বেশ ক বছর আগের কথা, আমরা তখন সেইন্ট জর্জের ছোট একটা বাসায় থাকি। আমার ছেলের বয়স পাঁচ, মেয়ে তখনো জন্মায়নি। সামান্য বেতনের চাকরি, মাস শেষে টানাটানিতে পরে যাই । বাসে-ট্রেনে করে অফিসে যাই, ট্যাক্সি নেয়া তখন বিলাসিতা।
ছোট বাসা বলে বাসায় গেস্ট-টেস্ট তেমন ডাকা হয় না। একদিন আমার বন্ধু হাবিব ঢাকা থেকে ফোন করল। ওর ভাতিজি আর তার জামাই সিঙ্গাপুরে আসবে ডাক্তার দেখাতে, সপ্তাখানেক আমাদের বাসায় থাকবে। বাসায় থাকার কথা শুনে আমি আমতা আমতা করেও কিছু বলতে পারলাম না।
আমার তখন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার অবস্থা। খাবর-দাবারের কোন সমস্যা নেই কিন্তু ওরা থাকবে কোথায়? দুই রুমের ফ্ল্যাটের একটায় আমরা থাকি আরেকটায় আমার ছেলে থাকে। তার রুমে সিঙ্গেল খাট, তাও আবার ডাবল ডেকার। ডবল ডেকার না কিনলেও চলতো, কিন্তু কণা বাঁধ সাধল। তার আবার বিষয় বুদ্ধি আমার চেয়ে ভাল।
কণা ইঙ্গিত দিল অদূর ভবিষ্যতে ডাবল ডেকারই লাগবে। শ’দুয়েক ডলার বাড়িয়ে দিয়ে যদি ডাবল ডেকার পাওয়া যায় মন্দ কি। তাছাড়া ডাবল ডেকারে বই-পত্র রাখার সিস্টেমও আছে, একের ভেতরে তিন অপশন পেয়ে যাচ্ছি। মন্দ কি?
আমি কনভিন্স হলাম। না হয়েই বা উপায় কি! সংসারে শান্তি বজায় রাখতে হলে গৃহকর্তীর কথার ওপর কথা না বলাই ভাল। আমার স্ত্রীর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় ডাবল ডেকার কেনা হয়েছে। শান্তনু কখনো উপরে ঘুমায় কখনো নীচে।
কিন্তু ডাবল ডেকার খাট কোন দম্পতির জন্য জুতসই না। কিভাবে কি হবে বুঝতে পারছি না। এর মধ্যে হাবিব ফোন দিয়ে বলছে দোস্ত বাসায় নামাজের বিছানা আছে? দুইটা নামাজের বিছানা লাগবে, ভাতিজির জামাই আবার হুজুর মানুষ, পর্দানশীন ফ্যামিলি।
মনটা আরও ভেঙ্গে গেল। আমার চেয়ে বেশি ভাঙল কণার। উটকো লোক তার অপছন্দ। তার ছোট সংসার সে নিজের মতো করে চালায়। দৈন্যতার মধ্যেও নিজের মতো করে চলার স্বাধীনতাকে সে উপভোগ করে। সেখানে অজানা-অচেনা কারো কাছে সংসারের খুঁটিনাটি হাঁ হয়ে থাকবে এটি সে নিতে পাড়ছে না।
হুজুর-পুরোহিত এদের শিক্ষা-জ্ঞান নিয়ে আমার সংশয় আছে। শুধু মাত্র ধর্ম শিক্ষায় মানুষ কখনো পূর্ণাঙ্গ মানবিক মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। এরা কথায় কথায় মানুষকে বয়ান দেবে। এটা করা পাপ ওটা করা পাপ, এটা খাওয়া হারাম ওটা খাওয়া হারাম, নানা রেসস্টিকশনে স্বাভাবিক জীবনের ছাল-বাকরা তুলে ফেলে। জীবনের সব চাওয়া পাওয়া দোজখ আর বেহেশতের চাবি-কাঠিতে গিয়ে ঠেকে। যেন এ ছাড়া পৃথিবীতে আর কিছুই জানার নেই কিছুই বোঝার নেই।
আর আছে ঘৃণা – ভিন্ন মত, ভিন্ন ধর্মের মানুষ এদের একেবারেই অপছন্দ, অন্য ধর্মের বিশোদগার করা এদের পরমব্রত। যে মানুষটা হিন্দুর ঘরে জন্মাল কিংবা খ্রিস্টানের ঘরে জন্মাল এতে তো তার কোন হাত নেই। সৃষ্টিকর্তা নিজেই সেটা ঠিক করে দিয়েছেন কিংবা যা হচ্ছে প্রকৃতির নিয়মেরই হচ্ছে। এজন্যে এক্সট্রিম হবার কোন দরকার নেই, ঘৃণা করার দরকার নেই।
রবীন্দ্রনাথ যে বলে গেছেন, ‘দেবে আর নেবে মিলিবে মেলাবে’ সেই তো চলছে সারা পৃথিবী জুড়ে এই দেয়া নেয়ার খেলা। বাংলাদেশ যে কাপড় বানিয়ে ইয়োরোপ-আমেরিকায় বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে, সে মুদ্রায় শ্রমিকের বেতন দেয়া হয়, শ্রমিক-মালিক সেই বিদেশী মুদ্রায় খেয়ে-পরে বাঁচে, দেশ এগোয়। মালয়েশিয়ায় উৎপাদিত পামওয়েলের বড় মার্কেট হল ইন্ডিয়া। এভাবেই চলছে পৃথিবী। গ্লোবালাইজেশনের যুগে পৃথিবীর সবাই একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। সেখানে কে হিন্দু কে খ্রিস্টান আর কে মুসলিম এটার বিভাজন করতে যাওয়া বোকামি।
আমি মনে হচ্ছে গল্প থেকে দূরে সরে যাচ্ছি, গল্পে ফিরে যাই। হাবিবের ভাতিজি মেঘনা আর তার হাসবেন্ড মবিন এসে বাসায় পৌঁছেছে। মেঘনাকে দেখে আমি চমকে গেলাম। চোখ ছাড়া পুরোটাই কালো বোরখায় ঢাকা, হাতে পায়েও মোজা।
ছেলেবেলায় এ মেয়েটিকে দেখেছি, ভীষণ দুরন্ত ছিল। বাড়ির লনে সাইকেল চালাতো, ঈদের সময় আমাদের বাসায়ও বেড়াতে এসেছে কয়েকবার। এ রকম এক চটপটে মেয়েকে এ অবস্থায় দেখব ভাবিনি।
মবিনের বয়স ২৭-২৮ হবে। টুপি-দাড়ি সুরমা পাঞ্জাবীতে তার বয়স দেখায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। অতিথি নাকি ঈশ্বরের রূপ ধরে আসে, এটা হাতে নাতে প্রমাণ পাওয়া গেল। মবিন আর মেঘনাকে আমরা ঈশ্বরের প্রতিভূ হিসেবেই গ্রহণ করলাম। ওদের জন্যে বরাদ্দ হয়েছে আমাদের বেডরুম। আর আমাদের জন্যে ছেলের রুমে ডাবল ডেকার খাট।
ডাবল ডেকার যে ত্রিপল ডেকার এটা আমার মনে ছিল না। খাটের তলা থেকে টেনে আর একটা পোর্টেবল ম্যাট্রেস বের করা যায়। সেই পোর্টেবল ম্যাট্রেস কণা, তারপর আমার ছেলে শান্তনু আর উপরের তলায় আমি ঘুমব, উত্তম ব্যবস্থা।
এ ব্যবস্থায় আমার ছেলে খুব খুশি, বাবা-মা তার রুমে ঘুমবে এটা তার কাছে এক ধরনের উৎসবের মতো। মবিন প্রথমে কাইকুই করলেও রুম বরাদ্দের ব্যবস্থাপনা মেনে নিল দুটি কারণে, এক হল আমাদের বেডরুমে অ্যাটাচ টয়লেট। ডাবল ডেকারে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠানামা করাটা তার জন্যে মুশকিল। হাত-মুখ ধুয়ে ডিনার করার কথা বলতেই মবিন বলল, আঙ্কেল আমরা পুরুষরা আগে বসে খায়া নেই আর মেয়েরা পরে বসুক।
সমস্যা কি, সবাই একসঙ্গে ডাইনিং টেবিলে বসি।
সমস্যা আছে আঙ্কেল, আপনের অ্যান্টির পর্দার সমস্যা।
এতক্ষণে আমার খেয়াল হল মেঘনা একবারও লিভিংরুমে আসেনি সে যে এসে বেড রুমে ঢুকেছে আর বের হয়নি। তার মানে এরা কঠিন পর্দা মেনে চলে, ১০০% অবরোধবাসিনী। আমি বললাম, কোন সমস্যা নাই।
তাইলে আমরা পুরুষরা আগে বইসা যাই।
আমার ছেলে বলে, পুরুষ মানুষ কি আঙ্কেল?
পুরুষ হইল Man, ছেলেমানুষ। আর তোমার অ্যান্টি হইল লেডিস, মেয়েমানুষ।
ছেলেমেয়েরা কি একসঙ্গে খেতে পারে না?
অবশ্যই পারে, এক ফ্যামিলির হইলে কোন সমস্যা নাই, জায়েজ।
কি নাম তোমার?
আমার নাম শান্তনু।
এইটা আবার কি রকম নাম, হিন্দু নাম মনে হইতাছে, নামের আগে মুহাম্মদ নাই?
কণা খাবার এনে টেবিলে রাখছিল, মবিনের প্রশ্নে কণা আড়চোখে আমার দিকে তাকাল।
আঙ্কেল ছেলেরে কি মুসলমানি দিছেন?
আমার ছেলে আগ বাড়িয়ে বলে, আমার মুসলমানি হয়েছে তুমি দেখবা?
আমি শান্তনুকে চোখ রঙানি দেই। কিছুদিন আগেই তার সারকামসাইজ হয়েছে। আমার মা তখন এখানে ছিল মা আবার আসার সময় দেশ থেকে লুঙ্গি-টুঙ্গি নিয়ে এসেছে। আমার মায়ের কাছ থেকেই ‘মুসলমানি’ শব্দটার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে।
তার ধারণা এটা অহংকার করার মতো কোন ব্যাপার। এ জন্যে বাসায় কোন গেস্ট এলেই সে তার পাখি দেখাতে চায়। কিছুদিন আগে আনিসুজ্জামান স্যার আর তাঁর স্ত্রী এসেছিলেন, পরিচয় পর্ব শেষ হতেই শান্তনু বলে, তুমি আমার পাখি দেখবা? আনিসুজ্জামান আঁতকে ওঠে। বেবি ভাবী হাসতে হাসতে বলেছিল, ওঁ দেখবে না তুমি আমার কাছে আসো।
মবিন বলে, না থাক দেখব না। চল আমরা খাওয়া দাওয়া করি।
ডিনার শেষ করে আমরা বাইরের করিডোরে গিয়ে বসলে কণা আর মেঘনা খেতে বসে। রাতে ঘুমাতে এসে কণা বলে, ওদের পাঁচ বছর ধরে বিয়ে হয়েছে কোন বাচ্চা-কাচ্চা হচ্ছে না। দেশে অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে কোন কাজ হয়নি এজন্যেই এখানে আসা। ওদের জন্যে কি কোন ডাক্তার ঠিক করেছ?
KK হসপিটালে তোমাকে যে ডাক্তারকে দেখাতাম তার সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দেব বলে ঠিক করেছি।
ওরা কোন পুরুষ ডাক্তার দেখাবে বলে মনে হয় না। তুমি কোন ফিমেল ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিও।
কণার কথাই ঠিক হল, ওরা কোন পুরুষ ডাক্তার দেখাবে না। সকালে ব্রেকফাস্টের পর মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালের ডাইরেক্টরি দেখে ডক্টর Kelly Loi এর সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিলাম। তারপর একটা ট্যাক্সি ডেকে দিয়ে আমি আমি অফিসে চলে গেলাম।
আমার ধারণা ছিল ডাক্তারের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলার জন্যে আমাকে ওদের সঙ্গে যেতে হবে। মবিন বলে, মেহনাজ খুব ভাল ইংরেজি বলে সে নিজেই পাড়বে।
আমার খেয়াল হল ছেলেবেলায় মেঘনা আর ওর ভাইকে ইংলিশ মিডিয়ামের প্রিপেয়ারটরি স্কুলে যেতে দেখেছি। মেঘনা নামটিও বদলে গিয়ে হয়েছে মেহনাজ। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া মেঘনা এখন আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢাকা মেহনাজ। মেহনাজের সাথে কথা বলার কোন অধিকার আমার নেই, আমি নিছকই এক পরপুরুষ।
ভালয় ভালয় তিনদিন কেটে গেল। সারাদিন আমার অফিসে কেটে যায়। মবিন আর মেহনাজও সকালে হসপিটালের উদ্দেশ্য বেরিয়ে যায় ফেরে সন্ধ্যায়। এসেই নিজেদের রুমে ঢুকে পরে। ওদের সম্ভবত নানা রকমের টেস্ট ফেস্ট চলছে। পুরুষদের ডিনার পর্ব শেষে যখন আমরা করিডোরে এসে বসি তখন আমার সঙ্গে টুকিটাকি কথা হয়। মবিন বলে, আঙ্কেল এই দেশে তো মেলা মুসলিম দেখি। মাদ্রাসা নাই? এইখানে আপনার ছেলেটারে মাদ্রাসায় দেন। মাদ্রাসা ছাড়া ইসলামের শিক্ষা পূর্ণ হয় না।
আমি হেসে বলি মাদ্রাসা থাকলেও আমি তাকে ওখানে দিতে চাই না। আমি চাই আমার ছেলে সেকুলার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়। অন্য ধর্মের মানুষকে সম্মান করতে শিখুক। আমি চাই না সে মানুষকে ঘৃণা করে বড় হোক।
ইসলাম তো আর ঘৃণার কথা বলে না শান্তির কথা বলে। বেহেশতের সব চাবি-কাঠি হইল ইসলামে। যারা ইসলামের সাথে নাই, যারা বিধর্মী তারা কোনদিন বেহেশতে যাবে না আঙ্কেল।
কে বেহেশত যাবে আর কে যাবে না সে কাজ সৃষ্টিকর্তার উপর ছেড়ে দেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। আমি মানুষকে বিচার করি তার কর্ম দিয়ে, ধর্ম দিয়ে না। পৃথিবীর বয়স কত জানেন?
সঠিক বয়স জানা নাই, তবে কয়েক লাখ বছর তো হইবই, কোটিও হইতে পারে।
৪.৫৪৩ বিলিয়ন ইয়ার্স। দশ লাখ বছরে হলো এক মিলিয়ন আর এক হাজার মিলিয়ন বছরে হলো এক বিলিয়ন। পৃথিবীতে এক সময় ডাইনোসররা রাজত্ব করতো জানেন তো?
হ জানি।
এই প্রাণীরা ১৬০ মিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবীতে রাজত্ব করছে। ৬৫ মিলিয়ন বছর আগের ডাইনোসরদের বিলুপ্তি ঘটে। ডাইনোসররা যখন পৃথিবীতে রাজত্ব করত তখন কোন মানুষের অস্তিত্ব ছিল না। মানুষের সবচেয়ে পুরনো যে ফসিলটি পাওয়া গেছে তার তার বয়স চার লাখ বছর। আরও এক লক্ষ বাড়িয়ে ধরলে দাঁড়ায় পাঁচ লক্ষ বছর। পৃথিবীর বয়সের তুলনায় মানুষের বয়স খুব বেশি দিন নয়, মাত্র পাঁচ লক্ষ বছর। ডাইনোসরের চেয়ে অনেক কম।
এইসব কি বলেন আঙ্কেল বেদাতি কথাবার্তা।
বেদাতি না আমি যা সত্যি সেটাই বলছি। বিজ্ঞানের কথা বলছি। যে বিজ্ঞানের কল্যাণে আপনি গাড়িতে চড়েন, প্লেনে চড়েন, আপনার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি চালান, চিকিৎসা করান সেই বিজ্ঞান। আর ধর্মের বয়স কত বলুন?
ইসলাম ধর্মের বয়স ধরেন – আমাদের নবীজী হজরত মোহম্মদ (সঃ) এর জন্ম যখন ৫৭০ সাল তখন থেইকা। কোরআন নাজিলের পর থেইকাই ত ইসলাম। কোরআনই হইল সর্বশেষ আসমানি কিতাব।
তার আগেও তো আরও ধর্ম ছিল, কিতাব ছিল। ইহুদী ধর্ম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু ধর্ম এসব ইসলাম ধর্মের আগে থেকেই ছিল।
কিন্তু সবার মইধ্যে পবিত্র কোরআন হইল শ্রেষ্ঠ। ইসলাম হইল সর্বশ্রেষ্ঠ। হজরত মোহম্মদ (সঃ) হইল আমাদের প্রিয় নবী।
নবীজীর জন্মের ১১২০ বছর আগে পারস্যে আরও একটি ধর্ম ছিল, জরথুস্ত্রীয় ধর্ম। এই ধর্মের প্রবর্তকের নাম জরথুস্ত্র। তার নাম অনুসারেই এই ধর্মের নাম হয়েছে “জরোয়াস্ট্রিয়ানিজ্ম”। এ ধর্মে ঈশ্বরকে ‘অহুর মজদা’ নামে ডাকা হয়। আমরা যেমন আল্লাহ বলি ওরা বলে অহুর মজদা। ওদের ধর্মগ্রন্থের নাম আবেস্তা। ওরা অগ্নি-উপাসক। আগুনের পবিত্রতাকে ঈশ্বরের পবিত্রতার সাথে তুলনীয় মনে করে।
আপনে কি বলতে চান?
আমি বলতে চাই ধর্মের বয়স খুব বেশি দিন না মাত্র আড়াই-তিন হাজার বছর। এর আগে যারা পৃথিবী থেকে যারা বিদায় নিয়েছে তারা কোন বেহেশত বা দোজখে যাবে আপনার জানা আছে?
না জানা নাই।
তাহলে দোজখ বেহেশতের ভাবনা মাথা থেকে দূর করে দেন। প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে তার নিজের ধর্মকে ভালবাসার। আপনার কাছে যেমন আপনার ধর্ম প্রিয় অন্যের কাছেও তার ধর্ম প্রিয়। মানুষকে ভালবাসুন, পৃথিবীকে ভালবাসুন।
আমার কথা-বার্তা যে মবিনের পছন্দ হয় নাই সেটা তার মুখ দেখেই বুঝা গেছে। আমারও মনে হয় তার সঙ্গে ধর্মীয় আলোচনায় যাওয়া ঠিক হয়নি। মবিনের প্রতিদিনের জীবনাচার, বিশ্বাস, শিক্ষা পাঁচ মিনিটের আলোচনায় বদলাবে না। আর সেকুলার ভাবনাও হুট করে আত্মস্থ হবে না এর জন্যেও দরকার পজিটিভ ভাবনা ও শিক্ষা। হাজার হোক সে আমাদের গেস্ট। আমি মনের মধ্যে এক ধরণের রিগ্রেট বোধ নিয়েই ঘুমাতে গেলাম।
মবিনদের একদিন বাইরে ডিনার করাতে নিয়ে যাব ভেবেছিলাম কিন্তু হারাম-হালালের ভয়ে মবিন কিছুতেই রাজি হল না। কণা বলল, তুমি একটা গবেট। যে লোক আমাদের সাথে একসঙ্গে বউকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে না সে কি করে রেস্টুরেন্টে ডিনারে যাবে বলে আশা কর? কথা ঠিক, যারা নানা নিয়ম কানুনের বাঁধনে জীবনকে বেঁধে ফেলে তাদের সে বাঁধন খুলে ফেলা সহজ না।
ডিনারের পরে আজও বারান্দায় গিয়ে বসলাম। মবিনকে আজ একটু খুশি খুশি লাগছে। কালকের ব্যাপারটা নিয়ে আমি কিছুটা গিল্টি ফিল করছিলাম। ভাবলাম চিকিৎসা কেমন চলছে সে ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করবো। কিন্তু ব্যাপারটা টু পার্সোনাল বলে আমিও কিছু জিজ্ঞেস করি না।নিজে থেকে যদি বলে তো বলবে। মবিন বলল, আঙ্কেল একটা কথা ছিল।
কি কথা বলুন।
মেহনাজ একটা আবদার করছে অ্যান্টির কাছে।
কি আবদার? আপনার অ্যান্টিকে বলেন।
অ্যান্টির আগে আপনাকে আগে বলি। আপনি অনুমতি না দিলে ত হবে না।
আচ্ছা ঠিক আছে বলুন।
মেহনাজ একটু Sentosa আইল্যান্ডে বেড়াতে যেতে চায়।
সে তো খুবই ভাল কথা। সিঙ্গাপুরে এসে Sentosa তে না বেড়ালে কি হয়? সব টুরিস্টরাই ওখানে বেড়াতে যায়। কাল সকালেই নাস্তা খেয়ে দুজন বেরিতে পড়ুন।
অ্যান্টি যদি কালকে ফ্রি থাকে তাইলে মেহনাজকে নিয়া Sentosa ঘুরে আসুক।
অ্যান্টি যাবে কেন, আপনারা যান। দুজন একসঙ্গে ঘুরলেন, অনেক কিছু দেখার আছে।
না আঙ্কেল আমি যেতে পাড়ব না, অসুবিধা আছে।
কিসের অসুবিধা?
আছে।
আপনি জাস্ট ট্যাক্সিতে উঠে বলবেন Sentosa যাবো, ড্রাইভার আপনাদের পৌঁছে দেবে। আপনি টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকে যাবেন। ওয়ান্ডারফুল প্লেস।
না আঙ্কেল, প্রবলেম আছে। কিসের প্রবলেম বলুন। পর্দার সমস্যা।
মেহনাজ তো বোরকা পরেই যাবে, পর্দার সমস্যা হবে কেন?
সমস্যাটা মেহনাজের না আমার। বাইরে বাইর হইলে অনেক বেপর্দা মাইয়ালোক দেখি। এতে আমার নিজেরই পর্দার সমস্যা হয়।
মবিনের কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমার মুখে অনেকক্ষণ কোন কথা যোগাল না। পরদিন কণা মেহনাজকে নিয়ে Sentosa’য় বেড়াতে বের হল সাথে শান্তনু। খুব ভাল হয়েছে মেহনাজের শেষ পর্যন্ত sentosa দেখা হল। মেয়েটাকে বাসায় আছে কি নেই বোঝা যায় না, সারাক্ষণ কি করে একটা রুমের মধ্যে থাকে কে জানে! একেবারে বন্দি জীবন। এভাবে কি মানুষ বাঁচে?
রাতে ঘুমোতে যাবার সময় আমি আমার তিনতলা থেকে কণাকে জিজ্ঞেস করলাম তোমাদের ঘুরাঘুরি কেমন হল?
কণা নীচ থেকে ফিসফিস করে বলল, আজ একটা মজার কাণ্ড হয়েছে। তুমি কিন্তু কাউকে বলবে না, খুব সিক্রেট।
কাকে আর বলব, কি হয়েছে বল।
সত্যি করে বল কাউকে বলবে না তো?
আরে না তুমি নিষেধ করলে আমি বলব কেন?
প্রমিস কর।
প্রমিস।
আজ না মেহনাজ জিন্স আর শার্ট পড়ে বেড়িয়েছে সারাদিন।
বল কি! ওর বোরখা?
বোরখা শান্তনুর ব্যাগে রাখা ছিল।
কিন্তু জিন্স আর শার্ট সে পেল কোথায়? দেশ থেকে নিয়ে এসেছে?
আরে না না, আমারই এক সেট দিয়েছি ওকে। Sentosa তে গিয়ে ওয়াশরুমে চেঞ্জ করেছে। এত সুন্দর মেয়েটা, আমি তো প্রথমে চিনতেই পারিনি। কি সুন্দর চোখ-ভ্রু আর এত বড় লম্বা চুল, আমার চেয়েও লম্বা চূল।
ওকে আমি ছোটবেলায় সাইকেল চালাতে দেখেছি। এই রকম একটা লোকের সাথে কেন যে বিয়ে দিল ওর বাবা!
আমাকে সব বলেছে, হঠাৎ করে বাবা মারা যাবার পর ওর ভাই বিয়ে ঠিক করেছে। মবিনদের নাকি অনেক বড় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি আছে, পাঁচ ভাই মিলে চালায়। ওদের সাথে মেহনাজের ভাইয়ের বিজনেস আছে।
ভাইয়ের বিজনেসের বলি হল মেয়েটা। মবিন নাকি আগে এরকম ছিল না। বিয়ের পর বাচ্চা কাচ্চা না হওয়ায় কোন এক হুজুরের মুরিদ হয়েছে। তার পর থেকে আস্তে আস্তে এ অবস্থা।
মানুষ কেমন দেখ। নিজের জীবনের ভাল-মন্দ ব্যাপার সে অন্যের হাতে কত অবেলায় তুলে দেয়। প্রার্থনা মানে হল সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করা, এই মানব জীবনের জন্যে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানানো, আর সততা নিজে জীবন যাপন করা এই তো হল ধর্ম। এর জন্যে পীর ধরতে হবে কেন, থার্ড পার্টি ধরতে হবে কেন? শেষ পর্যন্ত তো সেই ডাক্তারের কাছেই আসতে হল।
আমারও মাথায় আসে না শিক্ষিত মানুষ কি করে মূর্খের পাল্লায় পরে। তবে যাই বল মেয়েটির মনে অনেক দুঃখ, এরকম জীবন সে চায়নি। বাসায় একটা টিভি পর্যন্ত নেই।
কি বল?
হ্যাঁ, টিভিতে নাটক মুভি দেখা নাকি বেদাত কাজ। মেহনাজ টিভি দেখত বলে একদিন বাসায় ফিরে আছাড় দিয়ে টিভি ভেঙ্গে ফেলেছে।
ও মাই গড। পুরো এক্সট্রিম।
আমি সারাক্ষণ মেয়েটির জীবনের কথা ভেবেছি। এ রকম সুন্দর শিক্ষিত একটা মেয়ে শুধু ধর্মান্ধতার কারণে কত অসহায়। আজ মেয়েটি কি সুন্দর ডানামেলা প্রজাপতির মতো ঘুরে বেরিয়েছে। কি যে ভাল লেগেছে আমার। জিন্স আর শার্টে ওকে খুব মানিয়েছিল। শোন, এক ঘটনা তুমি যেন আবার কারো সঙ্গে শেয়ার করো না।
মাম্মি, আমি অঙ্কেলকে বলে দিয়েছি অ্যান্টি আজ বোরখা পড়েনি।
হোয়াট! ওহহো মাই গড! শান্তনু ঘুমায়নি, সে এতক্ষণ ঘাপটি মেরে পড়েছিল! হায় হায় এখন কি হবে?
কণা চাপা গলায় শান্তনুকে ধমকাতে লাগল, তুই কেন বলতে গেলি? আমি না তোকে পই পই করে বলে দিলাম এ কথা যেন কেউ না জানে? কেন বলতে গেলি কেন?
আমাকে আঙ্কেল এক বাক্স চকলেট দিয়ে বলেছে ঘুরাঘুরি কেমন হয়েছে?
আমি বলেছি ভাল হয়েছে।
তারপর! তারপর আমি ওকে বলেছি একটা সিক্রেট আছে কাউকে যেন বল না। তারপর তুই ওকে সব বলে দিলি?
হ্যাঁ!
কণা রাগে কাঁপতে লাগল।
সকালে আমি দ্রুত বাসা থেকে অফিসে চলে গেলাম, আমাকে যেন কোন অপ্রিয় ঘটনার মুখোমুখি হতে না হয়। কণা বলেছিল আজ যেন অফিসে না যাই। কিন্তু আমাকে যেতেই হবে অনেকগুলো কাজ পেন্ডিং পরে আছে আর তাছাড়া আমি বোধহয় পালাতেও চাইছিলাম। অফিসে বার বারই মবিন আর মেহনাজের কথা মনে হয়েছে। কোন ঝড় যেন বয়ে যায় আজ। সে লোক আছাড় মেরে বাসার টিভি ভেঙ্গে ফেলতে পারে সে আরও অনেক কিছুই করতে পারে। ভয়ে আমি কণাকেও ফোন দিইনি।
সন্ধ্যায় চাপা আতঙ্ক নিয়ে বাসায় ঢুকলাম। ডিনার রেডি হচ্ছে, বাইরে থেকেই বিরিয়ানির ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। দরজায় পা দিয়েই আমি চমকে গেলাম। আমি কি ভুল করে অন্য ফ্লোরে চলে এসেছি? সালওয়ারকামিজ পড়া লম্বা সুশ্রী মতো এক মেয়ে এসে আমাকে সালাম দিল, স্লামালাইকুম আঙ্কেল।
আমি থতমত খেয়ে গেলাম। সালামের জবাব দিতেও ভুলে গেলাম। আমার অপ্রস্তুত ভাব দেখে মেয়েটি মিষ্টি করে হাসি দিয়ে বলল, আমি মেঘনা আঙ্কেল, ভিতরে আসুন।
এই প্রথম নিজের বাসায় আমি সংকোচ নিয়ে ঢুকলাম। হাত থেকে ব্যাগ নামিয়ে রাখতে রাখতে আমি জিজ্ঞেস করলাম মবিন কোথায়? কণা পেছেন থেকে এসে বলল মবিন শান্তনুকে মেকডোনালসে নিয়ে গেছে। এখুনি চলে আসবে।
কাল মেঘনারা চলে যাবে এজন্য রান্না বান্নার ব্যাপক আয়োজন চলছে। মেঘনা কণাকে রান্নায় হেল্প করছে। ডিনারে একটু দেরী হবে তাই মেঘনা এসে চা দিয়ে গেল। সারা বাড়িতে যেন উৎসবের আমেজ। এ’কদিন জীবনের স্বাভাবিক গতি যেন থেমে ছিল। তাইতো কি করে এরকম চঞ্চল একটি মেয়ে সারাক্ষণ নিজেকে একটি ঘরে বন্দী করে রেখেছে! আমার জন্যে আরও বিস্ময় অপেক্ষা করে ছিল। মবিন যখন শান্তনুকে নিয়ে ঘরে ঢুকল তাকে দেখে আমি অবাক। এরাবিকদের মতো ট্রিম করা দাড়ি-গোঁফ। নিজের বেশ ভূষাও সে বদলে ফেলেছে। লম্বা আলখাল্লার বদলে সে পরে আছে পলো টি-শার্ট আর ডেনিম পেন্ট।
এ রকম একটা বৈপ্লবিক কাণ্ড কি করে হল বুঝতে পারছি না। আমি মবিনকে জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার মবিন হঠাৎ বেশ ভূষায় পরিবর্তন সিঙ্গাপুরের হাওয়া লেগেছে মনে হয়?
মবিন লজ্জা পেয়ে বলে, জীবনটারে খামাখা জটিল কইরা লাভ নাই আঙ্কেল। স্ত্রী, সন্তানকে ভালবাসা, সৎপথে উপার্জন করা আর দিনের শেষে আল্লার শুকরিয়া করাটাই হইল জীবন। কাল রাইতে আমি রাগ কইরা মেহনাজের গায়ে হাত তুলছি। সে সারা রাইত ভর কান্না-কাটি করছে। তারপর আমি অনেক ভাবলাম, চিন্তা কইরা দেখলাম যে তার পরিবারকে ভালোবাসেন, তার সুখদুঃখ বোঝে না সে কি কইরা আল্লার ভালবাসা পাবে।
বাঃ তোমার পজিটিভ চিন্তা দেখে ভাল লাগল। তোমাকে এ ড্রেসে খুব ভাল লাগছে।
মবিন লজ্জা পেয়ে বলে, আপনাদের এই দেশে খুব গরম আঙ্কল। তাই সকালে মেহনাজকে নিয়া শপিংয়ে বাইর হইলাম। বাড়ির সবার জন্য কেনাকাটা করলাম। মেহনাজ আমারে এই জামা কাপড় কিনা দিসে।
খুব মানিয়েছে তোমাকে।
থ্যাঙ্ক ইউ আঙ্কেল।
গল্পটা এখানে শেষ করলে কেমন হয়? সুখী সুখী গল্প। পজিটিভ গল্প। কিন্তু জীবন সব সময় লেখকের পজিটিভ ভাবনা মেনে চলে না। গল্পের এন্ডিংটা আমার কল্পনা। আসল ঘটনা ভিন্ন রকম।
রাতে ওদের ঝগড়া-ঝাটি আমাদের কানে এসেছে। সকাল হতেই ওরা আমাদের বাসা থেকে লাগেজ-টাগেজ নিয়ে চলে যায়। কোন এক হোটেলে গিয়ে ওঠে, বহু অনুনয়-বিনয় করেও আমরা ওদের আটকাতে পারিনি। অনেক খোঁজ-খবর করেও ওদের আর দেখা পাইনি। এ ঘটনার পর কণা অনেকদিন মনমরা হয়ে ছিল।
বেশ ক’বছর পর ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হসপিটালে মবিনদের সাথে হঠাৎ করেই দেখা। বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসা করতে আসা আমার এক বন্ধুকে দেখতে ওই হসপিটালে গিয়েছিলাম। ওরা লবিতেই বসে ছিল। মবিন পড়ে ছিল পাজামা-পাঞ্জাবী আর পাশে মেহনাজ সেই আগের মতোই আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকা। আমি দেখতে পেয়ে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, আরে মবিন কেমন আছেন?
আমাকে চিনতে পেরে মবিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ভাল আছি আঙ্কেল। অ্যান্টি, শান্তনু কেমন আছে?
ওরা ভাল আছে। মেহনাজ তুমি কেমন আছো?
মবিন আমাকে একটু দূরে ঠেলে নিয়ে বলে, আঙ্কেল ও মেহনাজ না। ওর নাম বিলকিস।
আমি বোকার মতোই জিজ্ঞেস করলাম, মেহনাজ কোথায়?
মেহনাজ তো নাই আঙ্কেল!
নাই মানে কি?
আমি আপনেরে বলতে পারব না আঙ্কেল !