পুতুল মডেল
সুজানা তার ফিগার ঠিক রাখার জন্য একটা বিশেষ ডায়েট চার্ট ফলো করে। সে কোন প্রকার রিস্ক নিতে চায়না তাই একটা বেশ নামকরা ডায়েটিশিয়ান দ্বারা পরিচালিত কাটারিং থেকে তার খাবার আসে। এতে বেশ উপকার পাচ্ছে।তার ওজন দুই মাসে কমেছে প্রায় ৫ কেজি।পাশাপাশি সে নিয়মিত জিমে যায়। আসলে বিজ্ঞাপন সংস্থায় টিকে থাকতে হলে রুপই একমাত্র ভরসা। তার উপর ফিগারটা যদি ছিপছিপে না হয় তাহলে তো ফ্যাশন নিয়ে পাঁচ তারকা হোটেলে যে শো হয় সেখানে ডাক পাওয়া যায়না। তার আয়ের সিংহভাগই উপার্জিত হয় এখান থেকে।
সুজানা ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে সুজানা হলেও মা তাকে এখনও সেঁজুতি বলেই ডাকে। সেকেলে নামটা ম্যাডাম প্রথমেই পালটে দিয়েছেন। সেঁজুতিও এখন অভ্যস্ত সুজানা শুনতেই বরং মা আগের নামে ডাকলে সে বিরক্তই হয়।
সুজানার এই লাইনে পথ চলা শুরু সেই পাঁচ বছর আগে যখন বাবা তাদের দুই বোন আর মাকে ফেলে পরপারে চলে যায়। তখন সবে সে উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছে। বাবা মারা যাবার পর আত্মীয় অনাত্মীয় কেউ পাশে দাঁড়ায়নি । বরং এই আপাই মানে ম্যাডাম তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। পত্রিকায় তখন এক বিজ্ঞাপন এসেছিল একটা সোপ কোম্পানি তাদের প্রডাক্টের বিজ্ঞাপনের জন্য একজন নতুন মুখ খুঁজছে । সেঁজুতি তখন চলে গিয়েছিল যদি কাজটি পায় এই ভরসায়। চাকুরীর জন্য বিভিন্ন অফিসে ধরনা দিতে দিতে সে ছিল ক্লান্ত। দুইটি টিউশনি ছিল কিন্তু এই দিয়ে কি আর সংসার চলে!
ফাইনাল সিলেকশনে সেঁজুতি না আসলেও বিচারকদের দৃষ্টি কেড়েছিল তার উচ্চতা এবং ধবধবে সাদা গায়ের রঙের জন্য। আর সেখানেই ম্যাডামের সাথে পরিচয়। ম্যাডাম তার কার্ড দিয়ে বলেছিলেন যোগাযোগ করতে।
ভয়ে ভয়ে একদিন ম্যাডামের অফিসে সেঁজুতি গিয়েছিল। ম্যাডাম তখন বলেছিলেন পাঁচ তারকা হোটেলে ফ্যাশন শো করার কথা। তবে তার আগে সেঁজুতিকে গ্রুমিং সেশনে অংশগ্রহন করতে হবে। সেঁজুতি রাজি হয়ে গিয়েছিল।
সেঁজুতি মানে এখনকার সুজানা মাত্র দুই মাসে ক্যাট ওয়াক থেকে শুরু করে স্মার্ট ভাবে হাঁটা চলা শহুরে পার্টি আদবকায়দা সব শিখে নিয়েছিল। দুরু দুরু বুকে যেদিন প্রথম রাম্পে সবার সাথে দাঁড়িয়েছিল সেদিন সে খুব সুন্দর ভাবেই পেরেছিল আর তাইতো বিখ্যাত এক জুয়েলারি কোম্পানির এম ডি তাকে তাদের ব্র্যান্ড এম্বাসেডার হবার প্রস্তাব দিয়ে ফেলে। সুজানা ছিল আবেগে আত্মহারা । এত বড় সুযোগ তার জীবনে আসবে তা সে কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি!
ম্যাডাম নিজে এসে অভিনন্দন জানিয়ে গিয়েছিল। বিজ্ঞাপনটি চিত্রায়িত হবে ব্যাংককে তাই তড়িঘড়ি করে পাসপোর্ট ভিসা সব কাজ ম্যাডাম নিজ দায়িত্ত্বে করে দিলেন। সব চলছিল স্বপ্নের মত কিন্তু ব্যাংককে পৌঁছানোর পর বুঝতে পারে সে গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার। কারন তার থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছে স্বয়ং জুয়েলারি মালিকের সাথে একই রুমে। ম্যাডামের সাথে নাকি এমনই কথা হয়েছে। সুজানা কোনভাবেই রক্ষা পায় না। তার সম্ভ্রম খোয়াতে হয়। বিদেশে তার কিছুই করার ছিলনা। এদিকে সে তার কাজের টাকা বেশীরভাগই অগ্রিম নিয়ে চুক্তিপত্রে সাইন করে ফেলেছে। দুর্বিষহ সাতটি দিন পর সুজানা দেশে ফিরে আসে।
রাগে দুঃখে বেশ কিছুদিন ম্যাডামের সাথে দেখা পর্যন্ত করেনি। এর মাঝে সুজানার মা অসুস্থ হয়ে পড়ে । ডাক্তার বলে উনার কিডনিতে পাথর হয়েছে তাই তাড়াতাড়ি অপারেশন করতে হবে। সুজানা বাধ্য হয়েই আবার ম্যাডামের সাথে দেখা করে। এভাবেই এই মুখোশধারী আধুনিক চক্রের সাথে সুজানা জড়িয়ে পড়ে।
সুজানা এখন নামকরা মডেল। সবাই তাকে এক নামে চেনে। শুধু একটাই যা সবার অজানা তা হল এই পেশার পিছনের কালো কুৎসিত চেহারাটা। এপ্রিল থেকে আগস্ট মানে সামার সিজনটা সুজানার জন্য খুব ব্যস্তময় সময়। শুধু তাই নয় ম্যাডামরা বিভিন্ন এজেন্সির সাথে জড়িত। যাদের কাজ হল আরবের বিভিন্ন শেখদের সাথে সাত দিন দুবাই, থাইল্যান্ড নয়তো ইউরোপে ট্যুর ঠিক করে দেয়া। তাদের খরচে বেড়ানো সাথে বাড়তি ইনকাম আছে। শেখরা আবার অনেক হাতখোলা। তারা দামী গিফট কিনে দেয়। অনেক শপিংও করা যায়। প্রথমে ইতস্তত করলেও এখন এই লাইফের সাথে সুজানা ভালভাবেই মানিয়ে নিয়েছে।
সুজানা ঢাকায় একটা ছোট ফ্লাট কিনেছে। ছোট বোনকে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়াচ্ছে। মা অনেক সুস্থ। এই জীবনে আছে বলেই সম্ভব হয়েছে।
সুজানা বেশিরভাগ সময় ফিরে রাত ১২ টার পরে । মাঝে মাঝে সুজানা ভাবে তার মা বোন কি তার এই জীবনের কথা জানে না! নাকি না বুঝার ভান করে থাকে। আজ বাসায় ফিরতেই ছোট বোনের আবদার তারা বন্ধুরা মিলে সার্ক দেশ গুলিতে ট্যুরে যাবে। এটা নাকি এসাইনমেন্টের অংশ। সুজানা ঘুম জড়ানো গলায় শুধু বলে হবে! আজ সুজানা দুই পেগ বেশী পান করে ফেলেছে তাই কথা বলতে পারছিলনা। রুমে ঢুকতেই মোবাইল স্ক্রিনে ম্যাডামের ছবি ভেসে উঠল । সুজানা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ম্যাডামের গলা “সুজানা মাই লিটল বেবি কাল তোমাকে বাঙ্কক যেতে হবে। তোমার সব রেডি । এইবার আরও বেশী পাবে!” সুজানা ঘুম জড়ানো গলায় ওকে বলে ফোন কেটে দেয়।
সুজানা রেডি হয়ে নিয়েছে। মোবাইলে এসএমএস চলে এসেছে তার একাউন্টে দুই লাখ টাকা জমা হয়েছে। সুজানা রিস্ক নিতে রাজি নয়। তাড়াতাড়ি ছোট বোনকে চেক লিখে দিল । বাইরে গাড়ি অপেক্ষা করছে সুজানার জন্য। তার গন্তব্য জানা থাকলেও তার শেষ সে জানে না। আজ অকারনেই সুজানার চোখ ভিজে যাচ্ছে। পিছন থেকে মা আর বোনের কথা শুনতে পায়। তারা তখন আলোচনায় মশগুল এইবার কি কি আনতে পারে সুজানা বিদেশ থেকে।
-হালিমা রিমা