অনুধাবন ( ১২তম পর্ব )

(নাজমা)

বিড়ালকে লোকে আরামপ্রিয় প্রানী বললেও আমার আসলে মানুষকেই সবচেয়ে বেশী আরামপ্রিয় বলে মনে হয়। শরীরের আরাম পেলে এরা নির্দ্ধিধায় মনের ব্যথায় খানিক ছাড় দিয়ে দেয়। আত্মসম্মান নামক ক্ষুদ্র মনের ঘুনপোকাও অনেক সময় নীরব হয়ে থাকে এই শরীরী আরামের কাছে। এই যেমন আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। রাসেলের সাথে আমার বিয়েটা হয়েছে অবশ্যই রাসেলের অমতে এবং যখন সে ড্রাগের মধ্যে ছিল। আমাকে তুলে নিয়ে এসেছে তাই রেখে দিয়েছে সেটা কিছুদিন হলে ঠিক আছে। তারপর আমাকে ঘাড় ধরে বের করে দেয়াটাই কি স্বাভাবিক ছিল না? একটা নিরাপদ আশ্রয় আর বেঁচে থাকার নিমিত্তে আমাকে কৌশলী হতেই হয়েছে। তাই হেঁসেলের ভার নেয়াটাই আমার কাছে বুদ্ধিমানের মত কাজ মনে হয়েছে। আমার শ্বাশুড়ি রাসেলকে নিয়ে ব্যস্ত, সতীন লিমা বুবু নিজের শরীর আর বাচ্চাকে নিয়ে ব্যস্ত, ননদ ননাসরা তাদের ঘরের পতিদেবতাকে নিয়ে ব্যস্ত সেই সময়ে কেউ যদি খাবারের যোগান নিজ গরজে ঠিক রাখে সেটা সবাই মেনে নিবে সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু কতদিন?

লিমা বুবু কি বুঝতে পারছে আমি তার চলার পথের একটা বিষকাঁটা। যদিও আমার উদ্দেশ্য খারাপ না। নিজে খেয়ে পরে টিকে থাকতে পারলেই আমি খুশী। কিন্তু উনি কেন ওনার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবে না? ওনার জায়গায় আমি হলেতো প্রথমেই আমাকে সরানোর দায়িত্বটুকু নিতাম। তাহলে কি উনি বোকা নাকি আমি আগ বাড়িয়ে বেশী ভাবছি? আমার শ্বাশুড়ি নিতান্তই ঘর গৃহস্থালী বোঝা মহিলা। কিন্তু ছেলের ভবিষ্যত চিন্তায় আমার ব্যাপারে উনি কি কিছুই ভাবেন নি? নাকি কিছুদিন আরাম পাওয়া গেছে সেই আনন্দে দুনিয়া ভুলে বসে আছেন?

গত কয়েকমাসে আমার শ্বশুরকে আমার মনে হয়েছে নিজের ব্যবসা আর নিজের সুখ ছাড়া ভেতর বাড়িতে ওনার বুঝি কোন যোগাযোগ নেই। কিন্তু সেই ভুল ভেঙেছে আমার ননাস রেহানা স্বামীর বাড়ি থেকে চলে আসার পর। প্রথম কয়েকদিন সবকিছু একটু থম ধরে থাকলেও কিছুদিন পরেই রেহানার স্বামী আর শ্বশুরবাড়ি যেভাবে পাল ধরে এসে রেহানাকে তুলে নিয়ে গেল তাতে যে ওনার হাতের ইশারা আছে সেটা তো অন্ধ লোকেও বুঝবে। তাহলে কি আপাত গাম্ভীর্যের মুখোশে নিজেকে ঢেকে রাখলেও বাবার দায়িত্ব থেকে কখনোই উনি সরে দাঁড়ান নি? তাহলে রাসেলের কেন এই অবস্থা হলো?

সকালে নাস্তার পাঠ চুকিয়ে নিজের ঘরে ফিরছিলাম। দেখলাম লিমা বুবু আমার শ্বশুরের ঘরে ঢুকছে। আমি এই বাড়িতে আসার পরে কখনো দেখিনি ওনাকে ঐ ঘরে যেতে। গত কয়েক সপ্তাহ হলো উনি নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে খাওয়ার ঘরে আসছেন। আমার সাথে কোন কথা বলেন না। আমিও বলার চেষ্টা করিনা। কি দরকার খামোখা গাল বাড়িয়ে চড় খেয়ে আসার। কারো সাথে গল্প করা ছাড়াও ঘন্টার পর ঘন্টা চুপ করে বসে থাকার অভ্যেস আমার আছে। নিজের ঘরে ফিরে আজ জানালা দিয়ে শ্বশুরের ঘরে তাকিয়ে রইলাম কখন লিমা বুবু বের হয়। নিজের মনে সদা যে ভয় কখন যে বাড়ি ছাড়ার খড়গ আমার ঘাড়ে নেমে আসে। পুরো দুনিয়ায় আমার যে নিজের বলে আসলেই কেউ নেই। নিজের যদি একটু ভালোমন্দ পড়ালেখাও থাকতো বাড়ি থেকে হয়তো পালিয়েই যেতাম।

বাড়ির রান্নার লোককে দুপুরের কি রান্না হবে সে কথা বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি। লিমা বুবু সবার শেষে খায় দেখে আমি আগেভাগেই খেয়ে চলে আসি নিজের ঘরে। হঠাৎ দেখি লিমা বুবু একটা বড়সড় ফাইল নিয়ে বেরিয়ে এলো ঐ ঘর থেকে। কি আছে ঐ ফাইলে? আলমারী খুলে নিজের নিকাহনামাটা আরেকবার শক্ত করে ধরে রাখি কিছুক্ষণ। আমার মাথার ওপরের নিরাপদ ছাদের দলিল যে ওটাই। দরজায় খুটখুট শব্দে তাড়াতাড়ি আলমারী আটকে বেরিয়ে আসি।

‘চাচাজানে আপনেরে ডাকে ভাবী। এক্ষুনি যাইতে কইসে।’ বাড়ির ঠিকে ঝি এইটুকু বলে আর দাঁড়ায়না। পিছু ফিরলে দেখতে পেত আমার আতংকিত ফ্যাকাসে চেহারা। কি বলবে উনি আমায়? যদি তাড়িয়ে দেয়, আমি কোথায় যাব? কার কাছে যাব? কোনরকমে শাড়ি সামলে চোখ মুছে পা বাড়াই শ্বশুরের ঘরের দিকে। আমি এতোদিনেও কখনো এই ঘরে আসিনি। আমাকে কেউ কখনো এই ঘরে ডাকেনি। উল্টাপাল্টা কি না কি কথা শুনতে হয় তাই নিজেকে আলগোছে রেখেই দিন পার করাটা আমার কাছে বুদ্ধিমানের মতো হতো। নিজের কাজটুকু করে এসে আপনমনে নিজের ঘরেই সময় কাটাতাম। এমন কি রেহানা যখন আসে বা তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা, আমাকে তো কেউ ডাকেইনি বরং যেন সন্তর্পনে সবার থেকে আমাকে আলাদা রাখতেই সবাই ব্যস্ত ছিল। যদিও সবার রান্নার দায়িত্বটুকু কিন্তু আমারই ছিল।

আসো মেয়ে ভেতরে আসো। তোমার নাম তো নাজমা, তাই না?

প্রভাবশালী লোকে বুঝি এভাবেই কথা বলে জাহির করতে চায় আমি তোমার সম্পর্কে তেমন কিছু জানিনা, নাম শুনেছি আর কি! নিজের চিন্তার জাল দূরে ঠেলে জবাব দিলাম, জ্বি, আমার নাম নাজমা আক্তার। বারবার শুধু মনে হচ্ছে এই লোকটার এত প্রভাব প্রতিপত্তি, কিন্তু দেখেতো সাধারণ মানুষই মনে হয়। শুধু যখন কথা বলে তখন কন্ঠের গাম্ভীর্যে বোঝা যায়, এদের সাথে সমীহ করেই কথা বলতে হয়।

আমি সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি। আমি শুনেছি তুমি পড়াশোনায় ভালো ছিলে। সায়েন্স থেকে কলেজ পাস দিয়েছো। তোমার সার্টিফিকেটগুলো কি তোমার কাছে আছে, না তোমার বাপের বাসায়?

কোনদিক থেকে কথা বলতে চাচ্ছে বা কি বলতে চাচ্ছে ঠাহর না পেয়ে ওনার কথার সাথে চিন্তার তাল রাখতে পারছিলাম না সেভাবে। আস্তে করে জানালাম, ‘আমার কাছেই আছে।’

আমি চাই তুমি রাসেলের জীবন থেকে সরে দাঁড়াবে। আমি চাইলে তোমাকে সরিয়ে দেয়া খুব কঠিন কিছু না। কিন্তু তোমার সম্পর্কে যতদূর জেনেছি তোমার মাথার ওপর কেউ নেই। বেঁচে থাকার মধ্যে আছে এক সৎ মা। যে যথার্থই সৎ মা। তোমাকে এক নেশারুর গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে বেড়াল পার করেছে। যা বললাম তা কি সত্যি?

কি জবাব হয় এমন নিদারুন সত্য কথার। শুধু মাথা নেড়ে হ্যা বললাম।

আমি চাই তুমি আবার পড়ালেখা কর। তোমার পড়াশোনার সব খরচ আমি দেব। তবে তোমাকে শহরে পাঠিয়ে দেয়া হবে। বিনিময়ে তুমি আমার ছেলেকে তালাক দেবে। তোমার পড়া শেষ হয়ে একটা ভালো কোন কাজ না পাওয়া পর্যন্ত খরচ আমি টানবো। তুমি হয়তো বলতে পারো কেন আমি তোমার পেছনে এতো খরচ করবো? চাইলেই আমি কোন শর্টকাট পথ বেছে নিতে পারি। আমি করবো বাবা হিসেবে আমার ছেলের ভুলের মাশুল কাটাতে।

আমি বুঝে গেছি আমাকে যা বলা হয়েছে এটার কোন অন্যথা হবেনা। একবার এই বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলে আমার আর ফেরার কোন উপায় ও থাকবেনা। কিন্তু কি করার আছে আমার? এই লোক যা বলেছে তার অন্যথা সে করবে না। কাজেই আমার মেনে নেয়া ছাড়া আর যে কোন উপায় ও নেই। তারপরও শেষ চেষ্টা হিসাবে বললাম, শহরে যেয়ে আমি থাকবো কোথায়? আর আপনি যদি পরে আমার পড়ালেখার খরচ না দেন, তখন আমার কি হবে?

শোন মেয়ে, তালুকদার এক কথার মানুষ। সে যা বলে তা করে। লোকে ঘুরায়ে তারে কোনদিন বলতে পারে নাই আপনে কথা দিয়া কথা রাখেন নাই। আমার এক বন্ধু আছে শহরে। তোমার সাথে আমার লোক যাবে শহরে। তোমাকে বিএসসি কোর্সে ভর্তি করায়ে হোস্টেলে উঠায়ে পুরা বছরের খরচ দিয়া আসবে। সেই বন্ধু হবে তোমার লোকাল অভিভাবক। তারপরও যদি তোমার কোন বাড়তি খরচ লাগে আমারে জানাবা। খরচ পৌঁছায়া যাবে। তোমাকে আমি তিন মাস সময় দিব। এর মধ্যে উকিলের কাজ গোছানো হবে। তিনমাসের মধ্যে উকিল নোটিসে তুমি সাইন করে দিবা। মামলা ডিসমিস। বোঝা গেসে?

জ্বি বোঝা গেসে। আমি এখন কি করবো তাহলে?

তোমার জিনিস পত্র গোছাও আস্তে ধীরে। কাল আমার ম্যানেজার লোক পাঠালে তোমার সার্টিফিকেটগুলা দিয়া দিবা। তোমার ভর্তি নিশ্চিত হওয়ার এক দুইদিনের মধ্যে আমার লোক তোমাকে জায়গামত পৌঁছিয়ে দিবে। আরেকটা কথা,তোমার রান্নার হাত ভালো। গত কয়েকদিন রান্না খেয়ে তৃপ্তি পেয়েছি।

জীবনে আরেকবার মেয়েমানুষ হওয়ার জন্য নিজেকে ধিক্কার দিলাম। এই শরীরটা কুকুর শেয়ালের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখতেই না এত দুঃশ্চিন্তা। যেই আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তির কথা ভেবেছি বহুবার সেই আমিই যখন মুক্তি পাওয়ার ব্যবস্থা হলো তখন আতংকে অস্থির হয়ে গেলাম। যদি আমাকে রাস্তায় নিয়ে কোথাও ছেড়ে দেয়? যদি আমাকে কোন খারাপ জায়গায় বেঁচে দেয়? আমি কার কাছে আমার এই দুঃখের কথা বলবো। আল্লাহ আমাকে এতো বড় দুনিয়ায় একা করে না পাঠালে কি পারতো না?

জীবন মানুষকে নিয়ে কত পদের খেলা খেলে। কেউ যখন জীবনে প্রাপ্তির স্বপ্ন সুখে ভাসে কেউ হয়তো তখন দুঃসহ নিদ্রাহীন রাত কাটায়। রাসেলের মতো ব্যক্তিত্বহীন নেশারুর সাথে জীবন জড়িয়ে এখন তালুকদারের হাতের পুতুল হয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে লিমা, নাজমা দুজনকেই। জীবন মৃত্যু নিয়ে যে সৃষ্টিকর্তা খেলা করে তার কি দুঃখী লোকের জন্য শুধু নিত্য নতুন দুঃখের পসরাই সাজানো থাকে?

চলবে..

-ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

https://www.facebook.com/groups/1749042645384412/permalink/2211169602505045/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *