-আব্বা আজকে আমরা কি দিয়া ভাত খামু??
-আজকে আমরা ইলিশ দিয়া ভাত খামু বাবা!!
-ইলিশ দিয়া?? তুমি না কইছো ইলিশ মাছে অনেক কাডা আব্বা?? আমি কি কাডাআলা মাছ খাইতে পারমু আব্বা??
-কাডা হইলেই কি?? আমি তোমারে মাছ বাইছা দিবো বাবা!! ছেলেকে মাছ বেছে দেয়ার কথা বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সোলেমান মিয়াঁ!! কারন সে শত চেষ্টা করেও ছেলেকে মাছের কাঁটা বেছে দিতে পারবে না!! তিন বছর আগে এক এক্সিডেন্টে তার দুই হাত হারিয়ে এখন প্রায় অচল সে!! নিজের এই অসহায় জীবন তার দিনে দিনে খুব অসহ্য হয়ে উঠছে আর তার পা কাটা না লাগলেও খুব একটা শক্তি তার দুই পায়ের একটাতেও এখন আর নাই!! নাহয় কবে সে এই জগত সংসারের মুখে লাথি মারে!!
-আব্বা সত্যিতো ইলিশ দিয়া ভাত খামু?? তুমি রোজ মাছের কথা, মাংসের কথা কও কিন্তু মাছ মাংস আর খাওয়াও না!! গতদিন কইলা মাংস দিয়া ভাত খামু!! আমি সারাদিন হাত ধুইয়া বইসা ছিলাম আর মায় খালি ডাইল দিয়া ভাত দিছে!! আইজকা যদি মাছ না খাওয়াও আমি কিন্তু ভাত খামু না!! সত্য ভাত খামু না!!
সোলেমানের হাত না থাকলেও, পা দুটা প্রায় অবশ হলেও চোখ দুটা কিন্তু ঠিক সচল!! ছেলেটার কথা শুনলে সোলেমানের সেই সচল চোখ সব সময় ভিজে উঠে!! তার কষ্ট আরো বাড়ে যখন এই চোখের পানি ছেলেকেও দেখাতে হয়!! আর বুকটা ফেটে যায় যখন তার ছয় বছরের ছেলেটা তার ছোট ছোট হাতে বাবার চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে, আব্বা ইলিশ মাছ ভালো না!! আমি মাছ খামু না আব্বা!! মাছে খালি কাডা ভরা!! আমি আর মাছ খামু না আব্বা!!
তবে আজ ইলিশের ব্যবস্থা তার ঘরে হবে!! কারন আজ তার ঘরে মেহমান এসেছে!! ঘরে মেহমান আসলে সোলেমান ছেলেকে নিয়ে ঘর থেকে অনেক দূরে কোথাও চলে আসে!! প্রায় সময় ছেলেটা তাকে প্রশ্ন করে, আব্বা ঘরে কারা আসে?? সে উত্তর দেয়, ঘরে মেহমান আসে!!
-আব্বা মেহমানের সাথে আমরা দেখা করি না কেন??
-আমি পঙ্গু মানুষ যে বাবা!! তাই মেহমানের সামনে যাই না বাবা!! লজ্জা করে!!
-আমিওতো মেহমানের সাথে দেখা করতে যাই না আব্বা!!
-তুমি আমার লগে না থাকলে আমি গল্প করমু কার লগে বাবা?? তাই তোমারে আমার সাথে নিয়া আসি!!
আজ ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে একটু বেশি দেরি হয়ে গিয়েছে সোলেমানের!! ঘরে এসে দেখে রাহেলা রান্না ঘরের চুলায় রান্না চাপিয়েছে!! খুব ইচ্ছা করছে কাছে গিয়ে একটু কথা বলতে, কি রান্না চাপিয়েছে একটু দেখতে!! কিন্তু যেদিন ঘরে মেহমান আসে সেদিন রাহেলার মন মেজাজ খুব খারাপ থাকে!! অল্প কথায় রেগে যায়!! এমনি অবশ্য সে খুব ভালো মেয়ে!! নাহয় এত কষ্টের সংসারে কেউ থাকে?? কার এত ঠেকা পরেছে ল্যাংড়া লোকের সাথে ঘর করার??
ঘরের মেঝেতে পাটি বিছিয়ে রাহেলা ভাতের প্লেট রাখতে রাখতেই তার ছেলে জেনে গিয়েছে আজ তার ঘরে ইলিশ রান্না হয়েছে!! সেই আনন্দে ছেলেটা ছটফট করছে!! বারেবারে হাত ধুতে যাচ্ছে আর আসছে সে!! ছেলের ছটফট দেখে রাহেলা একটা ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেলো!! দুইদিন আগে ছেলেটা জ্বর থেকে উঠেছে, একটু ভালো মন্দ যে ছেলেটাকে খাওয়াবে সেই অবস্থা রাহেলার সংসারে নাই!! মেহমান আসলে তার মন মেজাজ খারাপ থাকলেও আজ সে একটু খুশি কারন আজ সে কিছু টাকা বেশি পেয়েছে!! সেই টাকাতেই ইলিশ আনা হয়েছে!! যদিও এই ইলিশ খাওয়ার মত বিলাসিতার ফল অনেকদিন তাকে ভোগ করতে হবে সে জানে!! তবুও ছেলেটা একটু পেট ভরে ভাত খাক আজ!!
রাহেলার ছেলেটা হাত ধুয়ে আসলেও সে তার মায়ের হাতেই ভাত খাচ্ছে!! একটা মাছে এত কাটা থাকে যে কিভাবে সে ভেবেই পাচ্ছে না!! তার মধ্যে তরকারিটাও হইছে ঝাল!! তার মা এক নলা ভাত মুখে দেয় আর সে একটু করে পানি খায়!! যদিও সে ভেবেছিল কাঁচামরিচ খাবে ভাত দিয়ে তাই হাতে একটা কাঁচামরিচ নিয়েছিল সে কিন্তু তরকারি যে এমন ঝাল হবে বোঝে নাই সে!! তাই মরিচটা হাতে করেই রেখে দিয়েছে!!
সোলেমান চুপচাপ দূরে বসে ছেলের খাওয়া দেখছে!! ছেলের খাওয়া শেষ হলেই রাহেলা তাকে ভাত বেড়ে খাইয়ে দিবে!! ছেলেটার এত আরাম করে খাওয়া দেখে তার ক্ষুধাও বেড়ে যাচ্ছে!! রাহেলারও ক্ষুধা লাগার কথা, কাল রাতে ভাত খায় নাই সে, ক্ষুধাতো লাগারই কথা!! খুব ইচ্ছা করছে রাহেলাকে বলতে, রাহেলা এই প্লেটেই ভাত আরো বেশি নাও, আমরা তিন জনেই এক সাথে খাই!! তবুও বলতে গিয়ে চুপ হয়ে গেলো সে!! যদি রাগ করে কিছু বলে বসে সে? ঘরে মেহমান আসলে মেয়েটার মন মেজাজ একটু বেশি খারাপ থাকে!! এছাড়া অবশ্য সে খুব ভালো মেয়ে!! নাহয় কার এত ঠেকা পরেছে ল্যাংড়া লোকের সংসার করতে??
আধুনিকতা থেকে বহু দূরে এক গ্রামে রাহেলার সংসার!! সে গ্রামে এখনো বিদ্যুৎ স্পর্শ করে নাই তাই সূর্য ডোবার পরে কুপির আলোতেই আলোকিত হয় রাহেলার সংসার!! সেই আলোতে মেহমানদারি করতে করতে ক্লান্ত ঘামে ভেজা রাহেলার ঝলমলে মুখটা দেখে সোলেমানের খুব ইচ্ছা হয় রাহেলার মুখটা একটু মুছে দিতে!! আর তা ভাবতে ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে!!
-মোঃ ফজলে খোদা রায়হান