বারান্দায় বাতি জালানো নেই। আমি বসে আছি অন্ধকারে। চারদিক নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ মধ্যরাত। এই নিস্তব্ধতা ভেদ করে রুনুর কান্নার শব্দ আছে ক্ষিণস্বরে। যে কান্নার শব্দে আমার হৃদয়ের কোথাও চিনচিনে ব্যথা করছে। মনে হল,সিগারেট ধরাতে পারলে ভাল হত!
কিন্তুু তা করা যাচ্ছে না। সামনেই বারান্দার রেলিং ধরে মা দাঁড়িয়ে আছেন। তার কাছে সেটা হয়ত ভাল লাগবে না। হঠাৎ মা বললেন,
‘বাবলু, তোমার মন এত অস্থির হয়ে আছে কেন বাবা?’
‘আমি মায়ের দিকে তাকালাম।তার উপস্থিতি বোঝা গেলেও অন্ধকারে তার মুখ দেখতে পারছিনা আমি।’
আমি জানিনা মা’
মা আমার পাশের চেয়ারটায় এসে বসলেন। আলতো করে তার শীতল হাত আমার কাঁধে রাখলেন।
‘তুমি কি কারো উপর রেগে আছ?’
আমি মনে মনে ভাবতে থাকলাম, আমার কি সত্যিই কারও উপর রাগ আছে? বাবা,ছোটমা,রুনু,মীরা, কে আমার রাগের কারন? নাহ্,কেউ নয়। এদের কারও কাছে তো আমার প্রাপ্তি কম নয়। তবে কেন এ অস্থিরতা?
মা বললেন,রুনুর জন্য কিছু করা দরকার তোমার। তুমি ছেলেটার সাথে কি একবার কথা বলেছ?’
‘হ্যা, বলেছি মা। সে বলেছে,রুনু তার ভাল বান্ধবী। এমন মেয়ে বন্ধু তার অনেক আছে। ‘
মা খুব হালকা করে একটা দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেললেন, ‘তুমি রুনুর সাথে কথা বল।’
‘আমি কি যে বলবো তা জানিনা মা।’
‘বাবু,তোমাকে এদের সবার পাশে দাঁড়াতে হবে। তোমাকে তাদের প্রয়োজন।’
‘আমি অন্ধকারে মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। তার অস্পষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘তোমার পাশেও তো আমার দাঁড়াবার প্রয়োজন ছিল মা! আমি, বাবা কেউ ছিলাম না তোমার পাশে।’
‘সে ভুল যাতে আর না হয় সেটাই তো তুমি চাও তাই না?
আর তাছাড়া তুমি তোমার বাবা,ছোটমা,রুনু সবাইকে খুব ভালবাসো। ভালবাসার এই মানুষগুলোর কোন ক্ষতি তুমি হতে দেবেনা আমি জানি। বল ঠিক না?’
‘আমি একটু সময় চুপ থেকে ফেললাম,
‘হ্যা ঠিক মা’
‘চল,এবার শুতে চল’তিনি আমার হাত ধরলেন।
আমি বাধ্য ছেলের মত উঠে এলাম। মা আমার সাথে এলেন। বিছানায় আমার মাথার পাশে বসে বললেন,
‘তোমার বাবা সুস্থ হয়ে উঠলে রুনুর ধুমধাম করে বিয়ে দিবে। এ সংসারের চাকা আবার ঘুরাতে হবে তোমাকে। এটা ছেলের দ্বায়িত্ব।’
আমি কিছুই বললাম না। আমার দু’চোখ ভারী হয়ে এসেছে।মা কি বলছেন আমি আর বুঝতে পারছি না। আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম আর ভয়ঙ্কর একটা স্বপ্ন দেখতে লাগলাম-
মীরা আমি কোন এক জঙ্গলে ঘুরছি। গাছে গাছে ভরা জঙ্গলে আলো ছায়া খেলা করছে। মীরা আমার হাত ধরে গান গাইছে
‘ভালবাসি ভালবাসি….
ঐ সুরে কাছে দূরে,জলে স্থলে….’
কয়েকটা ছেলে কোথায় থেকে যেন ছুটে এলো। মীরাকে ওরা আমার কাছ থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে।
কেউ একজন পিছন থেকে আমাকে ধরে রেখেছে। মীরা চিৎকার করছে,
‘দাদা, আমাকে বাচাঁও। ওরা আমাকে ছিঁড়ে খাবে। আমি মরে যাব দাদা’
আমি তখন দেখলাম, মীরা নয় এতো রুনু। রুনুর শাড়ি ওরা হেচঁকা টান দিয়ে খুলে ফেলছে…..
আমি প্রানপণে চেষ্টা করছি নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে। তখন যে লোকটি আমাকে ধরে রেখেছে সে আমাকে মাটিতে ফেলে বুকের উপর উঠে বসল। আমার নি:শ্বাস আটকে আসতে লাগলো। লোকটির মুখ শেয়ালের মুখের মত। রক্তাভ লাল চোখ। মুখ থেকে লালা পড়ছে আমার গায়ে। ভয়ঙ্কর সেই কুৎসিত মুখের দিকে তাকিয়ে আমি হাত পা ছুড়াছুড়ি করছি। তখন হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। বুঝতে পারলাম, দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে রুনু ডাকছে,
‘দাদা, উঠো। দরজা খোল। দাদা,বেরিয়ে আস।’
আমি আতঙ্কভরা কন্ঠে বলতে লাগলাম,
‘রুনু বাবা কোথায়, বাবা?’…….
তখন অস্পষ্ট আলোয় দেখলাম, মা আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ঘরের বাতি জ্বালিয়ে দিলেন। সে আলোয় তাকে আমি চারদিকে খুঁজতে লাগলাম…..
(চলবে….)
-সাবিনা ইয়াছমিন বেলা