অনুধাবন ( ৫ম পর্ব )

(রাসেল)

সারা গায়ে অসহ্য ব্যথা, সাথে প্রচন্ড মাথা ব্যথা নিয়ে ঘুম ভাঙলো। পুরো মুখে একটা টকটক স্বাদ আর পেট থেকে বুক পর্যন্ত যেন জ্বলছে। কয়টা বাজে, আমি কোথায় এটা বুঝে উঠতেই অনেক সময় চলে গেল। মাথা ঘুরিয়ে দেয়ালে তাকিয়ে দেখি প্রায় দুইটা বাজে। দিন না রাত কে জানে? পুরো ঘরের ভেতর এখনো বেশ অন্ধকার। নাকি পুরো একদিন ঘুমিয়ে পার করে দিয়েছি? কাল রাতে আব্বাসের ঠেকে কি এক নতুন জিনিস খাওয়ালো মূহুর্তের মধ্যে মাথা ফাঁকা। প্রথম প্রথম যখন গাঁজা খাওয়া শুরু করি তখন মাথা এরকম ফাঁকা লাগতো। এখন আর গাঁজার পুরিয়ায় দম দিয়ে কাজ হয়না। ফাঁকা মাথার একটা সুবিধা আছে, নিজেকে মনে হয় পাখির মত, চিন্তাহীন উড়ে বেড়ানো শুধু। কষ্টগুলো বড় ভারহীন মনে হয় তখন।

বেশ মাথাব্যথা থাকলেও একা একা শুয়ে চিন্তা করতে কেন যেন ভালো লাগছে। নিজেকে নিজে ভেঙে ফেলার এই খেলায় কখন, কিভাবে জড়িয়েছি জানিনা বা বলা ভালো ঠিক মনে করতে পারিনা এখন আর। কিন্তু এই খেলায় আমার প্রতিপক্ষ শুধু একজন, আমার জন্মদাতা পিতা। ছোটবেলা থেকে যখন যা চেয়েছি, কোন ঝামেলা বা প্রশ্ন ছাড়াই পেয়ে গেছি সময়মত। কিন্তু যা পাইনি তা হলো বাবা বা মায়ের শাসন আর সাহচর্য। মা যেন কেমন ধারা ছিলেন, সারাদিন শুধু সংসারের গল্প আর বোনদের কাজ শেখানো। যেন এই সংসারটাই শুধু পৃথিবী। বাবা যে কখন বাসা থেকে বের হতেন আর কখন ফিরতেন তা খুব কম রাতেই টের পেতাম। শুনেছি বাবারা তিন ভাই নাকি একসাথে থাকতেন আমার জন্মের আগে। আমার জন্মের পরপরই বাবা আমাদের নিয়ে শহরের দিকে চলে আসেন। তারপরও যখনই গ্রামে যেতাম সবাই এত আদর করতো। মা মাঝেমধ্যেই বলতেন আগেই কত ভালো ছিলেন। সবাই মিলে একসাথে থাকার মধ্যে নাকি একটা অন্যরকম আনন্দ ছিল।

মেট্রিক পাসের পর একবার একাই গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলাম। গ্রামের এক চাচার সাথে বিকালে চারদিক ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। হুট করে এক বাড়ি থেকে এক বুড়ি মতন মহিলা বেরিয়ে এসে সেই চাচাকে বলে, ‘এইডা কি তালুকদারের পোলা নি? বাপের মতো দেখতে লাগে?’ চাচা হু জবাব দেয়ার সাথে সাথে শুরু হয় গালি আর অভিশাপের বৃষ্টি। কোন মানুষ কাউকে এতো বাজে কথা বলতে পারে এটা আমার কল্পনাতেও ছিল না। আমি অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলাম, উনি এভাবে বাবাকে গালাগাল কেন করছে? ‘আরে পাগল মহিলা’ এই বলে সেই চাচা আমাকে সরিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু আমার মাথায় ওনার কিছু কথা কিভাবে যেন গেঁথে গেল। কিছুতেই তাড়াতে পারছিলাম না। আস্তে আস্তে একটু একটু করে খোঁজ নিতে থাকি। প্রায় কয়েক বছর লেগে যায় আমার সব খোঁজখবর নিতে। বাবা সম্পর্কে প্রতিটা খারাপ ঘটনা শুনতাম আর আমি মনেপ্রাণে চাইতাম সেটা যেন একটা মিথ্যে বানোয়াট কথা হয়। কিন্তু আমার সব আশাকে ধুলিসাৎ করে প্রতিটা ঘটনাই তার সত্যরূপে আমার কাছে ধরা দেয়।

বাবার অপকর্মের লিস্ট যদি দেয়া শুরু করি তবে বোধহয় দিন ফুরিয়ে রাত হবে। তার মধ্যে যেটা সবচেয়ে খারাপ লেগেছে তা হচ্ছে উনি অনেক এতিমের জমি জোর করে কম দামে নিজের করে নিয়েছেন। অনেকবার ভেবেছিলাম বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাব। এই অবৈধ সম্পদের চূড়ায় বানানো প্রাসাদে থাকবোনা। কখনো পড়াশোনায় কোন চাপ ছিল না দেখে বিএ পাসের পরপরই পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম। ঘুরে ঘুরে একটা কাজ খুঁজছিলাম। একটা কিছু পেলেই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো ভেবেছিলাম ও । কিন্তু কয়েক দিনের চেষ্টায় বুঝে যাই যে সে জীবন বড়ই কষ্টের। আজীবন বাপের কাঁধে ভর দিয়ে চলা আমি, আমার মতো ননীর পুতুল সেরকম সম্মানিত জীবনের যোগ্যই নয়।

আর কোন উপায় না পেয়ে মনে হলো, আমি ওনার সামনে থেকে ওনার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিব, ওনার অপকর্মের ভার নিতে না পেরে আমি এমন হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু হায় মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। এরই মধ্যে লিমার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে ওকে পালিয়ে বিয়ে করে ঘরে এনে ভাবলাম, বেশ শাস্তি দেয়া হলো। বাবার মুখে চুনকালী পরলো। কিন্তু না সেই অতীব ধূর্ত লোক খুব ঠান্ডা মাথায় পুরো ব্যাপারটা নিজের আয়ত্ত্বে নিয়ে এলেন। লিমার সাথে সংসার শুরু করে ভেবেছিলাম, থাক জীবন না হয় নিজের মতো করে গুছিয়ে নেব। কিন্তু বাবার সম্পর্কে সবচেয়ে খারাপ খবরটা পাওয়ার পর আমি আর পারিনি নিজের মতো পথে ফিরতে। লিমাকে আমি আমার মনের কোন কথা কিছুই বোঝাতে পারিনি। ওর জীবনের ভাবনায় ছিল শাড়ী গয়নায় নিত্য সেজেগুজে সুন্দরী বৌ হয়ে থাকা। যেন পৃথিবীতে তার জন্মই হয়েছে শুধু গয়না শাড়ীর জন্য।

আমার বাবার দূর গ্রামে আরেকটা সংসার হতে হতেও হয়নি সে খবর আমি জানি আমার মেয়ে তিতলী হবার পরে। সেই মহিলাকে নাম মাত্র মূল্যে গ্রাম ছাড়া করা হয় কারণ তার ঔরসে ছিল বাবার অপকর্মের ফসল। তারপর আর তাকে কোথাও দেখা যায়নি। যতদূর বুঝি সেরাতেই তাকে মেরে ফেলা হয় কোন কাকপক্ষী জানার সুযোগ হয়নি। গরীবের মেয়ে মরে গেলে তার খোঁজ নেয় কে? দাঁড়ি গোঁফের জঙ্গলে লুকিয়ে সুফি সেজে থাকা আমার বাবা নামক অমানুষটাকে কি শাস্তি দেয়া যায় বুঝতে বুঝতে নিজেই নিজেকে শাস্তি দিতে শুরু করি। আমার যন্ত্রনা আরো বাড়াতেই বুঝি ওয়াদুদ কাকা মানে বাবার ডান হাত জানায় বাবার সমস্ত সম্পত্তির নমিনি আমি। মনে হলো এই পাপের টাকা আমি পাপের পথেই ওড়াবো।

নাজমা মেয়েটা মাঝখান দিয়ে হুট করে কিভাবে যে আমার জীবন মঞ্চে ঢুকে গেলো আমি নিজেই এখনো ঠাহর করতে পারিনা। সেই প্রথম দিন বাড়িতে আনার পর থেকে ওর চেহারা দেখার সুযোগ হয়নি আর। দিনের আলোতে যতক্ষন বাড়ি থাকি তাকে চোখের সামনে দেখিনি। অবশ্য আমি দেখতেও তো চাইনি। ওর মা, না না সৎ মা আসলেই একটা বদ মহিলা। কোন মানুষ নিজে মেয়ে হয়েও আরেকটা মেয়ের সর্বনাশ এভাবে করতে পারে আমার জানা ছিল না। আমাকে নেশার জগতে আটকে কয়েকজনকে সাক্ষী রেখে বিয়ে পড়িয়ে দিল। চারপাশে এমন সব ষন্ডাগুন্ডা রেখেছিল যে আমি টু শব্দ করলে আমার লাশ পরে যেত। একদিকে ভালোই হয়েছে, বাবার মুখে আরেকটু কালি লাগিয়ে দিতে পেরেছি। শুধু লিমা আর তিতলীর জন্য মাঝে মাঝে খারাপ লাগে। ওদের তো কোন দোষ ছিল না। আমি নিজেই ওদেরকে আমার জীবনে জড়িয়েছি আর আমার সাথে সাথে ওদেরকেও প্রায়শ্চিত্তের ভার দিচ্ছি যেটা কোনভাবেই ওদের প্রাপ্য ছিল না।

দরজায় খুঁট করে শব্দ হতেই চোখের ওপর হাত দিয়ে ফেললাম যাতে মনে হয় আমি এখনো ঘুমাচ্ছি। কারো সাথে এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা। আমার আরেকটা সন্তান আসছে পৃথিবীতে শিগগিরই। আমি কি পারিনা নিজেকে বদলে ফেলতে? না হয় গরীবের সম্পত্তি একটু একটু করে ফিরিয়ে দিয়ে পাপের বোঝা হাল্কা করে নেব। এরকম ভালোমানুষী চিন্তা আমার মনে আসে যখন নেশার ঘোর পুরোপুরি কেটে যায়। কিন্তু তাহলেতো ঐ লোকটাকে শাস্তি দেয়া হবেনা। ঐ চিন্তা মাথায় এলে আমি আর কোনভাবে নিজেকে সামলাতে পারিনা।

চোখ না খুলেও বুঝতে পারছি দরজার কাছাকাছি মা দাঁড়ানো, পাশে তিতলী বোধহয়। কারণ একটা বাচ্চার কন্ঠ শোনা যাচ্ছে ফিসফিস করে কথা বলছে, ‘বাবা এতো ঘুমায় কেন দাদু?’ মা কি জবাব দিল শোনার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু বোধহয় এতক্ষনের একাকী চিন্তা আর রক্তে ড্রাগের উপস্হিতিতে আবারো ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠে তিতলীটাকে একটু আদর করে দেব ভাবতে ভাবতেই আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

নেশার ছায়ায় রঙিন জীবনের স্বপ্নরা শুধু ঘুমের ঘোরেই ধরা দেয়। কিন্তু বাস্তবতার বিবর্ণ রূপ বড় কদাকার বলেই হয়তো রাসেলের মতো মানুষরা চাইলেও সহসা ফিরে আসতে পারেনা ঐ কালো জীবন থেকে। বাবাকে শাস্তি দেয়ার নামে নিজের জন্য শাস্তি নামক প্রহসনের মঞ্চ সাজিয়ে আপাতভাবে হয়তো খানিক প্রশান্তি মিলছে শুধু নিজের মনেরই। কিন্তু তার ভার কতোটা অবর্ণনীয় হয়ে তার জীবনে জড়িয়ে থাকা অন্যদেরকেও অযাচিতভাবে জীবনের কঠিন মঞ্চে নিষ্ঠুরভাবে পতিত করছে রাসেলের তা বোঝার মতো ক্ষমতাটুকু যে নেশার জগত পুরোপুরি কেড়ে নিয়েছে তার প্রমান তো লিমা, তিতলী আর নাজমা স্বয়ং তার সামনেই। বাকীরাও কি খুব ভালো আছে?

চলবে…

-ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *