পাঁচ দিনের ছুটি কাটাতে গ্রামের বাড়ি’তে আমি। ইতিমধ্যে দু’দিন চলে গেছে। আজ তৃতীয় দিনের সকাল। মহল্লার মসজিদে ফজর নামাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলাম। সাতসকালেই গ্রামের সবাই দৌড়াদৌড়ি করে শওকত চেয়ারম্যানের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। ঘটনা কি কেউ সঠিক বলতে পারছেনা। অনেকেই বলছে- চেয়ারম্যান নাকি গলায় ফাঁস নিছে। কিন্তু আমার কেনো জানি বিশ্বাস হয়না! বয়স্ক মুরুব্বী মানুষ গলায় ফাঁস নিবে তা হয় নাকি! ধুর!
কৌতূহলী হয়ে আমিও চেয়ারম্যানের বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। ইতিমধ্যে শওকত চেয়ারম্যানের পুরো বাড়ি গ্রামের মানুষে ভরে গেছে। চেয়ারম্যানকে দেখলাম বিষণ্ণ চেহারায় উঠানের এক কোণায় জলচৌকিতে বসে আছে। অথচ একটু আগে শুনলাম শওকত চেয়ারম্যান নিজেই নাকি ফাঁস নিছে! বাঙালির স্বভাব আর বদলাবে না। সত্যমিথ্যা কিছু না জেনেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে চলার স্বভাব এখনো বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে।
ঘরের ভেতরে বাড়ির মহিলারা কান্নাকাটি করছে। চেয়ারম্যানের স্ত্রী দক্ষিণ দোয়ারি বড় ঘরের চৌকাঠে শরীর ঠেস দিয়ে বিলাপ করে যাচ্ছে- দিপা’রে তুই এইটা কি করলি! তোর কাছে আমরা কি অপরাধ করেছিলাম? ক্যান তুই আমাদের এত বড় শাস্তি দিলি! তোর সাথে তুই আমাকেও নিয়ে গেলি না ক্যান মা!
মানুষজন শুধু বাড়ির পেছন দিকটায় যাচ্ছে। অনেকেই আবার বাড়ির পেছন দিক থেকে বাড়ির ভেতরে ঢুকছে। আমিও বাড়ির পেছন দিকটায় চলে গেলাম। যাওয়ার পর যা দেখলাম তা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম’না। শওকত চেয়ারম্যানের একমাত্র কলেজ পড়ুয়া মেয়ে দিপা কাঁঠাল গাছের ডালের সাথে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফাঁস নিয়েছে! সামান্য একটু জিহ্বা বের হয়ে মাথাটা একদিকে কাত হয়ে আছে।
গ্রামের রুস্তম ভাই ঝুলন্ত লাশের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। রুস্তম ভাই উপস্থিত মানুষজন’দের কাউকে লাশের কাছে যেতে দিচ্ছেনা।
থানা থেকে দারোগা আসবে। দারোগা আসার আগ পর্যন্ত কেউ যেন লাশ স্পর্শ না করে। রুস্তম ভাই এমনটা বলে সবাইকে বার বার সাবধান করছেন।
ঘটনা হচ্ছে- শওকত চেয়ারম্যানের মেয়ে দিপার সাথে নাকি পাশের গ্রামের ইদ্রিস মাস্টারের ছেলে রোকনের গভীর প্রেম ছিলো।
যা শুনলাম- অনেকদিন আগে থেকেই নাকি রোকনকে তার পরিবার থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। একসময় রোকন দিপার কথা তার পরিবার’কে জানায়। তারপর গত কয়েকদিন আগে রোকনের বাবা ইদ্রিস মাস্টার শওকত চেয়ারম্যানের সাথে বাজারে দেখা করে। তারপর রোকন আর দিপার সম্পর্কের কথা চেয়ারম্যান’কে বলে। ইদ্রিস মাস্টার এও বলে যে- ওরা নিজেরা কোনো অঘটন ঘটানোর আগে আমরা গার্জিয়ানরা আনুষ্ঠানিক ভাবেই ওদের বিয়েটা দিয়ে দিই। সবকিছু ঠাণ্ডা মাথায় শুনে শওকত চেয়ারম্যান ইদ্রিস মাস্টার’কে বাজার ভর্তি মানুষের মধ্যেই ইচ্ছেমত অপমান অপদস্থ করে। ইদ্রিস মাস্টার নাকি বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়াতে চাচ্ছে। একথা শুনে ইদ্রিস মাস্টার ঐদিন বাজারে আর এক মুহূর্তও দেরি করেনি। মাথা নিচু করে সোজা বাড়িতে চলে যায়। শওকত চেয়ারম্যানও বাড়িতে এসে মেয়েকে অনেক শাসায়। গালমন্দ করে।
এদিকে রোকন তার বাবা ইদ্রিস মাস্টারকে মানুষ ভর্তি বাজারে অপমান করায় খুবই রাগান্বিত হয়। কিন্তু কিছু করার নেই রোকনের। সহ্য করা ছাড়া। শওকত চেয়ারম্যান মানুষ ভালো না। উল্টাপাল্টা কিছু করলে যেকোনো একটা মিথ্যা মামলায় ঢুকিয়ে পুরো পরিবারকে তছনছ করে ছাড়বে। আর এসব মিথ্যা মামলা করা শওকত চেয়ারম্যানের যেন এক প্রকার নেশা-ই বলা যায়। রোকন কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে গত পরশু অন্যত্র বিয়ে করে। রোকনের বিয়ের খবর কিকরে জানি দিপার কানেও যায়। তারপর-ই গতরাতে দিপা ফাঁস নেয়।
আজ খুব বুবুর কথা মনে পড়ছে আমার। ভীষণ মনে পড়ছে। ভীষণ। আমার বুবু। হ্যাঁ আমার নাসিমা বুবু। আজ থেকে ঠিক ১৬ বছর আগে আমার বুবুও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। বুবু সহ্য করতে পারিনি নোংরা যন্ত্রণা। যন্ত্রণাগুলা হয়তো প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো আমার বুবু’কে।
আমরা তিন ভাই-বোন আর মাকে অথই সাগরে ভাসিয়ে আব্বা একসময় ওপারে চলে যান। আব্বার মরণব্যাধি ক্যানসারের চিকিৎসার পেছনে জমিজমা যা একটু ছিলো সব বিক্রি করে দিতে হয়। বলতে গেলে একপ্রকার নিঃস্ব হয়ে যাই আমরা। শুধু ভিটেমাটি ছাড়া আর কিছুই বাকি থাকলো না। বাধ্য হয়ে আম্মাকে কাজে নামতে হয়। শুধু একমুঠো ভাতের জন্য। চার চারটি পেটের জন্য। এতো এতো কষ্টের মধ্যে, কঠিন ঐ দুঃখ সময়ে সবাই শুধু সান্ত্বনার বানী শুনিয়েছে আমাদের। কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। পেটের দায়ে আম্মা তখন মোল্লা বাড়ির “মোল্লা ডেইরী ফার্মে” কাজ নেন। আম্মার স্বল্প বেতনের টাকায় কোনোভাবে ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকি আমরা।
আমি তখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি। নাসিমা বুবু এস এস সি দিবে। আর রেশমার তখন চার/পাঁচ বছর হবে হয়তো। আম্মা কাজে যাওয়ায় নাসিমা বুবু রান্না করতো। বুবু-ই আমাকে প্রতিদিন গোসল করিয়ে দিতো। চুল আঁচড়িয়ে দিতো। বুবু নিজ হাতে আমাকে ভাত খাইয়ে দিতো। আমাকে পড়াতে বসাতো। বুবু নিজেও তার পড়ার বই নিয়ে বসতো। আমার একটা মাত্র শার্ট ছিলো। সেই শার্টের বোতাম ছিঁড়ে গেলে নাসিমা বুবু-ই লাগিয়ে দিতো। বুবুরও মাত্র দুইটা কামিজ ছিলো। তারমধ্যে একটা আবার পড়ার অযোগ্য। পড়তে পড়তে এমন পাতলা হয়েছে যে’ বার বার ছিঁড়ে যায়। ছেঁড়া অংশ বুবু আবার সেলাই করে করে পড়তো। আর ভালো কামিজটা পড়ে বুবু স্কুলে যেতো। আম্মা বলেছিলো- সামনে মাসে বেতন পেয়ে নাসিমা বুবুর জন্য একটা কামিজ বানাবে। আর আমার জন্য একটা শার্ট কিনে দিবে। নাসিমা বুবু আর আমি সেদিন যে কি খুশি হয়েছিলাম।
দেখতে দেখতে নাসিমা বুবুর এস এস সি পরীক্ষাও চলে আসলো। আর তিনমাস বাকি আছে পরীক্ষার। স্কুলে নোটিশ দিয়েছে ফরম ফিলআপ করতে হবে। আম্মার কাছে কোনো টাকা-পয়সা নেই। আমরা গরিব আর এতিম বলে স্কুল থেকে বুবুর ফরম ফিলআপের মূল টাকা থেকে অর্ধেক টাকা মওকুফ করে দিয়েছে। আর অর্ধেক টাকা পরিশোধ করতে হবে। বাধ্য হয়ে আব্বার দেয়া বুবুর শেষ স্মৃতিচিহ্ন টুকু বিক্রি করতে হয়েছে। নাসিমা বুবু যখন ফাইভে বৃত্তি পায় আব্বা খুশী হয়ে নাসিমা বুবু’কে একজোড়া কানের রিং বানিয়ে দিয়েছিল। হ্যাঁ, এস এস সি ফরম পূরণের জন্য বুবু’কে সেই কানের রিং জোড়া বিক্রি করতে হয়েছে।
বুবুকে দেয়া আব্বার একমাত্র স্মৃতি বিক্রি করে বুবু ফরম পূরণ করে। যথারীতি নাসিমা বুবু পরীক্ষায়ও অংশ নেয়। যথাসময় পরীক্ষার রেজাল্টও হয়। নাসিমা বুবু এ প্লাস পায়। কিন্তু আমার বুবু সেই রেজাল্ট আর দেখে যেতে পারেনি। হ্যাঁ আমার নাসিমা বুবু। বুবু তখন আকাশের তারা। আমি আর আর রেশমা প্রতিরাতেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। বুবুকে দেখতাম। আম্মা হাত দিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে দিতো আর বলতো- ঐ যে পাশাপাশি বড় দুইটা তারা দেখছিস না? একটা তোদের আব্বা আরেকটা তোদের নাসিমা বুবু। পর ক্ষণেই দেখতাম আম্মার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়তো। আম্মা নিঃশব্দে কাঁদতেন।
আব্বার মৃত্যুশোক মাত্র কাটিয়ে উঠেছিলাম আমরা। ঠিক এরমধ্যেই আবারো একটা ঝড় বয়ে যায় আমার পরিবারের উপর দিয়ে। নষ্ট সমাজের ঝড়। যে ঝড়ে অকালেই ঝরে পড়ে হাজারো ফুল। লণ্ডভণ্ড করে দেয় এক একটা ফুলের বাগান।
আমার নাসিমা বুবু অনেক সুন্দর ছিলো। আম্মা বলতো- নাসিমা বুবু নাকি দেখতে ঠিক আব্বার মতো সুন্দর হয়েছে।
বুবু যখন ক্লাস নাইনে পড়ে তখন থেকেই শওকত চেয়ারম্যানের ছোট ছেলে বিষু নাসিমা বুবুর পিছু নেয়। বুবু স্কুলে যাওয়ার পথে বিষু ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা বুবু’কে উত্যক্ত করে। যা প্রতিদিন প্রতিনিয়ত। এবং এই উত্যক্ত ক্রমশই বাড়তেই থাকে। এরকম প্রতিদিন রাস্তায় বিষুর নানান বাজে মন্তব্য অপেক্ষা করেও নাসিমা বুবু মাথা নিচু করে স্কুলে যেতে থাকে। কিছু করার ছিলনা নাসিমা বুবুর। বিষুর বিরুদ্ধে কাকে বিচার দিবে? কে করবে বিষুর বিচার? চেয়ারম্যানের ছেলের বিরুদ্ধে বিচার দিবে এমন সাধ্য কার! উল্টা আরো হয়রানি হতে হবে। নাসিমা বুবুও কোনো ঝামেলা চায়নি। শুধু আম্মাকে বলে রেখেছে। আম্মা বুবু’কে ধৈর্য ধরে সহ্য করতে বলে। আম্মা আফসোসের সুরে আরও বলেন- আজ যদি তোর আব্বা বেঁচে থাকতো তাহলে হয়তো এদিন’টা আর দেখতে হতোনা। আর তোদের এমনও ভাগ্য’রে মা! তোদের নেই কোনো বড়ভাই বা নেই কোনো চাচা। নিকটাত্মীয় বলতে তোদের একূলে কেউ নেই। যদিও তোদের একটা মামা আছে। কিন্তু তোদের মামা থেকেও না থাকার মতো।
আম্মার কথা শুনে বুবু তার অভ্যাস মতই মাথা নিচু করে কোনোভাবে নাইন-টেন শেষ করে।
এস এস সি পরীক্ষাও শেষ হয়। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর নাসিমা বুবু বাড়ির বাইরে তেমন কোথাও যায়না। বুবু বাইরে যায়না বলে বিষু বাহিনী বুবুকে দেখতে না পেয়ে বাড়িতে আসতে শুরু করে। বাড়িতে এসে বুবুকে সবসময় কুমন্তব্য করে। কুপ্রস্তাব দেয়। সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার পর আম্মা আর বসে থাকেনি। একদিন আম্মা ফার্ম থেকে বিকেলে বাড়িতে এসে বুবু’কে কাঁদতে দেখে। বুবুর কাছে ঘটনা শোনার পর বুবুর হাত ধরে বুবুকে নিয়ে আম্মা শওকত চেয়ারম্যানের বাড়িতে যায়। তার ছেলে বিষুর এমন সব কুকর্মের জন্য বিচার চায়। তারপর চেয়ারম্যান সেদিন বিচার করবে তো দূরের কথা! উল্টা আম্মা আর বুবু’কে শওকত চেয়ারম্যান অনেক অপমান করে। কুলাঙ্গার ছেলের পক্ষ নিয়ে শওকত চেয়ারম্যান আম্মা আর বুবু’র সাথে খারাপ খারাপ ভাষা ব্যবহার করে। আমার আম্মা আর বুবু চোখের পানি ফেলতে ফেলতে সেদিন বাড়িতে চলে আসে। সেই রাতটুকু আর পার হতে দেয়নি আমার বুবু। হ্যাঁ আমার নাসিমা বুবু। এ পৃথিবীর প্রতি এক আকাশ অভিমান নিয়ে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে বুবু। নষ্ট সমাজ’কে আর সহ্য করতে না পেরে বুবু চলে যায় আমার আব্বার কাছে। সেখানে আব্বা আছেন। আব্বা একা একা থাকেন। নাসিমা বুবুও চলে যায় সেখানে। এখন আর বুবু’র ভয় নেই।
আমি বড়ো হলাম। পড়াশোনা শেষ করলাম। ভালো বেতনের একটা চাকুরীও পেলাম। রেশমাও জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি’তে পড়ে। এখন আম্মাকে আর ফার্মে চাকুরী করতে হয়না। এখন আম্মা-ই বরং চাকুরী দেয়। আমাদের এলাকার বেকার যুবকদের একটা কর্মস্থানের জায়গাও হয়েছে। আম্মার মাধ্যমে। আম্মা দোয়া করেছেন আর আমি চেষ্টা করেছি। হ্যাঁ, আমার আম্মার নিজের অনেক বড় পরিসরে একটি ফার্ম আছে। যে ফার্মে প্রায় তিনশো’র মতো দুধের গরু আছে। আম্মা ফার্মের নাম দিয়েছেন- “নাসিমা ডেইরী ফার্ম”। স্বত্বাধিকারী: মোছা: নাজমা বেগম।
আম্মাকে এখন সমাজের উন্নয়নমূলক বিভিন্ন মিটিং সেমিনারে দেখা যায়। প্রায়শই উপজেলা কর্মকর্তারা আম্মাকে নিয়ে মিটিং করেন। উপজেলায় ডাকেন। আবার লোকমুখে শোনা যায় আমার আম্মা নাকি সামনে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে একজন চেয়ারম্যান প্রার্থী। দেখা যাক জনগণ কাকে চায়। শওকত চেয়ারম্যান! নাকি আম্মা!