বসার ঘরের সোফায় বসে আনিস কাঁদছে ।
আনিস আমার স্বামী । আমি দুইকাপ চা বানিয়ে রান্নাঘরের পাশে বারান্দাটায় এসে বসেছি । এক কাপ চা আনিসকে দিতে গিয়েছিলাম বসার ঘরে ।আনিস কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে তবুও আমি গিয়েছিলাম ওর পাশে বসে চা খাব বলে । কিন্তু আনিসের কান্না আমাকে স্পর্শ করছিল । আমার চোখের কোনে পানি জমতে শুরু করছিল । আমি দুকাপ চা নিয়েই বারান্দায় এসে বসেছি। আমি আরাম করে গরম চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি । আজকে কেমন জানি একটা তৃপ্তি অনুভব করছি মনে আর শরীরে ! ঠিক করেছি পর পর দু কাপ চা খাব , তিন কাপও খেতে পারি !
পঁচিশ বছর আগে আনিসের সাথে আমার বিয়ে হয়। আমি ছিলাম বাবা মা’র বড়মেয়ে । আমার ছোট আরো তিনটা বোন ছিল। আমার মধ্যবিত্ত বাবা সারাজীবনের সঞ্চয় আর ধারদেনা করে ধুমধাম করে তার বড় মেয়ের বিয়ে দেয়। আমার চাকুরীজীবী বাবা বাড়িভাড়া , আমাদের চার বোনের পড়ালেখার খরচ, সংসারের খরচের পর হয়ত নিজের সাধআহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে পাই পাই করে আমার বিয়ের জন্য টাকা জমিয়েছিল। বাবা মাসের পর মাস এক জোড়া স্যান্ডেলই পড়ত । হাতেগোনা কয়টা মাত্র শার্ট ছিল বাবার । প্রতি ঈদে একটাই পাঞ্জাবি মাড় দিয়ে ইস্তিরি করে ঈদের নামাজ পড়তে যেত । রিকশার ভাড়াটুকু বাঁচানোর জন্য , দু হাতে ভারি বাজারের ব্যাগ নিয়ে হেঁটে ঘরে ফিরে , ডকডক করে ঠাণ্ডাপানি গলায় ঢালতে ঢালতে , হাসিমুখে হাঁটার উপকারিতা বর্ণনা করত বাবা। বাবারও হয়ত ইচ্ছে করত , মাঝেমাঝে মা কে নিয়ে সমুদ্র দেখতে যেতে , আরাম করে রেস্টুরেন্টে খেতে । অন্তত এতটুকু বিলাসিতা ভোগ করার মত ইনকাম করার পরও চার মেয়ের বিয়ের সঞ্চয় করতে গিয়ে নিজেদের জীবনের সুন্দর সময়গুলোকে ছাইচাপা দিয়ে রেখেছিল আমার মধ্যবিত্ত বাবা মা !!
ছিমছাম শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে দেখেই আমাকে তাঁদের একমাত্র ছেলের বউ করে নিয়ে আসে আমার উচ্চবিত্ত শ্বশুর শাশুড়ি।বিয়ের সময় মা বাবা বারবার বলে দিয়েছিল সব কিছু নিয়ে মাথা না ঘামালে চলবে আমার ! সারাজীবন মা বাবার একান্ত বাধ্যসন্তান হয়ে থাকা এই আমি বিয়ের পরও শ্বশুরবাড়ি আর স্বামীর একান্ত বাধ্য হয়ে রইলাম। বড়দের কথায় নাক না গলানো এই আমি শান্ত ঝাপসা চোখে শুধু আমার ক্লান্ত বাবা মা কে হাসিমুখে সমাজের লিখিত অলিখিত সবধরনের রীতিনীতি মেনে চলতে দেখে যেতাম ।
আমার বিয়ের ঠিক দেড়মাস পর ছিল কোরবানি ঈদ । বিয়ের খরচ সামলে উঠার আগেই রীতিনীতির বোঝা টানতে কাহিল আমার বাবা নিজের কোরবানি অন্যের সাথে শেয়ারে করলেও সমাজের রীতিঅনুযায়ী আমার শ্বশুরবাড়িতে গরু দিতে ভুল করল না । তারপর আবার শেয়ারের গরুর আস্ত রানটাও সেই রীতিনীতিরই একটা অংশ ছিল !! মাঝেমাঝে আমার অবাধ্য চোখদুটো যে ঝাপসা হতোনা তা না । শাশুড়ির নির্দেশে বাবার ভ্যানভরে আনা রীতিনীতির থলে থেকে প্রতিবেশীদের বিলি করতে গিয়ে এই অবাধ্য চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে উঠত বারবার। লোক দেখানো রীতিনীতির যাঁতাকলে পিষ্ট আমার অসহায় বাবার আনা উপহার সামগ্রীগুলো যে আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারের দুই মাসের খরচ !! ভেবে ভেবে আমার মনটা দমে যেত ।
সকলের চোখে ভীষণ আধুনিক মনমানসিকতার এই আমি “কেন মেয়ে হয়ে জন্মালাম (!)” বলে নিজেকে হাজারবার ধিক্কার জানাতাম মনে মনে ।
এরপরও শত শত সামাজিক রীতিনীতির ধারালো শাবল দিয়ে আমার বাবাকে এফোঁড় ওফোঁড় হতে দেখতে দেখতে লুকিয়ে কেঁদে বুক ভাসাতাম আমি। সেই সময়গুলোতে মাঝে মধ্যে ফোলা চোখ আর মুড অফ দেখে আমার মতোই তার বাবা মা র একান্তবাধ্য আমার স্বামী আনিস আমাকে স্বান্তনা দিত এই বলে যে , ” সমাজের রীতিনীতির উপরে কেউ যেতে পারেনা ! সমাজে থাকতে হলে এসব মানতে হয় ” !! হায়রে সমাজ !!
তখন শুধু অতি গোপনে মনেমনে একটা অভিশাপ দেবার মত দুঃসাহস ছিল আমার ! যেন একটা কন্যাসন্তান অন্তত আসে এই পরিবারে । যেন এই নোংরা সমাজের নোংরা রীতিনীতির নোংরামোটুকুর মুখোমুখি হবার সুযোগ দেয় সৃষ্টিকর্তা এই পরিবারকে !!
সৃষ্টিকর্তা অবশেষে আমার সেই মনের ইচ্ছেটুকু পূর্ণ করেছিল । বিয়ের ঠিক দুবছর পর আমার আর আনিসের প্রথম সন্তান আসে । আমাদের একটা কন্যাসন্তান হয়। অতিআদরে আহ্লাদে বড় হতে থাকা আমাদের মেয়েটা পড়াশুনার পাশাপাশি ঘরের আর বাইরের সব ধরনের অন্যায়ের সাথে প্রতিবাদ করারও শিক্ষা পায় নিজের পরিবার থেকে।
মাত্র ছয়মাস আগে আমাদের মেয়েটার বিয়ে হয়েছে। খুব ভাল ইনকাম করা আমার স্বামী আনিস প্রচুর খরচ করে , ধুমধাম করেই মেয়ের বিয়ের আয়োজন করে। মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে দামী দামী সব উপহার পাঠিয়ে সমাজে নিজেদের পরিবারের মাথা উঁচু রাখার প্রতিযোগিতায় থাকা আনিস ভুলে যায় সে লোকদেখানো রীতিনীতির নামে অন্যায় করছে !! বিত্ত দেখানোর নোংরা নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা আনিস ভুলে যায় , ” একটা অন্যায় হাজারটা অন্যায়ের বীজ বুনে ” !
আনিসের ক্রমাগত এই অন্যায় মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে লোভের জন্ম দেয় !! ওরা একের পর এক আবদার করতে থাকে । অতি আদরে আহ্লাদে বড় হওয়া আমার সাহসী মেয়ে এইসব অন্যায় মেনে নিতে রাজি হয়না । আমাদের সাহসী মেয়েটা সমাজের এই নোংরা নিয়মের কাছে , লোভের কাছে মাথা নত করতে অস্বীকার করে।
” আমার বাবার কাছে আছে বলেই যে দিতে হবে তার কোন মানে নাই ।যতদিন তোমাদের মনমানসিকতা বদলাবেনা ততদিন আমি এই ঘরে আসব না ” বলে একবস্ত্রে আমাদের মেয়েটা তার বাবা মা র কাছে চলে আসে ।
আমি অবাক হয়ে পঁচিশ বছর আগের ব্যর্থ ‘আমি’ কে ঘুরে দাঁড়াতে দেখি ! আমি মুগ্ধহয়ে আমার বলতে না পারা , বুকের গভীরে চেপে রাখা যন্ত্রণাকর কথাগুলো বেড়িয়ে আসতে দেখি !! আমি দেখি , সময়ের কাছে সবাইকেই একসময় মাথা নোয়াতে হয় !
প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিতে ভুলেনা ।
আনিস বুক ফুলিয়ে মেয়ের বাহাদুরির কথা বলতে আসে আমার কাছে । ” এই সমাজের প্রতিটা মেয়ে আমার মেয়ের মত হলে সমাজ বদলে যাবে ” বলে আনিস তৃপ্তির হাসি হাসে ।
আমি আনিসের চোখে চোখ রাখি । আমি বরফঠাণ্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আনিসকে বলি ,
” আমি যদি আমার মেয়ের মত হতাম , তাহলে হয়ত আমার বাবা মা অনেকগুলো বছরধরে এই নোংরা সমাজের নোংরা সব রীতিনীতির এফোঁড় ওফোঁড় থেকে বেঁচে যেত !! পঁচিশবছর আগে আমি যদি সমাজের লোভী বিত্তশালীদের মুখে থুথু দিয়ে তাদের অন্যায় আর লোভটুকু দেখিয়ে দিতে পারতাম , তাহলে অন্তত দীর্ঘ পঁচিশবছর ধরে বুকে প্রতিশোধের আগুন নিয়ে অপেক্ষা করতে হতনা আমার। আজকের এই দিনের আনন্দ আমাকে আঘাত করছে । ব্যর্থ এক কন্যাসন্তান হিসেবে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে ” !!
আমার শান্ত কণ্ঠের কথাটুকু বিষাক্ত হুল হয়ে আনিসের বুকে আঘাত করেছে !! আনিস কাঁদছে ! আনিস আমার কথায় অনুতপ্ত হয়ে কাঁদছে নাকি অপমানিত হয়ে কাঁদছে জানি না ।
আনিস কাঁদুক, আমি পর পর দু কাপ চা খাব তৃপ্তি করে । অনেক অনেক দিনপর আমার অবাধ্য চোখ দুটো আবারও ঝাপসা হয়ে আসছে প্রতিশোধ দেখার তৃপ্তিতে।
-তাসলিমা শাম্মী