আক্ষেপ

বিকেলের আকাশটা কালো মেঘে ঢাকা। চোখ পড়লেই মনটা কেমন করে ওঠে। তবু, সেই আকাশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কাঠের পিঁড়িতে বসে আছেন রাবেয়া খাতুন। বয়স সত্তর কী পঁচাত্তর হলো, তা তার নিজেরও অজানা। একটা সময় ছিল যখন বয়সের হিসেব রাখত না কেউ। ইস্কুলের মাস্টার নিজের অনুমানে বসিয়ে দিতো বয়স। সেটাকেই ধরা হতো স্ট্যান্ডার্ড।

সে হিসেবে রাবেয়া খাতুনের বয়স উনসত্তর। তবে, সেই সংখ্যাটি যে তার জীবনে পেরিয়ে আসা সময়ের সঠিক হিসেব নয়, তা তার নিজেরও জানা। এ জীবনে কম কিছু তো আর তিনি দেখলেন না। ভাষা আন্দোলন, গণ অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম, পঁচাত্তরের শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড, জিয়াউর রহমানের উত্থান, এরশাদের স্বৈরশাসন, একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা, হরকাতুল জিহাদের তাণ্ডব, পিলখানার গণহত্যা—কত কিছু যে দেখে গেলেন এক জীবনে। তবু, ভুলতে পারলেন না ছিয়ানব্বইয়ের একটি ঘটনাকে। সেসময় দেশজুড়ে চলছিল একদলীয় নির্বাচন। সেই নির্বাচনের দিন তার সদ্যমাত্র ম্যাট্রিক পাশ করা সন্তান বন্ধুদের সাথে বেরিয়েছিল ঘুরতে। আপনমনে তিনি তখন ব্যস্ত ছিলেন সংসারের কাজকর্ম নিয়ে। ছোটো ছেলেসহ সব মিলিয়ে তার তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। স্বামী মসজিদের ইমাম। বলা যায়, সুখের সংসার।

কিন্তু, সেই সুখ বেশিদিন টিকল না। অন্য গ্রামের দরিদ্র পরিবারের এক মেয়েকে দেখে তার স্বামী এমনভাবে প্রেমে পড়েছিলেন যে, শেষপর্যন্ত মেয়েটিকে তিনি লুকিয়ে বিয়ে করে ফেলেন। পরবর্তীতে সেই কথা জানাজানি হলে তিনি চলে যান রাবেয়া খাতুনের সংসার ফেলে। এরপর শুরু হয় রাবেয়া খাতুনের জীবন যুদ্ধ। একহাতে সংসার, আরেক হাতে সংসারের খরচ সামলাতে সামলাতে কেটে যাচ্ছিল তার জীবন। সেই কষ্টের জীবনে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা এলো সেদিন। সবে মাত্র রান্না শেষ করে তিনি উঠানে এসে দাঁড়ালেন। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে দেখছিলেন উঠোনের আমগাছগুলিকে। ঠিক সেসময় এক ছেলে দৌড়ে এসে বলল, “খালাম্মা তাড়াতাড়ি বাজারে চলেন।” ছেলেটির কথা শুনে পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেল রাবেয়া খাতুনের। তার বড়ো ছেলে স্বভাবে বাউণ্ডুলে। তাই, খারাপ খবরের আশঙ্কায় তিনি ভেবে নিলেন, বড় ছেলের নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। একারণে, দ্বিতীয় কোনো কথা না বলে তিনি যন্ত্রের মতো ছেলেটিকে অনুসরণ করে চলে গেলেন বাজারে।

বাজারের লোকেরা গোল হয়ে একটি ভ্যানকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। দৃশ্যটি দেখে ধক করে উঠল তার বুক। বার বার মনে হলো, “বড়ো ছেলে কি আর বেঁচে নেই?” ঠিক সেসময় বড়ো ছেলেটি এসে মায়ের হাত ধরল। হঠাৎ বড়ো ছেলের স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠলেন তিনি। বুঝে উঠতে পারলেন না, ঘটনা কী হয়েছে।

তখন, বড়ো ছেলে ভিড় সরিয়ে তাকে নিয়ে গেলেন ভ্যানটির কাছে। ভ্যানটিতে শুয়ে আছে তার ছোটো ছেলে। স্বভাবে যে ছিল সবচেয়ে শান্ত, নিজের হাজারও কষ্ট হলেও অন্যের কষ্টের কথা ভেবে যে কোনোদিন কোনো উচ্চবাচ্য করেনি, অভাবের সংসারে মাছের টুকরো নিয়ে বড়ো ছেলে ও ছোটো মেয়ের মারামারি হলে যে নিজের পাতের মাছ তুলে দিতো অন্য পাতে; সে’ই ছেলে শুয়ে আছে ভ্যানে। বুকে বুলেটের ক্ষতচিহ্ন।

বুলেটটি তার হৃৎপিণ্ড ছিন্নভিন্ন করে বেরিয়ে গেছে। সেদিকে তাকিয়ে একটি চিৎকার দিয়ে মূর্ছা গেলেন তিনি। পরে জানা গিয়েছিল, একদলীয় নির্বাচনের প্রতিবাদে সেদিন মিছিল হয়েছিল। বন্ধুদের সাথে ছেলেটিও গিয়েছিল মিছিলে, কোনো কারণ না জেনে, মজার ছলে। সেই মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে গুলি চালায় পুলিশ। আর সেই গুলি এসে লাগে তার বুকে, ছিন্নভিন্ন করে দেয় তার কোমল হৃদয়টিকে।

বিকেল গড়িয়ে আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নেমে আসলো। আকাশ ভেঙে নেমে আসলো শ্রাবণের ধারা। রাবেয়া চৌধুরী তবুও বসে রইলেন কাঠের পিঁড়িটিতে। জীবন কোথায় নিয়ে এসেছে আজ তাকে। ধীরে ধীরে মেয়েগুলো সব চলে গেল স্বামীর সংসারে। তারা সবাই এখন অনেক ভালো আছে। আর ছেলে? ছোটো ভাইয়ের নাম ভাঙিয়ে আজ বড় রাজনীতিবিদ হয়ে গেছে। টাকার ছড়াছড়ি তার ঘরে। আর যেই মা জন্ম দিয়েছে তাকে, যার আরেক ছেলের নাম ভাঙিয়ে আজ সে সমাজে প্রতিষ্ঠিত; সেই মা না খেয়ে আছেন তিনদিন ধরে।

টিনের ঘর ভেঙে তৈরি হয়েছে অট্টালিকা, আর সেই অট্টালিকায় নেই খাবার, এ কথা বিশ্বাস কে করবে? মেয়েদের কাছে টাকা চাইতে তার বিবেকে বাধে। আর ছেলে, মায়ের ফোন দেখলে রিসিভই করে না। অথচ, এদের মানুষ করবার জন্য একসময় তিনি কী খাটুনিটাই না খেটেছেন। চাইলে তিনিও পারতেন তাদের বাবার মতো ছেলে মেয়েদের ফেলে চলে গিয়ে নিজে ভালো থাকতে। কিন্তু, কোনোদিনও সেই কথা তিনি মাথায় আনেননি। তাইতো, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসে যখন তাকে জানিয়ে দিলো, সময় হয়েছে যাবার; তখন শেষবারের মতো চোখ বুঝে তিনি প্রার্থনা করলেন, “হে আল্লাহ, ভালো রেখো আমার সন্তানদের, আমার নাতি নাতনিদের। তাদের সব ভুল-ত্রুটি তুমি মাফ করে দিও।”

রাবেয়া খাতুনের মৃত্যুতে পুরো গ্রাম জুড়ে নেমে এলো শোকের ছায়া। বিশাল আয়োজনে বিদায় দেওয়া হলো তাকে পৃথিবী থেকে। অথচ, যার জন্য এতো আয়োজন, তিনি চলে গেলেন ক্ষুধার কষ্ট নিয়ে, একবেলা ভাত খেতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে। অবশ্য তার খবর কেই বা রাখে…

জিসান রাহমান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *