টিভি ইন্টারভিউতে সুমনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ চেহারাটা কিছুতেই ভুলতে পারছিলেন না জলিল সাহেব। কিছুদিন আগেও একটা চাকরির আশায় যে ছেলে হাতে পায়ে ধরেছিলো, সামান্য টাকার লোভে গল্প বিক্রি করেছিলো আর আজ সেই ছোকরার কত বাহাদুরি! ফেসবুকে জলিল সাহেবের জনপ্রিয়তা দেখে তার সহ্য হলো না, নিজেই গল্প পোস্ট করতে শুরু করলো ! সুমনের অফিসের ঠিকানা বের করে এক বিকেলে সেখানে গেলেন জলিল সাহেব। অফিসের উল্টোদিকের একটা ক্যাফেতে বসে খেয়াল করতে লাগলেন সুমন কখন বের হয়। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে সুমন বের হলো, সাথে এক সুন্দরী কলিগ। দুজন ঢলাঢলি করে হাসতে হাসতে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। জলিল সাহেবের মেজাজ তেতো হয়ে গেলো। সুমনের গায়ের বিদঘুটে গন্ধের কথা মনে হয়ে গা গুলিয়ে উঠলো। সুমন একটা সিএনজিতে উঠলো। জলিল সাহেব বিল মিটিয়ে দ্রুত বেরিয়ে একটা সিএনজিতে চড়লেন, ড্রাইভারকে বললেন সুমনের সিএনজিকে ফলো করতে। জলিল সাহেব আসলে জানেন না তিনি ঠিক কি করতে চান, এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে আগে সুমনের গতিবিধি জানা দরকার। পান্থপথ থেকে সুমনের সিএনজি বাসাবো একটা ঘুপচি গলির মুখে থামলো। জলিল সাহেবও একটু দূরে নেমে সুমনের পিছু নিলেন। একটা সরু গলিতে ঢুকে পড়লো সুমন।
মাগরিবের আজান হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষন আগে, গলির ভেতর থিকথিকে অন্ধকার। জলিল সাহেব যে পেছনেই আছে, সেটা সুমন টের পেলো না, তার কানে হেডফোন। গলির শেষ মাথায় একটা চারতলা বাড়ির ভেতর হারিয়ে গেলো সুমন। তার মানে এখানেই সুমনের ডেরা।
জলিল সাহেব বাসায় ফিরে আকাশ পাতাল ভাবতে বসলেন। ঠিক কি করলে সুমনের মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ভেঙে গুড়িয়ে দেয়া যায়? সুমনের উপর বদলা নেয়া ছাড়া তার মাথায় আর কোনো চিন্তাই নেই। এত এত থ্রিলার বই পড়লেন অথচ প্রতিশোধ নেয়ার কোনো উপায় তার মাথায় আসছে না। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। পরদিন সন্ধ্যার দিকে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই বাসাবো সুমনের বাড়ির সামনের গলির মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন প্রায় ঘন্টা খানেক। সাতটা বাজতেই নিজের ভেতর একধরণের কম্পন টের পেলেন। তার কপাল ঘামছে সেই সাথে ঘামছে হাতের তালু। সুমনের মুখোমুখি হয়ে তিনি ঠিক কি করবেন, এখনো ঠিক করতে পারেননি। রাস্তায় পায়চারি করতে লাগলেন তিনি। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। মাঝে মাঝে দুই একটা রিকশা আর সিএনজি ছাড়া তেমন কোনো সাড়াশব্দ নেই। বেশিভাগ বাড়ির পেছনদিকের এই রাস্তায় লোকজনের চলাচল এমনিতেই কম। একেকটা সিএনজি আসে আর জলিল সাহেবেন বুকের হৃদস্পন্দন বাড়তে থাকে, এই বুঝি সুমন এলো! একটা পিলারের পেছনে দাঁড়িয়ে তিনি অধীর আগ্রহে সুমনের অপেক্ষা করেন।
বেশ অনেক্ষন পার হতেই জলিল সাহেব অধৈর্য্য হয়ে উঠছিলেন । ঠিক এই সময় একটা রিক্সা থেকে নামলো সুমন, একাই। জলিল সাহেব অন্ধকারে পিলারের পেছনে লুকিয়ে গেলেন। তার নিশ্বাস দ্রুত হলো, কিছু একটা আজকেই করবেন তিনি। হঠাৎ জলিল সাহেবের মনে পড়লো, সুমনের উপন্যাসের নায়কের মাথায় ইটের আঘাত করে এক পলাতক অপরাধী। ঠিক সেভাবেই সুমনকে কাবু করবেন তিনিও। তার পেছনে একটা ভাঙা দেয়ালের পাশে এক স্তুপ ভাঙা ইট থেকে একটা তুলে নিলেন, তারপর নিঃশব্দে সুমনের পিছু নিলেন। আজকেও সুমনের কানে হেডফোন, সুমন আজও তাকে খেয়াল করলো না। গলির মাঝামাঝি এসেই ক্ষিপ্র গতিতে সুমনের মাথার পেছনে আঘাত করলেন। সে কোনো শব্দ করলো না, হুমড়ি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লো। জলিল সাহেব আরো দুবার আঘাত করলেন সুমনের মাথায়। রক্ত পড়লো কিনা জলিল সাহেব জানেন না। হাঁপাতে হাঁপাতে দৌঁড়ে গলি থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলেন। তার পোশাকে বা হাতে রক্ত আছে কিনা খেয়াল করলেন না। একটা ঘোরের মধ্যে বাসায় ফিরে এলেন। সুমন মরে গেলো কিনা কে জানে। গতকাল মানুষ খুন করার সহজ প্রক্রিয়া খুঁজতে গুগল ঘেটেছেন বেশ কয়েকবার । মাথার সংবেদনশীল জায়গায় ঠিক মতো আঘাত করতে পারলে একবারেই খেল খতম । কিন্তু সুমন মরলে সমস্যা হতে পারে, পুলিশ শুঁকতে শুঁকতে যদি তাকে বের করে ফেলে? নাহ, অনেক মার্ডার মিস্ট্রি পড়েছেন তিনি। ঘটনাস্থলে কোনো প্রমান রেখে আসেননি। সন্ধ্যায় মতিঝিলে একটা মিটিংএ গেছেন বলেই জানে সবাই। অতএব এত সহজে ফাঁসবেন না। তাছাড়া সুমন নাও মরতে পারে, আগেই এত কিছু চিন্তা করে লাভ নেই। পরের দুইদিন ফেসবুক, সংবাদপত্র খুঁটিয়ে পড়লেন, টিভির নিউজ মনোযোগ দিয়ে দেখলেন, কোথাও যদি বাসাবোতে তরুনের মৃত্যুর খবর আসে। তেমন কোনো খবর দেখা গেলো না। সপ্তাখানেক পার হওয়ার পরও যখন সুমনের মৃত্যুর কোনো খবর পাওয়া গেলো না, তখন জলিল সাহেব নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন। ছেলেটাকে একটা শিক্ষা দেয়া গেছে এই ভেবে জলিল সাহেব সন্তুষ্ট হলেন। মাসখানেক পার হওয়ার পরেও সুমনের কোনো নতুন পোস্ট দেখা গেলো না।
দুই মাস পরে হঠাৎ একদিন সুমন নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে একটা স্টেটাস দিলো, সে অনেক দিন অসুস্থ ছিল, এখন ভালো আছে এবং দ্রুত লেখালিখিতে ফিরে আসছে। স্ট্যাটাসে সুমন তার উপর হামলার এমন বর্ণনা দিয়েছে, মনে হচ্ছে তার উপর না , জেমস বন্ডের উপর আক্রমণ হয়েছে! সুমনের উপস্থিতি আবার জলিল সাহেবকে বিচলিত ও বিরক্ত করলো। তিনি কিছুতেই চান না সুমন আবার লিখুক। প্রয়োজনে ছেলেটাকে আবার একটা কড়া শিক্ষা দেবেন। শুক্রবার সকালে বসে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটা অপরিচত নাম্বার থেকে ফোন। ধরতেই ওপাশ থেকে সুমন বললো, “কেমন আছেন স্যার?”
কণ্ঠ চিনেও জলিল সাহেব বললেন, “কে ?”
“স্যার আমি, সুমন। ভুলে গেছেন আমাকে?”
থতমত খেয়ে জলিল সাহেব বললেন, “ওহ আচ্ছা সুমন। কেমন আছো?”
“ভালো আর কিভাবে থাকবো স্যার বলেন? চারদিকে আমার শত্রু। কিছুদিন আগে আমার মাথায় কে জানি ইটা দিয়া বারি মারছে। দুই মাস অসুস্থ ছিলাম স্যার। আপনে ফেসবুকে দেখেন নাই? আপনে তো আমার ফলোয়ার।”
“আমি তোমার ফলোয়ার হতে যাবো কেন? আমি দেখি নাই।” ধমকে বললেন জলিল সাহেব।
“হাহাহাহাহা, স্যার আপনার অনেকগুলা ফেক একাউন্ট আছে, আমি জানি স্যার। ওগুলা দিয়া আমাকে ফলো করেন, আমার লেখায় কমেন্ট করেন।”
“তুমি কি নিজেকে বিরাট সেলেব্রিটি মনে করো যে তোমাকে আমি ফলো করবো? তাও আবার ফেক একাউন্ট দিয়ে? ” কথাগুলো বলার সময় রাগ লুকালেন না জলিল সাহেব।
“স্যার, রাগ করেন কেন। আপনি যে অন্ধকার গলিতে আমার মাথায় বাড়ি দিলেন, আমি কি রাগ করছি বলেন? এমন যে হবে আমি মনে মনে ধারণা করছিলাম।”
এবার চিৎকার দিলেন জলিল সাহেব, “তোমার কতো বড় সাহস! তুমি এত বড় মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছ!”
“না না স্যার আপনি রাগ করবেন না। দোষ আপনার না, দোষ আমার। কারণ আমার জীবনে কি ঘটবে তা আমি নিজেই লিখি।”
জলিল সাহেব হতভম্ব হয়ে বললেন, “তুমি ঠিক কি বলতে চাও?”
“বলতেছি স্যার। আপনাকে বলার জন্যই তো ফোন দিলাম। আর কেউ না বুঝলেও আপনি বুঝবেন। স্যার , আমি আমার গল্পের নায়কের জীবনে যা ঘটাই ঠিক তাই আমার জীবনেও ঘটে। আপনি একটু চিন্তা করে দেখেন স্যার, তাহলেই বুঝতে পারবেন। এই যে এত অল্প সময়ে আমার এত ভালো চাকরি, লেখায় এত সুনাম, বই, পুরষ্ককার সবই কিন্তু আমার গল্পে আমি নিজেই লিখেছি। স্যার আপনি জানেন কিনা জানি না, আমার লেটেস্ট উপন্যাসের নায়কের মাথায় ঠিক এমন ভাবেই ইট দিয়ে আঘাত করে ভিলেন। আর দেখেন, ঠিক এইভাবেই আপনি আমাকে আঘাত করলেন। আমি এতদিন বিষয়টার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম না. ভাবতাম, দুই একটা ঘটনা মিলে যেতেই পারে কিন্তু আজকে আমি নিশ্চিত হলাম, আমি গল্পে যা লিখেছি, আমার জীবনেও ঠিক একই ঘটনা ঘটবে। আগে তো বুঝি নাই স্যার, নায়কের জীবনে নানান ঝামেলা দিয়ে ফেলছি, গল্পে ড্রামা,সাসপেন্স, থ্রিলারের খাতিরে তো খারাপ ভালো কত কিছুই লিখতে হয়। কিন্তু আমি তো বুঝি এই ঘটনা গুলি আমার জীবনেই ঘটবে।এখন আমার জীবনে একে একে প্রতিটা ঘটনা ঘটতেছে। পারলে স্যার সব ঘটনা বদলাইয়া নায়কের জীবনে সব ভালো আর ভালো রাখতাম। কিন্তু এখন তো আর সেইটা হবে না। কি মুসিবতে পড়ছি স্যার, বুঝতে পারছেন?” জলিল সাহেব কি বলবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। মাথায় আঘাত পেয়ে ছেলেটার মাথায় গন্ডগোল হলো নাকি। সুমনের সব গল্পের কাহিনী দ্রুত মনে করার চেষ্টা করলেন জলিল সাহেব। কি অদ্ভুত! আসলেই তো নায়কের জীবনের ঘটনার সাথে সুমনের জীবন মিলে যায়! কি অদ্ভুত! পুরো বিষয়টা নিশ্চিত কাকতালীয়। “স্যার, ও স্যার? শুনতেছেন? আপনার বিরুদ্ধে কাউকে কোনো অভিযোগ করবো না। দোষ তো আপনার না, আমি নিজেই তো এই ঘটনা গল্পতে লিখছি। সত্যি না হইয়া উপায় কি? এখন থেকে নায়ককে খালি সাকসেসফুল বানাবো, তার জীবনে কোনো ঝামেলা থাকবে না। হাহাহাহাহা। কিন্তু স্যার, একটা ঘটনা এখনো সত্যি হওয়া বাকি আছে।” “কোন ঘটনা?” নিচু গলায় বললেন জলিল সাহেব।
“ওই যে স্যার, আপনি আমার প্রথম যে গল্প পড়ছিলেন, নায়ক তার স্ত্রীকে খুন করে, দোষ ফেলে বৌয়ের বাপের উপরে, ওইটা। হাহাহাহাহা।” বিকারগ্রস্তের মতো হাসছে সুমন, যেন সুমন না, অন্য কেউ। জলিল সাহেবের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। তিনি ফোন কেটে দিলেন। পাগলের প্রলাপ শোনার মানে হয়না।
শায়লা হন্তদন্ত হয়ে বসার ঘরে এসে বলেন, “এই, গতকাল বিকালে নীলিমা বলে গেলো ওর বান্ধবী মালিহার বাসায় গ্রূপ স্টাডি করবে। এখন মালিহাকে ফোন করে দেখি ও নাকি মালিহার বাসায় যায়নি। নীলিমার ফোন বন্ধ। কোথায় গেলো মেয়েটা। আমার অস্থির লাগছে। খারাপ কিছু হলো নাতো?” সুমনের সাথে কথা বলার সময় মেসেঞ্জারের একটা নোটিফিকেশন এসেছিলো। জলিল সাহেব মেসেজটা খুললেন। নীলিমা লিখেছে, “বাবা, আমাকে ক্ষমা করো, আমি জানি তুমি সুমনকে খুবই অপছন্দ করো, কিন্তু আমি ওকে অনেক ভালোবাসি…………..” জলিল সাহেব আর পড়তে পারলেন না।