অনুধাবন ( ১৭তম পর্ব )

(ধারাবাহিক)

( লিমা)

নাজমা বাড়ি নেই এটা আবিষ্কার হয় সকালের নাস্তা বানাতে গিয়ে। বাড়ির সবচেয়ে মুখরা ঠিকে ঝি কুলসুম এসে দেখে নাজমার ঘরের দরজা ভেজানো, কয়েকবার ডাকাডাকিতে কেউ যখন বেরিয়ে আসেনা সে তখন দরজায় আলতো ধাক্কা দিতেই দোর খুলে যায় এবং দেখে ভেতরে কেউ নেই। মূহুর্তের মধ্যে পুরো বাড়ি সেটা চাউর হয়ে যায়। আমার শ্বাশুড়ি এবং আমি দুজনেই ব্যাপারটা জানি দেখে চুপ করেই রইলাম, যেন নাজমা নামে এ বাড়িতে কখনোই কেউ ছিল না। আমার ও আমার শ্বাশুড়ীর সাথে নাজমার সম্পর্ক ভালো না সেটা সবাই জানে বলেই আমাদের আশেপাশে এসে নিজেরা নিজেরা নাজমার নাম নিলেও সাহস করে কিছু আর জানতে চায়নি কেউই। বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলেও যখন নাজমার দেখা মেলেনা তখন আমার শ্বাশুড়ীর নির্দেশেই ঘর গুছিয়ে তালা দিয়ে দেয় কুলসুম। ইতি হয় তালুকদার বাড়ি থেকে এক জনমের তরে নাজমা নামের কারো উপস্থিতি।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে একটু একটু করে ব্যবসার কাজ বুঝে নিতে আমার খুবই ভালো লাগছে। নিজেকে অন্তত খানিকটা কাজের মনে হচ্ছে। ঘরে বসে থেকে থেকে আর দুঃশ্চিন্তা করে করে যেন ভুলেই যাচ্ছিলাম মানুষের স্বাভাবিক জীবন বলেও কিছু একটা আছে। রাসেলের হাসপাতাল পাল্টানোর পর থেকে ওর নাকি বেশ উন্নতি হচ্ছে। এতো দূর যাওয়া এই শরীরে উচিত হবেনা জেনেও শ্বাশুড়িকে জানালাম আমি রাসেলকে একটু দেখতে যেতে চাই। আমার এই অনুরোধে শাশুড়ী যে খুবই খুশী হয়েছে সেটা ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে যে কেউই বলে দিতে পারবে। আসলে নিজের ছেলেকে অন্য কেউ বিশেষ করে বৌ মায়া করলে মায়ের ভালো লাগবে সেটাই তো স্বাভাবিক। একটু আমতা আমতা করলেন এই শরীরে যাওয়া ঠিক হবে কি না তা নিয়ে। কিন্তু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জানালেন উনি ব্যবস্থা করবেন।

একদমই আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে লম্বা সময় পরে যখন রাসেলের হাসপাতাল পৌঁছলাম আমি ততক্ষনে এই শীতের দিনেও ঘেমে নেয়ে একাকার। রাসেল ঘুমাচ্ছিল। ওর শীর্ণকায় কিন্তু ফর্সা মুখের দিকে তাকিয়ে আমার শুধু সেই সম্পর্কের প্রথম দিন গুলোর কথা মনে হচ্ছিলো। কি প্রগাঢ় ভালোবাসার জালে আটকে ওর হাত ধরে ঘর ছেড়েছিলাম। নিয়তির নির্মম পরীক্ষায় আজ আমাদের দুজনের মাঝে এক অদৃশ্য দেয়াল যেন দুজনকে পৃথিবীর দুই প্রান্তে ছিটকে দিয়েছে। আমি কি কখনো বুঝতে চাইনি রাসেলকে? নাকি নিজের শাড়ি গয়নার মোহ আর অপরিণত আবেগের মায়াজালে অন্ধ হয়ে ছিলাম বলে দুজনের মধ্যে দিন দিন বেড়েছে দূরত্ব। আস্তে করে পাশে বসে রাসেলের হাতে হাত রাখলাম।

ঘুমের ঔষধের প্রভাব নাকি অন্য কারণে আমার হাতের স্পর্শে রাসেল চোখ মেলে আমার দিকে কিছুক্ষণ ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে থাকলেও বুঝি বুঝতে পারেনি আমিই তার পাশে বসা। কত দীর্ঘ দিবস রজনী পরে আমি এভাবে ওর পাশে বসে ওর হাতে হাত রাখলাম তা তো আমি নিজেও ভুলে গেছি। ঘুমের ঘোরেই ওর অন্য হাত দিয়ে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রইলো। আজ আর কেন যেন হাত ছাড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হয়নি। আমার অনাগত সন্তানের পিতা, আমার মাথার ওপরে এ সময়ে যার ছায়া হয়ে থাকার কথা একে অপরের নিজেদের প্রতি নিদারুন অবহেলা আর দুজনের ভুল বোঝাবুঝিতে নিত্য গড়ে ওঠা দূরত্বের পাহাড় যদি এই হাতের ছোঁয়ায় কিছুটা কমে তবে কারো তো কোন ক্ষতি নেই। চোখ দিয়ে বুঝি গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা অশ্রুজল। যে দায়িত্ব আমার শ্বশুর আমাকে ভালবেসে দিয়েছে আমি রাসেলের হাতে হাত রেখে সেটা পালন করবো বলে নিজের কাছে নিজেই এই বেলা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলাম।

আরো প্রায় ঘন্টা দুয়েক হাসপাতালে ছিলাম। প্রায় পুরোটা সময় রাসেল আমার হাত ধরে ঘুমিয়েছে। আমার শ্বাশুড়ী পাশে বসে থাকলেও আমার কেন যেন একটু লজ্জা বা সংকোচ হয়নি আজ ওর হাত ধরে রাখতে। জন্ম জন্মান্তরের বাঁধন যার সাথে সৃষ্টিকর্তা ঠিক করে দেয় তার হাত বোধহয় যে কোন সময় এভাবেই ধরে রাখা যায় নিজের সম্পদ ভেবে। এই লোকটা যে কারণেই ড্রাগস নিক না কেন তাকে এই অন্ধকূপে আরো খানিকটা ঠেলে দিতে আমারো যে বেশ অনেক খানিক ভূমিকা ছিল এটা ভেবেই খুব খারাপ লাগছে। এটা ঠিক রাসেল আমাকে বিয়ের কিছুদিন পর থেকে আর ওভাবে সময় দেয়নি। কিন্তু আমি নিজেও তো এর কারণ খুঁজতে যাইনি। শুধু ছেলেমানুষী আবেগ ধরে রেখে আমাকে কেন সময় দেয়না এই যুক্তিতে নিজেদের সম্পর্কটাকে খাদের কিনার পর্যন্ত নিয়ে এসেছি। অথচ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে যে দুটো মানুষেরই সমান ভূমিকা রাখতে হয় সেটা বুঝতেই আমার জীবনের এতগুলো বছর পেরিয়ে গেল।

শীতের দিনের বেলা খুব তাড়াতাড়িই আলো পরে যায়, তাই শ্বাশুড়ীই তাড়া দিলেন উঠে যেতে। এখন রওয়ানা দিলেও পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাবে। পোয়াতি মেয়েমানুষ সন্ধ্যার পর বাড়ি থাকা ঠিক না বলেই রওয়ানা দিতে হাঁকডাক জুড়ে দিলেন। রাসেলকে ঘুমে রেখেই বেরিয়ে এলাম। কিছু যে এখনো খায়নি সে কথা নার্সকে জানাতেই বললো, সাধারণত দুপুর গড়িয়ে এলেই রাসেল নিজে থেকেই ওঠে। উঠলেই খাবার দেয়া হবে। রাসেলের যত্ন নেয়ার লোক তো আছেই। সকাল বেলার ঔষধ নাকি ওর এমন ঘুমের কারণ। ও আরেকটু সুস্থ হলেই ঔষধ পাল্টে দেয়া হবে। আরো জানালো ওর লিভার না কি যেন এখনো বেশ দুর্বল। যত রেস্ট নেবে ততই নাকি তাড়াতাড়ি ভালো হবে। না খেয়ে থাকাটা কত ভালো ব্যাপার না বুঝলেও ডাক্তারের নির্দেশ কিভাবে অমান্য করি। তাই আবারো রাসেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বাড়ির পথ ধরি।

কত কি যে মাথায় আসছিলো লিমার থেকে থেকে। রাসেলের সাথে সাথে ব্যবসার হাল ধরে শ্বশুরের পাশে দাঁড়াবে, বাচ্চাগুলোকে ঠিকঠাক পড়াশোনা করাবে আরো কত কি কি। মানুষের জীবনের চিন্তাভাবনার ধরন আসলে এমনই যখন কোন সুখের ব্যাপার হয় তখন আরো আরো সুখের পরিকল্পনা চোখ সাজায় যেন স্বপ্নের মতো এক জীবন আসছে সামনে। আর যখন কোন দুঃখের ঘটনা বা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় তখন ভাবে এই বুঝি জীবনের শেষ এর থেকে আর পরিত্রান মিলবেনা কোনদিন। অথচ জীবন আসলে যে দুঃখ সুখের সমষ্টিমাত্র এটা লোকে জানলেও কেন যেন মানতে চায়না। একচেটিয়া সুখ বা একচেটিয়া দুঃখ বলে যে আসলে কারো জীবনেই কিছু নেই। এক আধবার না চাইতেও বুঝি নাজমার কথা জোর করে মাথার মধ্যে চলে আসে। কেমন আছে মেয়েটা? ওর খারাপ কিছু হয়নি তো? পর মূহুর্তেই মাথায় আসে ওর শ্বশুর তো মানুষ ভালো। নিজে থেকেই নাজমার পড়ালেখার ব্যবস্থা করে দিল। নিশ্চয়ই ভালোই আছে নাজমা।

বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই স্বপ্নাতুর চোখে একটু ধাক্কা লাগে। নাজমার ঘরের বারান্দায় রেহানা তার বাচ্চাদের নিয়ে বসে আছে আর তার স্বামী আসলাম ঘুরঘুর করছে উঠোনে আমাদের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়। ঘরের চাবি যে আমার শাশুড়ীর কাছে তাই তারা চাইলেও ভেতরে ঢুকতে পারেনি। আবার অন্য কোন ঘরেও কেন বসেনি সেটাও ঠিক পরিষ্কার না। আসলামকে আমার কখনোই খুব একটা পছন্দ না। সারাক্ষণ চোখের মধ্যে একটা কুচক্রী মানুষের দৃষ্টি। যেন সারাক্ষণ কোন না কোন সুযোগের সন্ধানে থাকে।

কি ভাবী, আপনে নাকী আমার শ্বশুর আব্বার ব্যবসার লাগাম ধরসেন? মাইয়া মাইনষে টেকা পয়সার হিসাব বুঝে নাকি? অবশ্য আপনে আবার বিএ এম এ পাস। কিন্তু কি জানেন ব্যবসা করতে পড়াশোনা লাগেনা, লাগে বুদ্ধি।

কিছু বলবোনা ভেবে পাশ কাটাতেই একটু জোরেই বললাম, কুলসুম এই ঘরের তালা খুলে দাও। কতক্ষণ ধরে বাইরে বসিয়ে রেখেছো রেহানা আপাদের?

আমার কথার জবাব তো দিলেন না ভাবী। আপনার কি মনে হয় আমি ভুল বলেছি?

সারাদিনভর ক্লান্তি আর আসলামের বাঁকা কথার তোড়ে এবার আর চুপ থাকতে পারলামনা।
‘তা আসলাম ভাই আপনার তো অনেক ব্যবসায়ীক বুদ্ধি। নিজের দোকানটাই তো সামলে রাখতে পারছেন না। দুদিন পর পর নিজের দোকানে মাল উঠানোর নামে আড়তের একাউন্ট থেকে বিশ ত্রিশ হাজার করে যে টাকাগুলো নিচ্ছেন, তা একবারের জন্য ফেরত ও দেয়ার কথা মনে হয়নি। শ্বশুর আব্বা আর নিজের আব্বার মধ্যে তফাত আছে, জানেন তো? হ্যা হিসাবের খাতা আমিই দেখছি আজকাল। আপনার কাছে পাওনা টাকা কবে থেকে শোধ শুরু করবেন বলেন তো?’

এরকম কোন কথা আমি বা কোন মেয়েমানুষ মুখের ওপর তাকে বলবে এ বুঝি আসলামের কল্পনারও অতীত ছিল। আমার মুখের দিকে বিস্ফারিত নয়নে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আমতা আমতা করে পেছনে খুলে দেয়া দরজা দিয়ে আস্তে করে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল।

……………..

আসলাম বুঝি ভেবেছিল দেশে এবং কাছাকাছি থাকার সুবাদে শ্বশুর নিজের ব্যবসার ভার ওর ওপরেই ছেড়ে দেবে। কিন্তু লিমার থেকে এ ধরনের কথা শোনার পরে আর কোন সুখ স্বপ্ন মনে উঁকি দেয়া তো দূরের কথা এতোদিন ধরে আড়ত থেকে নেয়া টাকা যদি ফেরত দিতে হয় তাহলে কিভাবে সেটা সামাল দেবে তা নিয়েই বড় রকমের পেরেশানীতে পরে গেল সে। ভেবেছিল কথার জোরে স্বামীর জোরবিহীন লিমাকে বেশ একটু নাড়া দেয়া যাবে। কিন্তু এ যেন ছুটে গিয়ে গাল বাড়িয়ে থাপ্পর খেয়ে আসা। নাহ শ্বশুর আর পুত্রবধূর এহেন আচরণের একটা শাস্তি তাকে দিতেই হবে। ওয়াদুদ আর রতনের সাথে হাত না মেলালে নিজের স্বরূপ বেরিয়ে পরতে বুঝি সময় লাগবে না বেশী।

-ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

চলবে…..

https://www.facebook.com/groups/1749042645384412/permalink/2214492405506098/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *