অনুধাবন ( ২২তম পর্ব )

( লিমা)

গতকাল সন্ধ্যা থেকেই পেটের মধ্যে কেমন একটা হাল্কা ব্যথা ছিল। গত কয়েক সপ্তাহ যাবৎ ঠিকে ঝি কুলসুম আমার পাশের রুমের নীচে ঘুমায়। আমার শাশুড়ি ও কোন কোন রাত আমার ঘরে থেকে যায়। সবাই আমাকে নিয়েই চিন্তিত কখন ব্যথা ওঠে, কি সমস্যা হয়। রাতে এমনিতেও আমার ঘুম কম হয়। কাল রাতে তিতলী শুয়েছে আমার শাশুড়ীর কাছে। অন্যদিন দেখা যায় হয়তো ওর গায়ে হাত দিয়ে খানিক ঘুম আসে। কাল খালি বিছানায় আরো যেন ঘুম আসছিল না। রাত জেগে পাশের রুমে পুরোনো হিসেবের খাতা দেখতে যেয়েই দেখি মাঝের কিছু পাতা নেই। পাতাগুলো আমিই মুড়ে রেখেছিলাম ম্যানেজার সাহেবের সাথে কথা বলবো ভেবে। কিছু ঝামেলা আছে ফসলের হিসাবে ঐ পৃষ্ঠাগুলোতে। তিতলী তো সাধারণত আমার কাগজপত্রে হাত দেয়না। তাহলে? আগের বার ও যখন দেখেছি তখনো ঐ পৃষ্ঠাগুলো ছিল। বাতি নিভিয়ে টেবিল থেকে উঠে খুঁজতে যেয়ে অন্ধকারে বেখেয়ালে পড়লাম হুমড়ি খেয়ে। ব্যথার চেয়েও ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম প্রথমে আমার বাচ্চার কিছু হলো না তো? আমি এতো বড় একজন মহিলা ধপাস শব্দে পড়লাম, জোরে চিৎকার দিলাম কিন্তু কুলসুমের ঘুম ভাঙায় সাধ্যি কার? মরার ঘুম দিয়েছে কি না কে জানে? হাতড়ে হাতড়ে লাইট জ্বালালাম। আমার সারা কাপড় ততক্ষণে ভেজা। তারচেয়েও ভয়ংকর যে ব্যাপার আমার ঘরের মেঝেতে পিচ্ছিল কিছু ফেলে রাখা হয়েছিল। কে এতো বড় সর্বনাশ করলো? পাশের রুমে থাকা কুলসুম ও তো কোন জবাব দিচ্ছে না। কোনরকমে পিছলে পিছলে দরজা পর্যন্ত এলাম। দরজার হুক ঘুরাতেই দেখি সেটা বাইরে থেকে বন্ধ। কি ভয়ংকর ব্যাপার। আমার এখুনি হাসপাতালে যাওয়া দরকার। এই রাতে আমি এখন কিভাবে ঘর থেকে বের হবো? কাকে ডাক দিব? নিদারুন আতংকে যেন আমার চিন্তাশক্তিও জমে যাচ্ছিল।

কতটা সময় পেরিয়েছে জানিনা। আস্তে আস্তে ঘষে ঘষে পাশের ঘরে এলাম কুলসুমকে ডাকতে। কয়েকবারের ডাকেও যখন কুলসুমের ঘুম ভাঙলো না তখন নিশ্চিত হলাম পুরোটাই কোন বড় ধরনের চক্রান্তের অংশ। কুলসুমকে নিশ্চিত ঘুমের কিছু খাওয়ানো হয়েছে। দরজা বাইরে থেকে কখন লাগালো কেউ আমি কেন একটুও শব্দ পেলাম না? নাকি আমি যখন পাশের ঘরে ছিলাম তখন কেউ জানালায় আমাকে দেখে সামনের দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়েছে? সে যাই হোক, আমাকে আগে এ ঘর থেকে বের হতে হবে। আর কোন বাতি জ্বালালাম না, পাছে বাইরে থাকা কেউ টের পেয়ে যায় আমি বের হওয়ার চেষ্টা করছি। আমার ঘরের বাথরুমের পেছন দিয়ে একটা খিড়কি দরজা আছে,যেটা সবাই জানেনা। আর কোন পতন যেন না হয় তাই খুব সাবধানে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। কোন শব্দ করতে না চাইলেও বুঝি দীর্ঘ অব্যবহারের জং পড়া দরজা সে কথা শুনতে চাইলো না। ক্যাঁচকোঁচ শব্দে তার উপস্থিতি ঠিক ঠিকই জানালো। খুবই ভাগ্য ভালো এ সময়ে দূরে কোথাও থেকে আগুন আগুন শব্দে কিছু লোকের দৌঁড়াদৌঁড়ির শব্দ হচ্ছিল বলে দরজা খোলার শব্দ চাপা পরে যায়। আমার তখন একটাই লক্ষ্য আমার শ্বশুরের ঘরের দরজা। যে করেই হোক আমাকে ওখানে পৌঁছাতে হবে। আমি জানি ওনার জীবন থাকতে উনি আমার পেটের বাচ্চা বা আমার কোন ক্ষতি হতে দেবেন না।

এতো অল্প পথকে ও আমার মনে হচ্ছিল কোন অসীম দূরত্ব আমি পার হচ্ছি বুঝি। কিভাবে আমি আমার শাশুড়ীর ঘরের দরজা পর্যন্ত পৌঁছেছি জানিনা; তবে একই সময়ে বাড়ির সদর দরজায় হুড়মুড় করে লোকের উপস্থিতিতে আমি আতংকে অস্থির হয়ে যাই। আমার শুধু মনে হচ্ছিল বাড়িতে বুঝি ডাকাত পরেছে। আমার পেটের বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারবো কি না সেই চিন্তাতেই আমি ঘরের দরজার ওপর কাঁপতে কাঁপতে আছড়ে পরি। লোকের চিৎকারে নাকি আমার সশব্দে দরজার ওপর আছড়ে পরায় জানিনা দরজা খুলে আমার শ্বশুর শাশুড়ি দুজনেই বেরিয়ে আসেন।

‘মা, বাবা, আমাকে বাঁচান। কুলসুম আমার ঘরে অজ্ঞান হয়ে পরে আছে।’ এটুকু বলেই আমি জ্ঞান হারালাম।

আমার জ্ঞান ফেরে হাসপাতালের বিছানায়। আমার বাচ্চা সিজার করে বের করতে হয়। কিন্তু আমাকে বড় শহরের হাসপাতাল পর্যন্ত আনতে হয় কারণ আমার ব্লাড প্রেসার কিছুতেই নামানো যাচ্ছিল না। জ্ঞান ফেরা না ফেরার মাঝে কেটে যায় বেশ কয়েক দিন। এই ফাঁকে তালুকদার বাড়িতে ঘটে গেছে বেশ কিছু তুলকালাম কান্ড।

……………

আজ সকাল থেকে আমার শরীর একটু ভালো। ডেলিভারির প্রায় পাঁচদিন পর আমি আমার পেটের ভেতর বড় হওয়া মানুষটাকে দেখলাম আমার শাশুড়ীর কোলে। একদম যেন ছোট্ট রাসেল। এক অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে গেল মন। খুব ইচ্ছে করছিল আমার ছোট্ট বাবাটাকে কোলে নেই। কিন্তু আমার সে অবস্থা ছিলনা শরীরের।

মা, তিতলী কোথায়? ও কি জানে ওর একটা ভাই হয়েছে?

তিতলী বাড়িতে আছে গো মা। ও ভালো আছে। শাহানাকে বাড়িতে এনে রাখসি। বিশাল বিপদ গেছে আমাদের ওপর। তুমি আরেকটু সুস্থ হও তারপর জানাবো। তোমার শ্বশুর একটু পরেই হয়তো আসবে। তখন তোমার সাথে কথা বলবে।

কি বিপদ মা? সবাই সুস্থ আছে তো? রাসেল? ও ঠিক আছে তো?

রাসেল, তুমি আর আমাগো নতুন মানুষ ভালো আছে, এইটাই ভালো খবর। তুমি এখন ঘুমাও আবার। নিজেরে সুস্থ করো। অন্য কিছু দেখার জন্য তোমার শ্বশুর আছে।

পরবর্তী কয়েক দিনে আমার অবস্থা আস্তে আস্তে ভালোর দিকেই গেল। যতোবার আমার ছোট্ট বাবুটাকে দেখি ততবারই মনে হয় ওর আর তিতলীর জন্যই আমাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে হবে। শরীরও যেন মনের কথা শুনছিল। এই কয়দিনে এর ওর কাছে যা জানলাম তা হচ্ছে, সেই রাতে কে বা কারা আমার ঘরের মেঝেতে জানালা দিয়ে কেরোসিন তেল ফেলে রেখেছিল আর আমি ঘরে ঢোকার কিছুক্ষণ পরেই বাইরের তালা লাগিয়ে দিয়েছিল। কুলসুমের রক্তে কড়া মাত্রার ঘুমের ঔষধ পাওয়া গেছে। হাসপাতালে কয়েকদিন অজ্ঞান থেকে ও এখন সুস্থ। আর সে রাতেই আমার শ্বশুরের একটা গুদামে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে কে বা কারা। পুলিশ পুরো ব্যাপারটা দেখাশোনা করছে। আমার শ্বশুরের সাথে পুলিশের সম্পর্ক ভালো বিধায় তদন্ত খুব দ্রুতই নাকি এগোচ্ছে। ঘরের এক কাজের লোক আর আড়তের দারোয়ানকে জেরা চলছে। আমার শ্বশুর প্রতি বিকালে নিয়ম করে আমাকে দেখতে এলেও আমাকে এসব ব্যাপারে কিছুই উনি জানাননি। আজো বিকাল বেলা নিয়ম মতই দেখতে এলেন। কিছুক্ষণ বাবুর সাথে খেললেন। অন্যদিন তিতলীকে নিয়ে আসেন, আজ অবশ্য একাই এসেছেন। বের হয়ে যাবার মুখে কি মনে করে আবার ঘুরে দাঁড়ালেন।

লিমা, তোমার শরীর এখন কেমন লাগছে? না মানে, তোমার সাথে কিছু ব্যাপারে কথা বলতাম।

আমি ভালো বোধ করছি বাবা। আপনি বলেন, কি বলতে চান?

না মানে তুমি নিশ্চয়ই কিছু কিছু শুনেছো এই কয়দিনে ওদিকে কি হয়েছে? বুঝতেই পারছো আমি ব্যবসার চেয়েও তোমার ওপরের বিপদটাতে বেশী আতংকিত হয়েছি। তুমি কি এমন কিছু দেখেছো বা তোমার কাউকে সন্দেহ হয়েছে? পুলিশ তোমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে। আমি এখনো তোমার শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে ব্যাপারটা আটকে রেখেছি।

বাবা, সত্যি কথা হচ্ছে এরকম কোন বিপদ আমি নিজেও আশা করিনি। তবে এ বেলা আমি এটুকু বুঝতে পেরেছি আপনি কিরকম বিপদের জীবন নিয়ে প্রতিদিন ঘোরেন। আমি কিন্তু ভয় পাইনি বাবা। বাচ্চাটা পেটে না থাকলে এতো ঘাবড়ে হয়তো যেতাম না।

হুম সেটা আমিও বুঝতে পেরেছি। তোমার ঘর থেকে হিসাবের সব খাতা পত্র আমি সরিয়ে নিয়ে গেছি।

ভালো কথা বলেছেন বাবা। আমার টেবিলের ওপরে যে খাতাটা ছিল তার থেকে কয়েক মাসের কিছু হিসাবের পৃষ্ঠা সে রাতে আমি খুঁজে পাইনি। ওটা খুঁজতে যেয়ে টেবিল থেকে ওঠার পরই তো যত বিপত্তি ঘটে। ঐ পৃষ্টাগুলোতে গ্রামের জমিগুলোর ফসলের কিছু হিসাবে ঝামেলা ছিল। আপনার সাথে বা ম্যানেজার চাচার সাথে সময়মত কথা বলবো ভেবে মুড়ে রেখেছিলাম। কে যেন খুব সূক্ষ্মভাবে শুধু ঐ কয়েক পাতাই সরিয়ে নিয়ে গেছে।

আচ্ছা আমি দেখছি। তুমি রেস্ট কর। কাল বা পরশু হয়তো তোমাকে ছেড়ে দেবে। ঐসব ব্যাপার নিয়ে আপাতত আর মাথা ঘামাবে না একদম। আমি দেখছি। আপাতত তোমার মাতৃত্বকালীন ছুটি। ঠিক আছে, মা?

……………..

আমার শ্বশুরের গমন পথের দিকে তাকিয়ে আমার হঠাৎ মনে হলো একটা কথা, কিছু লোক মচকায় কিন্তু ভাঙেনা কখনো। কি দৃঢ় ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে প্রতিটা পদক্ষেপ অথচ কি অসম্ভব সব বিপদ আর প্রতিপক্ষ রয়েছে সামনে অপেক্ষায় তার খানিক সাক্ষীতো আমি নিজেও। মাথায় কেন যে ঘুরছে এটা আসলামের চক্রান্ত, ঠিক জানি না কিন্তু নিজের মেয়ের জামাই সম্পর্কে ছেলের বৌ বাজে কথা বললে কোন বাবারই হয়তো শুনতে ভালো লাগবে না ভেবেই চুপ করে গেছি এ বেলা।

-ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

চলবে…..

https://www.facebook.com/groups/1749042645384412/permalink/2217891141832891/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *