ছিল না। গ্রাম শালিস বসাইয়া তাগোরে গ্রাম ছাড়া করল। যেবু ক্যান যায় নাই সেইটা আমি বুঝছি।আমি গভীর দুশ্চিন্তায় পড়লাম। একদিন গভীর রাতে গোপনে আমি যেবুর কাছে গেলাম। তার কইলাম, ‘মারে! আমার স্বামী একজন জঘন্য অপরাধী। আমি মনে মনে তারে ঘেন্না করি, কিন্তু কিছু বলার সাহস নাই আমার। তুই আমারে মাফ করে দিস। খালিদ ফিরা আইসা এসব শুনলে যে কী করবে, ভাবতেই আমার গায়ে কাঁটা দিতেছে। সে বাপের ওপর জেদ কইরা হয়তো তোরে বিয়া করবে। কিন্তু তারপর কী হইবে একবার ভাব। এই সমাজ, তার বাপ কি কইব! যেবু চুপ করে রইল।আমি তার হাত দুইটা ধরে বললাম, ‘আমার ছেলেটারে ভিক্ষা দে তুই, মা। এখান থেকে চলে যা।’ সে ফ্যালফ্যাল কইরা তাকাইয়া রইল আমার দিকে। তারপর কইল, ‘আমার তো যাবার জায়গা নাই কোথাও, কোথায় যাব?’ আমি অনেক চিন্তা ভাবনা কইরা আমার বাবারে বললাম সব কিছু। বাবা সব শুইনা বললেন, ‘ওরে আমাগো বাড়িতে রাখ।’ আমি রাতের অন্ধকারে যেবুরে পাঠাইয়া দিলাম। দুই মাসের মাথায় বাবা খবর পাঠাইলেন, যেবুর পেটে বাচ্চা। আবার মাথায় আকাশ ভাইঙা পড়ল, বাবা আতঙ্কে অস্থির। কইলেন, ‘এই মেয়ের পেটে পাকিস্তানি গো বাচ্চা। এখন কী করবি?’ আমি কইলাম, ‘আব্বা, আল্লাহর হুকুম ছিল আপনি আমি কী করতে পারি? আপনি আমারে কথা দেন, যেবুরে কোনো অযত্ন করবেন না। আব্বা কথা রাখছেন আমার। যেবুরে সে নিজের মেয়ের মতো যত্ন কইরা রাখছেন। সাতমাস পর যেবুর একটা মেয়ে হইল।’ থামলেন জয়নব বেগম, লম্বা শ্বাস নিলেন। ‘খালিদ মালিহারে বিয়ে করার পর আমি জানলাম, ডাক্তাররা বলছে তলপেটে গুলি লাগার কারণে মালিহার কোনোদিন বাচ্চা হইব না, মালিহাও জানত সে কথা। আমি অনেক চিন্তা-ভাবনা কইরা একদিন খালিদের লগে দেখা করলাম গোপনে। যেবুর কথা খুইলা কইলাম তারে। কইলাম, ‘তোর বউয়ের তো কোনোদিন বাচ্চা হইব না, আর যেবু তার এই মাইয়ারে কী পরিচয়ে মানুষ করবে?’ যেবুরে বুঝাইলাম আমি। তারপর যেবু বুকে পাথর চাইপা সাতমাসের বাচ্চাটারে খালিদের কোলে তুইলা দেয়।

আজ পর্যন্ত কোনোদিন সে মায়ের সামান্যতম দাবি নিয়া আইসা দাঁড়ায় নাই। মালিহা তোরে মায়ের আদর দিয়া বড় করছে। কিন্তু সে জানে না যেবু কে, কী তার অতীত। কোনো অপরাধ ছাড়া মেয়েটা একের পর এক কী যন্ত্রণা সহ্য কইরা গেছে নীরবে! আমি ওর কথা ভাবি। একটা যুদ্ধে সে তার ভালোবাসা হারাইল, ইজ্জত হারাইল, পেটের মেয়েটারেও পর করে দিলো। তারপরও সে বাইচা আছে। কী মনের জোর তার! বয়সে ছোট না হইলে তারে আমি পায়ে হাত দিয়া সালাম করতাম নিতু। এমন একটা মাইয়া তোর মা, এইটাই তোর গর্ব। আর কোনো পরিচয় খুঁজিসনা তুই।’ জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলেন জয়নব বেগম, ‘কষ্ট হইতেছে আবার, আমারে শোয়াইয়া দে খালিদ।’

মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন খালিদ সাহেব, ‘আমি প্রতিবছর একবার গ্রামে আসি শুধু যেবু যেন তোকে দেখতে পায় সেজন্য। সে আমার সঙ্গে দেখা করতে চায় না কখনও, আমি তবু যাই। দূর থেকে দেখে চলে আসি। ভাবি, বুকের মধ্যেএতটা যন্ত্রণা নিয়ে সে কিভাবে বাঁচে! এই দেশ তাকে বড় একটা উপাধি দিয়েছে, কিন্তু সমাজ তো তারে স্বীকৃতি দেয়নি । এমন একটা সমাজে সে জীবন কাটাচ্ছে, যেখানে তাকে প্রতিনিয়ত চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া হয় সে অস্পৃশ্য। তোর জন্মটা হয়তো অনাকাংখিত ছিল, কিন্তু জন্মের পরে আম্মা, আমি , কিংবা মালিহা কোনোদিন এক মুহূর্তের জন্যও এই কথা মনে আনিনি। তুই যখন খুব ছোট ছিলি তোকে কোলে নিয়ে মালিহা পুরো বাড়ি ঘুরে বেড়াত আর প্রায়ই বলত এইটা হলো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার। মারে, তুই চুপ করে থাকবি, কিছু বলবিনা?’

নিতু উঠে দাঁড়াল, ধীর পায়ে সামনে এগোলো। ফজরের আজান হচ্ছে, অন্ধকার আর কুয়াশায় ঢেকে আছে চারপাশ। পুকুরঘাটে বসল সে। ভেতরটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কী কলঙ্কিত জন্ম তার! কী লজ্জা! কি লজ্জা! মালিহার স্পর্শে চমকে উঠল সে, ‘এই ঠান্ডায় বসে আছিস! চাদরটা গায়ে দিয়ে নে।’ সবেগে জড়িয়ে ধরল সে মাকে, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে মা, সহ্য করতে পারছি না আমি।’

মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন মালিহা, শান্তনার কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না। সময়ের কাছে কখনো কখনো এত অসহায় মানুষ! সে জানে নিতু যেবুর মেয়ে। যেবুর সঙ্গে খালিদের সম্পর্কের কথাও তার অজানা নয়। কিন্তু কখনই কাউকে বুঝতে দেননি তিনি। কিছু সত্য আড়াল থাকাই ভালো,জীবনের জটিলতা কমে তাতে।

৭.
সমস্ত প্রস্তুতি শেষ। জমির মিয়া ব্যাগগুলিনিয়ে সদর দরজার সামনে রাখল। জয়নব বেগম কিছুটা সুস্থ এখন, আবুর মা তাকে ধরে উঠোনে নিয়ে এল। ‘নিতু কই?’ চারপাশে তাকালেন তিনি। নিতু এগিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করল দাদিকে। কপালে চুমু খেলেন জয়নব বেগম। পুবদিকের রাস্তার দিকে শেষবারের মত তাকাল , ‘আসি দাদিজান।’

খেয়াঘাটের ডানপাশে পুরনো অর্জুন গাছটার শেকড়ে বসল নিতু। একটু দূরে খালিদ সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। মালিহা কথা বলছেন জামির সঙ্গে। নিজেকে কেমন অনুভূতিহীন মানুষ মনে হচ্ছে তার। ‘চলে যাচ্ছো?’

চমকে উঠল নিতু।

‘আমি কিন্তু ভাবিনি, তুমি এভাবে চলে যাবে।’

নিতু হাসল, ‘আপনি যাচ্ছেন না?’

‘না। আমি আরও দুদিন থাকব। কিছু কাজ করতে চাই। স্যারকে বলেছি। তুমি যাবার আগে তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা করলে না? ভয় পাচ্ছো? সমাজ, লোকলজ্জা? তুমি তার আত্মত্যাগের কথা একবারও ভাবলে না! তোমার জন্মের অবাঞ্চিত দাগটাকে মুছতে তিনি মাতৃত্বটাকে পর্যন্ত বিসর্জন দিলেন। এত কিছু জানার পর তোমার কি উচিৎ না এখন তার পাশে দাঁড়ানো? ভদ্র মহিলা এ জীবনে কী পেলেন? একবার ভাবো! আজ চাইলে কিন্তু তুমি তাকে অনেক কিছু দিতে পার। পাশে দাঁড়াও তার!’

‘তিনি আমাকে চান না, জামি সাহেব। তিনি অনেক কঠিন, আপনি জানেন না। প্রতিবার আমি পাগলের মতো ছুটে গিয়েছি তার কাছে না জেনে, অদ্ভুত এক মায়ায়। কিন্তু তিনি তো জানতেন সব, কোনোদিন একটিবারের জন্যও বলেননি আমাকে, ‘মারে আয়, তোকে একটু বুকের মধ্যে নিই।’ কেন বলেননি জানেন? মায়ের মমতা ছাপিয়ে আমার অভিশপ্ত জন্মের স্মৃতি তাকে যন্ত্রণা দেয়। তাই তিনি কখনও আমাকে বুকে জড়াতে চাননি।’

জামি হাসল, ‘এটা তোমার অভিমান।’

‘না, এটাই সত্যি। এই যে আমি চলে যাচ্ছি নিশ্চয়ই জানেন তিনি। একটিবারও তার কেন মনে হয় না যে, আবার কবে দেখব মেয়েটাকে, একটু দেখে আসি!’

ট্রলার ঘাটে চলে এসেছে, মালপত্র ওঠানো হলো। মালিহা আর নিতুকে হাত ধরে ওঠালেন খালিদ সাহেব। জামির কাঁধে হাত রাখলেন তিনি, ‘কিছু প্রয়োজন হলে বলবে জমির মিয়াকে, সংকোচ করবে না। একলা ফেলে চলে যাচ্ছি তোমাকে, খারাপ লাগছে।’

‘একদম চিন্তা করবেন না, স্যার। আমি ভালো থাকব। দুদিন পরে দেখাতো হচ্ছেই! ‘

ট্রলার ঘাট ছাড়ল। জামি দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসে চুল উড়ছে তার। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিতু। হঠাৎ চিৎকারে চমকে তাকালেন খালিদ সাহেব, ‘ট্রলারটা থামাও, প্লিজ থামাও!’ নিতু কাঁদছে, ‘বাবা, থামাতে বল ট্রলারটা!

থামানো হলো ট্রলার, পাড়ে ভিড়বার আগেই নেমে পড়ল নিতু। ঘটনার আকস্মিকতায় নির্বাক সবাই, জামি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। নিতু ছুটে যাচ্ছে অর্জুন গাছটার দিকে, কাদায় পুরো কাপড় তার মাখামাখি, গাছটার আড়াল থেকে কারও শাড়ির আঁচল সমানে উড়ছে বাতাসে, জামি চিনতে পারলো আঁচলটা……..।

-নাঈমা পারভীন অনামিকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *