( রাসেল)
নেশার ঘোর শব্দটা শব্দে লিখে ফেলা বা বলে ফেলা বোধহয় খুবই সহজ। কিন্তু এই অনুভূতির প্রকাশ শুধুমাত্র কোন নেশারুই কেবল বুঝতে পারে। রক্তে যখন নেশার দ্রব্য তার চূড়ান্ত মাত্রায় থাকে তখন আমার মনে গভীর সব জীবনবোধের উদয় হয়। নিজের বাবার পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমি কেন করছি? কেন লিমা বা তিতলীকে কষ্ট দিচ্ছি? আজকের পর আমি আর কোন নেশার বস্তু ছোঁব না। কিন্তু যেই আবার নতুন করে নেশার দরকার হয় তখন সবকিছু বেমালুম ভুলে পাগলের মতো কিছু খুঁজতে থাকি। আগের হাসপাতালে ডাক্তারের চিকিৎসার বাইরেও কে বা কারা যেন আমাকে নেশার ড্রাগ দিয়ে যেত। ঠেকায় পড়লেই আমি ব্যবহার ও করতাম। নতুন জায়গায় এরকম কাউকে পাইনি দেখেই বুঝিবা আমার নেশার ঘোর দিন দিন কাটছে। এখন আর আগের মত প্রতিদিন ড্রাগস লাগছেনা। তার ওপর সেদিন যখন লিমা আমাকে দেখতে এলো, আমার হাত ধরে অনেকটা সময় বসে থাকলো; প্রথমে আমি স্বপ্ন ভাবলেও পরে বুঝতে পেরে ঘুমের ভান ধরে পুরোটা সময় ওর হাত ধরে শুয়েছিলাম। ওর ভালবাসার উত্তাপটুকু আমি অনেকদিন পর বুঝতে পারি। তারপর থেকেই দিন গুনছি, কবে ছাড়া পাব? কবে আমার নিজের নতুন করে আবার একটা সংসার হবে ভেবে রোজদিন নিত্য নতুন স্বপ্ন বুনি। আমি ভেবেছিলাম এক জীবনে লিমা আর কখনোই ফিরে আসবে না আমার কাছে। সৃষ্টিকর্তা বোধহয় একচেটিয়া কাউকেই হতাশায় ফেলে রাখেন না। আর তাই জীবনের এই ক্ষণে লিমা আবার তার ভালবাসার হাত বাড়িয়েছে। আমার এই পংকিল জীবন থেকে মুক্তি দিতে ওর ভালবাসার আমার যে বড় দরকার।
লিমা বা তিতলী কে নিয়ে যখনই কোন সুখ স্বপ্ন দেখি সাথে সাথেই কোথা থেকে যেন চোরকাঁটার মতো উঁকি দেয় নাজমার নাম। কি যে এক পরীক্ষায় আমাকে সৃষ্টিকর্তা ফেললো, না চাইলেও ঐ মেয়ের কথা মাথায় আনতে বাধ্য হচ্ছি। অথচ আমি চাইলেও ওর চেহারাটুকুও মনে করতে পারিনা। কি যে এক দোটানা। আমি লিমার সাথে সংসার করতে চাইলাম কিন্তু ও অর্থাৎ নাজমা যদি তার অধিকার না ছাড়ে তবে সেই তো আমাকে আবার জীবন পথের অন্ধকারের চোরা গলিতে হারিয়ে যেতে হবে। ওর কোন খোঁজ পরিষ্কার জানিনা দেখে, সম্পর্কের ভবিষ্যত ভেবে আমার স্বপ্ন গুলো অবেলায় খেই হারিয়ে ফেলে প্রায়ই। আজ বাড়ি থেকে কেউ আসবে কি না কে জানে। কখনোই বাড়ি থেকে আসা কারো সাথে কথা বলিনা সেভাবে। যেন আমি দুনিয়ার বাইরের কেউ। আমার শুধু মনে হয় বাড়ির লোকে, বাইরের লোকে সবাই আমাকে নিয়ে বুঝি হাসাহাসি করে। হাসাহাসি করবে নাই বা কেন? মেয়েমানুষকে না হয় জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়া যায়। তাই বলে পুরুষ লোককে কেউ কোনদিন জোর করে বিয়ে দিতে শুনেছে? আমি এমনই পুরুষ লোক যার বাবার ভয়ে বাঘে মহিষে পারলে এক ঘাটে জল খায় তারই ছেলেকে কি না কেউ জবরদস্তি করে বিয়ে দিয়ে দেয়। তার ওপর যেখানে তার আগের পক্ষেও একটা সংসার, বাচ্চা আছে। আজ বাড়ি থেকে যেই আসুক সবার কথা একটু জিজ্ঞেস করবো ভাবছি।
বাড়ি থেকে আসা কেউই আমার সাথে তেমন একটা কথা বলেনা নিজ থেকে। ভয়ে নাকি কি বলবে ভেবে পায়না, তা অবশ্য আমার জানা নেই। বেশীর ভাগই আড়তের লোকজন আসে। কিছু সময় থেকে আগের দিনের বাসী খাবারের বাক্স কাপড় চোপড় নিয়ে চলে যায়। আজকে আসা ছেলেটা কে আমি আগে দেখিনি কখনো। ও একা একা যখন জিনিস গুছিয়ে নিচ্ছিল, হুট করেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি রে কি নাম তোর?’ ছেলেটা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও খুব দ্রুতই নিজেকে সামলে নিল।
‘ আমার নাম বরকত, ভাইজান। আপনের শরীরটা আজকে কেমুন আছে?’
হুম ভালো। তা তুই কি শুধু আড়তে কাজ করস নাকি আমাগো বাড়িতে ও কাম করস?
ঠিক নাই ভাইজান। দাদায় যখন যেইখানে পাডায়, হেইখানেই আমার কাম।
দাদা মানে? তোর দাদা কে?
আপনেগো আড়তের ম্যানেজার সাব আমার বাড়ি সম্বন্ধে দাদা লাগে। উনিই আমারে আপনেগো এইখানে কামে লাগাইসে। আপনের শরীরের ভালামন্দ কি ভাইজান? আপনেরে হাসপাতাল থেইকা ছাড়বো কবে?
জানিনা কিছু এখনো। আমার তো শরীর ভালাই লাগে। ডাক্তারের আর আমার বাপেরও মর্জি।
আব্বার নাম এমন করে বাইরের লোকের সামনে নিয়ে একটু যেন কেমন লাগলো, তাই কথা ঘুরাতেই সাথে সাথে বলে উঠলাম, ‘তা বাড়ির সবার কি খবর, কিছু জানিস নাকি বরকত মিয়া?’
জানুম না ক্যান? আপনেগো বাড়ি হইসে রঙের বাড়ি। সারাক্ষনই কোন না কোন তামসা হইতাসে। তয় আমার মনে লয় আপনেরে ছাড়া তামসা জমতেসে না।
আমার সাথে তো তোর আগে কখনো দেখা হয়নি। তাহলে আমাকে ছাড়া কিছু জমছে না এটা কেন বললি?
আপনের মাইয়া তিতলী সারাদিন যে কি পাকনা পাকনা কথা কয়, আপনে শুনলে সবচে মজা পাইতেন। ঠিক কইসি কি না কন? হের লাইগা কইসি আপনে থাকলে বেশী মজা হইতো।
ও বুঝছি এইবার। আর বাড়ির বাকী সবাইর কি খবর?
লিমা বুবু অহন আড়তের হিসাব নিকাশ দেহে। তাইনে আড়তে যায়না। কিন্তু বাড়িতে সব হিসাবের খাতা আমি আইনা দেই। ওনার কিছু বুঝার সমইস্যা হইলে দাদায় বাড়িত আইয়া কতা কইয়া যায়। আর নাজমা বুবু, হেয় তো বাড়ি থেইকা শহরে গেসে গা। কেউ তাইনের কোন খোঁজ জানেনা।
কবে থেইকা এইসব হইতাসে, বরকত?
এই ধরেন গিয়া আপনে এই হাসপাতালে আসনের পর থেইকা। আইচ্ছা আমি আজকা যাই। দেরী হইলে বাড়িত ফিরতে অনেক রাইত হইয়া যাইবো।
আচ্ছা যা। ভালো থাকিস।
বরকতের কথা শুনে কি যে এক প্রশান্তিতে আমার মনটা ভরে গেল তা বুঝি কাউকে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। নাজমা নিজে থেকে আমার জীবন থেকে সরে গিয়েছে, ওকে নিয়ে আমার আর না ভাবলেও চলবে, এর চেয়ে ভালো খবর এ মূহুর্তে আর আমার জন্য কি হতে পারে? শেষ পর্যন্ত লিমা আমাদের পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরছে, আব্বা অন্তত লিমার ওপর আমার করা অবহেলাটুকু এভাবে পুষিয়ে দিয়েছে ভেবে এই মূহুর্তে খুব একবার ওনাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছিল। যদিও আমাদের বাড়িতে এসব জড়াজড়ি করা ধরনের আদিখ্যেতা বাবা মায়ের সাথে নেই তারপরও মনে হচ্ছিল কতটা ভুল ছিলাম আমি সময়ে সময়ে। আমার নিজের মনে হওয়া আব্বার করা ভুল গুলো যদি তার সাথে কথা বলে নিজের মনে পরিষ্কার থাকতাম তাহলেতো আমার জীবনটা এরকম অন্ধকারাচ্ছন্ন হতোনা। কবে যে আমাকে এখান থেকে ছাড়বে? আরেকবার জীবন শুরু করার সুযোগ কি আমাকে সৃষ্টিকর্তা দেবেনা?
…………..
বরকতের সব কথার সাথে লুকানো কথাগুলো রাসেলের অবশ্য জানা হয়না। রাসেল এটাও জানতে পারেনা পুরো ব্যাপারটাই তার বাবার সাজানো নাটকের অংশ। বা বলা চলে পুরোটাই তালুকদার সাহেবের প্ল্যান করা। লিমা সেদিন হাসপাতাল থেকে আসার পর আসমা বেগমের কাছ থেকে সব ঘটনা জেনে নেন তালুকদার সাহেব। ছেলের যদি সামান্যতম মতি ফেরার ইচ্ছে থাকে তবে এই সেই সুযোগ ভেবেই বরকতকে এখন থেকে রোজ হাসপাতালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ওনার মনে হচ্ছিলো রাসেল, লিমা বা বাড়ির অন্যদের সম্পর্কে জানতে চাইতে পারে। সেক্ষেত্রে নাজমার অনুপস্থিতির খবর তার মনে অন্তত খানিক স্বস্তি দেবে বাবা হিসাবে এটা উনি খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। বরকতকে তাই কথা গুছিয়ে শিখিয়ে দেয়া হয়। অনেক লোককে নাজমার অন্তর্ধানের খবর জানিয়ে চতুর্দিকে এই ব্যাপারে আলোচনা হোক তা কিছুতেই চাননি তালুকদার। তার ওপর ওয়াদুদের দুমুখো কাজের জন্য নিজের আরেকজন ডানহাতের প্রয়োজনও হয়ে পড়েছে। বরকত ছেলেটার কাজকর্ম ও কথাবার্তা বেশ পছন্দ হয়েছে বিধায় তাকে নিজের কাছের কেউ করা যায় কি না সেরকমই ভাবছেন তালুকদার আজকাল।
…………….
।বাবারা বোধহয় এমনি হয়। নিজের সবটুকু খারাপ থাকার বিনিময়েও ছেলের সামান্য ভালো থাকার জন্য বুঝি সব বাবারাই যে কোন মূল্য দিতে প্রস্তুত থাকে। এই যে বরকত ছেলেটাকে নিজের ঘরের কিছু গোপন কথাও নির্দ্ধিধায় তালুকদার বলেছেন শুধু বরকতের মাধ্যমেও কিছু তথ্য পাওয়ার মধ্য দিয়ে ছেলের মনে যদি খানিক স্বস্তি আসে বাবা হিসাবে নিজের মনে খানিক শান্তি পাবে এই আশায়।
-ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস
চলবে……