আজ পহেলা আষাঢ়। বাদলা দিনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। যদিও দিনক্ষণের জন্য বৃষ্টি বসে থাকেনি। আসতেই যখন হবে, তো দেরি কিসের? সপ্তাহখানেক ধরে কখনো টুপটাপ, কখনো ঝিরিঝিরি, আবার কখনো মুষলধারে পড়ে চলেছে। বৃষ্টির জন্য যারা হাহুতাশ করছিলেন, সকালে অফিস বেরুবার সময় তাদেরও ভ্রুকুটি হচ্ছে। আমাকেও সকালে বেরুতে হয়৷ কিন্তু এক সপ্তাহ কেন, মাসজুড়ে বৃষ্টি হলেও কখনো ভ্রুকুঞ্চন হয়নি। শহরের নোংরা পানিতে সাঁতার কেটে অফিসে আসতে হলেও বিরক্ত লাগে না। বৃষ্টির মধ্যে এমন কিছু একটা আছে, যা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। নিজেকে মনে হয় চঞ্চল প্রজাপতি। বুকের মধ্যে রিনিঝিনি সুর বাজে। মাঝেমধ্যে একটা কী পাইনি, কী পাইনি অনুভব হয়। আহা, বাদলা দিনে কিছু পেতে মন চায়, কাউকে পেতে মন চায়, এমন অনুভূতি একবারও হয়নি- এরকম কেউ আছে? না বোধকরি। কবিগুরু কী আর এমনই এমনই লিখেছেন- ‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়..’।
আমার ছেলেবেলা গ্রামে কেটেছে। তখনও গ্রামে শহরের হাওয়া লাগেনি। ধানের মৌসুমে দাদা কৃষকদের কাছে জমি বর্গা দিতেন। ধান পাকলে আমাদের বিশাল উঠোনে ছড়ানো হতো। আম্মা-কাকীরা পা দিয়ে ধান নেড়েচেড়ে দিতেন। ছোটদের কাজ ছিলো হাঁস-মুরগি তাড়ানো। পাটখড়ি দিয়ে বানানো লম্বা কাঠি নিয়ে আমরা একটু পর পর ‘হুস হুস’ করতাম। সেসব দুপুরে হঠাৎ হঠাৎ মেঘ কালো করে আকাশ অন্ধকার হয়ে যেতো। এই বৃষ্টি এলো বলে! সবাই ছোটাছুটি করে ধান তুলতে শুরু করতো। কেউ বা দড়িতে মেলে রাখা কাপড়। আমিও মুঠো মুঠো করে ধান জড়ো করতাম৷ আম্মা সেগুলো বস্তায় বা বড় গোলায় ভরতেন। এরপর ছুটে যেতেন পুকুরে। ছোট থেকেই দেখছি, বৃষ্টি এলেই আম্মা পুকুরে সাঁতার কাটেন। মুক্তোর দানার মতো পানিতে বৃষ্টির ফোটা পড়তো। পুকুরটাকে সেসময় মনে হতো মুক্তো দিয়ে বোনা নকশীকাঁথা। মাঝ পুকুরে গিয়ে চোখ বন্ধ করে পানির উপর মাথা ভাসিয়ে রাখতেন আম্মা। এখন আম্মার বয়স ষাট। এখনো বৃষ্টি এলে আম্মা বাথরুমের গরম পানির মোহ ছেড়ে পুকুরে গিয়ে নামেন। গত বর্ষায় বাড়ি গিয়েছি। দুপুরে ঝুম বৃষ্টি এলো। আম্মা বললেন, ‘চল পুস্কুনিত নামি। আগেই ভাইবা রাখছিলাম, তুই আসলে যদি বৃষ্টি হয় তো একসাথে পানিত নামমু।’ কী যে ভালো লাগলো আমার! কী যে ভালো লাগলো! আমার বৃষ্টিপ্রেম সম্ভবত আম্মার থেকেই পাওয়া। এমন পাগল আম্মা যার আছে, সে বৃষ্টি ভালো না বেসে পারে?
‘বাদলা দিনে মনে পড়ে
ছেলেবেলার গান
বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর
নদে এলো বান’
বৃষ্টি শুরু হলে আব্বা ঘরের সামনে বালতি, পাতিল, এসব বসিয়ে রাখতেন। বাইরে থেকে ঘরে ঢোকার আগে সবাই সেই পানিতে পা ধুতো। বৃষ্টির পানি শুধু বাইরে না, খুব ছোটবেলায় আমাদের ঘরেও পড়তো। সম্ভবত অনেক পুরনো হয়ে যাওয়ায় দু’এক জায়গায় টিনের চালে ছিদ্র হয়ে গিয়েছিল। রাতে আম্মা নিচে পাতিল বসিয়ে দিতেন। পাতিলে টুপ টুপ করে বৃষ্টির পানি পড়তো। ঘুম ঘুম ভেজা রাতে সেই আওয়াজ শুনতেও কতো মধুর যে লাগতো!
বৃষ্টির দিনে সবাই স্কুল ফাঁকি দেয়। আমি ছিলাম উল্টোটা। কারণ এসব দিনে ছাত্র-ছাত্রী কম আসতো।টিচারটা সেদিন বইয়ের পড়া না ধরে গান-কবিতার আসর বসাতেন। আসরের লোভে স্কুলে যেতে চাইতাম। কিন্তু আব্বার কড়া নিষেধ। গায়ে পানি লাগলে জ্বর-টর আসবে তাই স্কুলে যাওয়া বন্ধ। আমরা ছোট দুই ভাইবোন তক্কে তক্কে থাকতাম। সুযোগ পেলেই বের হয়ে যেতাম আমি আর ভাইয়া। ভিজে জবুথুবু হয়ে কতদিন স্কুলে গেছি! বই ব্যাগে ভরে পলিথিনে মুড়িয়ে নিতাম। আমি আর মারুফ ভাইয়া একই স্কুলে তিন ক্লাস উপরে-নিচে পড়তাম। একবার এমন এক মেঘলা দিনে ছাত্র-ছাত্রী কম থাকায় স্কুল ছুটি হয়ে যায়। সম্ভবত ক্লাস থ্রি-তে পড়ি তখন। আমার বাড়ি স্কুল থেকে একটু দূরে হওয়ায় কেউ বেড়াতে আসেনি আগে। সেদিন সুযোগ পেয়ে সবাইকে বাড়ি নিয়ে এলাম। পুকুরে ঝাঁপাঝাপির পর দুপুরে আম্মা গরম গরম ভাত খেতে দিলেন। বিকালে সবাই যার যার মতো বাড়ি চলে গেলেও লিজা যেতে পারছিলো না। বড়লোকের মেয়ে। মুক্তাগাছা শহরে আমাদের স্কুলের পাশে ওদের বিরাট তিনতলা বাড়ি। কখনো একা বাইরে আসেনি। আজ হুজুগের বশে চলে এসে এখন ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছে। ঘটনা শুনে ছোটপা আমাদের দুজনকে নিয়ে ঝুম বৃষ্টির মধ্যেই রওনা হলো। গিয়ে দেখি হুলুস্থুল শুরু হয়ে গেছে। মাইকিং করে খোঁজাখুঁজি, কান্নাকাটি করে একাকার অবস্থা! ক্লাস ফোরে ওঠে আমি স্কুল পরিবর্তন করি। আজ কতো বছর হলো? একুশ-বাইশ তো হবেই। লিজার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। কেমন আছে মেয়েটা? এখনো বুঝি সেই আদুরে-আহ্লাদীই আছে? মাঝেমধ্যে খুব মনে পড়ে! বিশেষ করে বৃষ্টি এলেই।
বৃষ্টি মানেই অলসবেলা। ছোটবেলা বৃষ্টির দিনে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে খুব আরাম লাগতো। আবার কখনো চোর-পুলিশ কিংবা লুডু খেলতে বসে যেতাম। সাথে থাকতো সরিষা তেল দিয়ে মাখানো কড়কড়ে মুড়ি। সেই স্বাদ যেন এখনো মুখে লেগে আছে!
বর্ষা মৌসুমে আমাদের আয়মান পোয়াতি নারীর মতো টইটম্বুর হয়ে যেতো। বেগুনি রঙের কচুরিপানা ফুলে তার বুক ছেয়ে থাকতো। আমরা কলাগাছ দিয়ে ছোট ছোট ‘বুড়কা’ বানাতাম (এক ধরনের ভেলা)। সেই বুড়কায় চড়ে ভেসে বেড়াতাম আয়মানের ফুলেফেঁপে ওঠা গায়ে৷ সেসময় বাড়িতে বাড়িতে মাছ ধরার ধুম পড়ে যেতো। আয়মানের দুই ধারে নানান সাইজের মাছ ধরার জাল পাতা হতো। ছোট ছোট তাজা মাছগুলা যখন জালে লাফাতো, মন আনন্দে ভরে উঠতো। আহা সেই সোনালি শৈশব! ফিরে আর আসবে না কোনোদিন!
আরেকটু বড় হলে, এমন দিনে শাড়ি পরতাম। কখনো শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়তাম। তবে অবশ্যই তার আগে এক পশলা ভিজে নিতাম। একবার হলো কী, মনের আনন্দে ভিজছি। অদূরে বড় রাস্তা। তার পাশে নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে কিছু যুবক দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ পা পিছলে আমি চিৎপটাং! কোনোমতে উঠে হুড়মুড় করে দিলাম এক দৌড়! কী লজ্জা! অমন বয়সে (কেবল এইচএসসি প্রথম বর্ষ) কী বেইজ্জতিই না হয়েছিলো বাবা! এখন ভাবলে খুব হাসি পায়। কী অবুঝই না ছিলাম!
অবশ্য আজও অবুঝই আছি। এতো বয়স হলো, তবু বৃষ্টি এলে মন মানে না। অফিস-ঘর ভাল্লাগে না। চারপাশ কালো হয়ে এলেই মনে নাচন ওঠে। এই যে মেঘলা মেঘলা আকাশ, মেঘের এলোমেলো আনাগোনা, যেন ছুঁয়ে দিলেই গলে যাবে। এ এক অন্যরকম অনুভূতি! এমন দিনে এক থোকা কদম হাতে পেলে মন সুখ প্লাবনে ভেসে যায়। আহা! এখানে বৃষ্টি হোক, হতেই থাকুক। সারাদিন, সারারাত!
বৃষ্টি এলে একটা মেয়ের নাচন ওঠে
হৃদয় মাঝে
বৃষ্টি এলে সেই মেয়েটি বেরিয়ে পড়ে
সকাল-সাঁঝে…