নিউজফিড ভেসে যাচ্ছে সুশান্তের আত্মহত্যার খবরে। সবাই আহা, উঁহুঁ করে জীবন দিয়ে দিচ্ছে। কী এমন বয়স হয়েছে? কী এত দুঃখ তোমার ছিল? কী পাওনি এতটুকু জীবনে? টুপুর ভীষণ মনোযোগ দিয়ে সবার সবগুলো লেখা পড়ে। সুশান্তের মতো পরিণতি চায়না বলেই সে খবরগুলো আরও মনোযোগ দিয়ে পড়ে। ডুবন্ত মানুষ নাকি খড়কুটো ধরে হলেও বাঁচতে চায়। টুপুরও যে ভীষণভাবে বেঁচে থাকতে চায়।
ফ্রেন্ডলিস্টে কমতে কমতে টুপুরের বন্ধুসংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে একশোতে। কারও প্রতি অভিযোগ বা অনুযোগ নেই টুপুরের, শুধু আছে একরাশ ভয়। না জানি আজ কার থেকে অপমানিত হতে হয়? এই একশোজনের কেউ কেউ শুধু থাকার জন্যই লিস্টে আছে। আর বাকিরা তুলনামূলক কম অপমানিত করেছে বা মাঝেমধ্যে হয়তো এক আধটা ভালো কথা বলে ফেলেছে বলে টুপুর ওদের সঙ্গটা ছেড়ে দেয়নি। অনেকে হয়তো প্রশ্ন রাখতে পারে এতই যখন ভয় তবে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট রাখার দরকার কী? টুপুরেরও যে ভালো থাকতে ইচ্ছে করে। অন্যের থেকে সুন্দর সুন্দর প্রশংসা বাণী শুনতে ইচ্ছে করে।
সেদিন ওদের ক্লাসের সুন্দরী লাবণ্য শাড়ি পরে ছবি দিল। দারুণ দারুণ সব কমেন্টের বন্যায় ভেসে গেল বুঝি সে। টুপুরেরও খুব ইচ্ছে হয় তার নিজের একটা ছবি দিতে। দিয়েও ফেলে। টুপুরের শাড়ি পরা ছবিটার নিচে কমেন্ট এসেছিল সাকুল্যে দুটো। তাও সেটা ছিল শাড়িটির প্রশংসা। তাও ভাগ্যিস কেউ হাহা ইমোজি দিয়ে দেয়নি।
কোনো পারিবারিক গ্যাদারিং, বন্ধুদের আড্ডা, ভার্সিটির উৎসবে টুপুরের অবস্থান হয় একেবারে শেষ সারিতে। কেউ তাকে যেন দেখেইনা। আর যারা দেখেই ফেলে তাদের মুখে থাকে কিছু অশোভন কথা। আগের চেয়েও মোটা হয়েছো দেখি, সারাদিন রোদে রোদে ঘোরো বুঝি গায়ের রং যে আরো কালো হয়েছে, ইস মুখে এতো ব্রণ উঠেছে কিছু লাগাও না; যেন টুপুরের গায়ের রং, চামড়ার অমসৃণতা বা শরীরের স্থূলতাই কেবল আলোচ্য বিষয় হতে পারে। ‘মানুষের সুন্দর মুখ দেখিয়া আনন্দিত হইয়ো না।’ এই বাক্যের রচয়িতাকে এইসব সময়ে টুপুরের ইচ্ছে করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে।
অনার্সের শেষ বর্ষ নাকি বিয়েশাদির সবচেয়ে ভালো সময়। বান্ধবীদের একের পর এক বিয়ের গল্প শুনে টুপুর নিজেও চোখে বিয়ের স্বপ্ন দেখে। মাস্টার্সে পড়া তুষার ভাইকে খুব পছন্দ তার সেই ভার্সিটির শুরুর দিন থেকে। কথায় কথায় মাস কয়েক আগে এক বান্ধবীকে বলে ফেলেছিল। সে কথা যে বিদ্যুৎবেগে পুরো ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে যাবে তা বুঝি টুপুরের ধারণাতেই ছিল না। সপ্তাহখানেক পরে তুষার ভাই তাকে ডেকেছিল। ‘ আয়নায় নিজেকে দেখো টুপুর? তোমার সাথে আমাকে মানায়? কী মনে করে এরকম একটা কথা ছড়াতে দিলে?’ টুপুরের ইচ্ছে করছিল মাটি দুভাগ হয়ে যাক সে ঢুকে যাবে ভেতরে। কিংবা যদি একটা সমগ্র বাংলাদেশ পাঁচটন ট্রাক সামনে দিয়ে চলে যেত তবে সে বোধহয় ঝাঁপিয়ে তার নিচে পড়ে নিজের এই অমসৃণ কালো মুখটাকে লুকিয়ে ফেলতো।
সেদিনের পর থেকে ভার্সিটিতে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে টুপুর। ভাগ্যিস করোনাকাল এসেছিল বলে ওকে আর বাসা থেকে বের হতে হচ্ছে না। নয়তো আরো কত অপমান সইতে হতো কে জানে?
আচ্ছা এই যে ওর এতো এত বন্ধুরা এত স্ট্যাটাস দিচ্ছে বিষণ্নতার বিরুদ্ধে, এই যে সবাই বলছে মনে দুঃখ গোপন না রেখে প্রকাশ করতে; এই এরাই তো প্রতিনিয়ত টুপুরকে নির্দ্বিধায় ছোট করে গেছে কখনো বাচ্চা হাতি ডেকে, কখনো মা কালী বলে বা কখনো বলেছে তোর মুখ যেন উঁচুনিচু পাহাড়ের সারি। এসব ছোটো ছোটো কথার ভারে লুকিয়ে গেছে টুপুরের রেজাল্ট কিংবা ওর দারুণ গানের গলা। নিজেকে সবার থেকে লুকাতে লুকাতে টুপুর ভুলেই গেছে কবে সে শেষ মন খুলে হেসেছিল বা লোক সম্মুখে গান গেয়েছিল।
তেলা মাথায় ঢালো তেল, রুক্ষ মাথায় ভাঙো বেলের মতো সামান্য কিছুতেই সুন্দরী বান্ধবীদের প্রশংসা আর টুপুরকে ছোটো করতে করতে প্রায় মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে তো ওর বন্ধু বা স্বজন নামের এই চারপাশের মানুষগুলোই। তবে আজ কেন তারা সুশান্তের মৃত্যুতে এত আহত? সুশান্তের আপাত দৃষ্টিতে অর্থ, খ্যাতি, প্রতিপত্তি সব ছিল বলে?
টুপুরের খুব ইচ্ছে করে নিজের ওয়ালে লিখতে, আজ যারা সুশান্তের মৃত্যুতে এত কষ্ট পাচ্ছেন, তাদের মুখনিঃসৃত বাণী বা ব্যবহার কি কাউকে সুশান্তের মতো পরিণতিতে ঠেলে দিচ্ছে কি না তা বোঝার চেষ্টা করেছেন তো? বেলা শেষে নিজের মনের কাছে হেরে যাওয়া মানুষগুলোই যে শুধু কালের গর্ভে হারিয়ে যায় আর অবুঝ মানুষের দল আবার পিছু নেয় অন্য কাউকে ঐ অন্ধকার পথে ঠেলে দিতে। নিজেকে শোধরায় কয়জন?
ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস