আমার পাশের ঘড়টায় থাকে রুনু। রুনু বয়সে আমার থেকে এক বছরের ছোট। বাবা-মা তাদের সন্তানদের নাম মিলিয়ে রাখতে পছন্দ করে। আমাদের দু’ভাই-বোনের নাম দু’রকম। বাবলু’র বোনের নাম রুনু। বুঝতেই পারছেন, আমার নাম বাবলু। বাবা অবশ্যি আমাকে বাবু বলে ডাকেন। নাম দু’রকম হয়েছে হয়ত আমরা দু’মায়ের দু’জন বলে।
বাবার কথা বলি। মা যখন এ বাড়িতে থাকতেন তখন বাবা বড় ব্যবসায়ী। মায়ের সব গয়না বেঁচে দিয়ে সেই টাকায় তিনি মার্কেটে সিড়িঁর নীচে ছোট্র একটা রেডিমেড কাপড়ের দোকান খুললেন। বছর না ঘুড়তেই একটা থেকে তিনি মার্কেটে পাচঁটা দোকান নিয়ে ফেলেন। সবগুলোই ফ্যাশন হাউজ। সে সময় ব্যবসা বাজারের একবন্ধুর পরামর্শে দু’জনে মিলে পুরো মার্কেটটাই দশ বছরের সিকিউরিটিতে তারা নিয়ে ফেলেন। বাবার তখন অনেক টাকা। পাচঁ কাঠা জায়গার উপর টিনের হাফ বিল্ডিং ফেলে দিয়ে বাবা এখানে পাচঁতলা বাড়ি বানালেন। মা তখন অতি আনন্দে শহরের বড় বড় দোকান ঘুড়ে দামী ফার্নিচারে বাড়ি সাজালেন। তবুও মা তার নিজের এই সাজানো বাড়িতে বেশিদিন থাকতে পারলেন না। দু’বছরের মাথায় বাবা একদিন আমার ছোট মা’কে নিয়ে এ বাড়িতে উঠলেন। মা কিছু বললেন না। শুধু পরেরদিন সকালবেলা আমাকে কোলে করে তিনি বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। এ সবই আমার শোনা কথা। নানীজানের মুখে শুনেছি। আমি তখন অনেক ছোট।
প্রায়ই রাতজেগে আমি এসব ভাবতে থাকি। এই এখন যেমন ভাবছি। রাত বারোটা পঁচিশ। রুনু বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। বারান্দার ওমাথায় বাবার রুম থেকে কাঁশির শব্দ আসছে। তার মানে বাবাও জেগে আছেন। আমি ঘুমাতে ভয় পাই। প্রায়রাতেই আমার দু:স্বপ্ন হয় বলে। শুয়ে শুয়ে কত্তকিছু ভাবি আর ছটফট করতে থাকি। রাত দুটোর পর কোন একসময় আমার ঘুম আসে। ভোর রাতে আমার গোঙ্গানির শব্দে রুনু উঠে আসে। দরজায় ধাক্কাধাক্কির শব্দে বাবাও উঠে আসেন। দরজার সামনে দাড়িয়ে বাবা ব্যাকুল হয়ে ডাকতে থাকেন,
‘কি হয়েছে রে বাবু? ওঠ বাবা,দরজা খোল”
আমার ঘুম ভাঙ্গে না। গো গো শব্দে বিছানায় হাত-পা ছুড়তে থাকি। রুনু আর বাবা দু’জনে দরজা ধাক্কাতেই থাকে। একসময় যখন আমার ঘুম ভাঙ্গে, আমি কাঁপা গলায় মা, মা ডাকতে থাকি। বাবা বলতে থাকেন,
‘বাবারে,বাতিটা জ্বালা, দরজা খোল।’
রুনু বলে,
‘বেরিয়ে এসো দাদা।’ আমি বলি-‘রুনু আছিস? বাবা কই,বাবা?বাবা বলেন,’আমরা এখানে আছি। আমি আছি রুনু আছে। তুই বেড়িয়ে আয়।’
আমি অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে দরজা খুলি। বাবা আমার হাত ধরে বারান্দায় বসিয়ে দেন। রুনু দৌঁড়ে যায় পানি আনতে।
বাবা বলেন,’একটা তাবিজ-কবজের ব্যবস্থা নিতে হবে। তোর এই বোবাধরা রোগ বড় জ্বালাতন করছে। ছোট বেলায় তো এসব ছিলনা। এখন এসব এলো কোথা থেকে বলতো?’
রুনু পানির গ্লাস আমার হাতে দিয়ে হাসতে থাকে। ‘বোবা-টোবা কিছু না বাবা, তোমার রূপবান ছেলের প্রেমে পড়েছে পরী। দাদাকে বিয়ে দিয়ে দাও,সব ঠিক হয়ে যাবে।’
আমি রুনুকে ধমক দেই,’তুই বুঝবি কি? বোবায় ধরা কি জিনিস! একদিন বেকায়দায় ফেলে তো আমাকে মেরেই ফেলবে।’রুনুর হাসি বাড়ে। মুখে আঁচল চেপে সে হাসতে থাকে।
বাবা আমার মাথায় হাত রাখেন বারবার। কি সব দোয়া পড়ে কপালে ফুঁ দিয়ে বলেন,’এরপর থেকে দরজা খুলে ঘুমাবি। যা , ঘুমাতে যা। ফজরের আযান পড়বে কিছুক্ষনের মধ্যে।’
চটি পায়ে শব্দ করতে করতে তিনি বাথরুমে ঢোকেন। আমি শান্ত হয়ে বিছানায় আসি। শোয়ার কিছুক্ষণের মাঝে আবার ঘুমিয়ে পড়ি।
আমার ছোট মায়ের চেঁচামেচিতে যখন আমার ঘুম ভাঙ্গে তখন সকাল নয়টা বাজে। বাবা চা হাতে পেপার নিয়ে এ সময় বারান্দায় বসে থাকেন। এখন তার আর কোন ব্যস্ততা নেই। তার ব্যবসা একসময় লস কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সেই ব্যবসায়ী বন্ধু সুযোগ বুঝে সব হাতিয়ে নিয়েছে। এখন আর আমাদের কিছু নেই। এই বাড়িটাই সম্বল। আমরা তিনতলায় থাকি। পাচঁ তলা বাড়ির আর সবটা ভাড়া দেয়া। মাসশেষে ভাড়া যা আসে,তাতেই সংসার চলে।
বাবা অবশ্যি বলেন,এ নাকি আমার মায়ের অভিশাপের ফল।’বুঝলি বাবু, তোর মায়ের গয়না বেঁচা ব্যবসা। ধর্মে আছে গয়না বেঁচা পয়সায় ব্যবসা -বাণিজ্য হয়না।’ কিছুটা নীচু স্বরে আবার বলেন,’তোকে নিয়ে চলে যাবার পর তোর মা আর একবার এসেছিল আমার কাছে তার দেনমোহর তিন লাখ টাকার জন্য। আমি তাকে দেইনি। ‘
আমি বলি,’ দিলেনা কেন?
বাবা বলেন,’আমি তাকে ছেড়ে দিইনি। সে আমাকে ছেড়ে গিয়েছিল। অবশ্যি তারই গয়না বেঁচা ব্যবসার পয়সা। দিয়ে দেয়া উচিত ছিল। তাহলে হয়ত সে তোকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতো না। তোকে নিয়ে টাকাটা দিয়ে চলতে পারতো।’
আমি বলি,’ যদি জানতেই তাহলে দিতে পারতে। তালাক যে যাকে দিক,দেনমোহর স্ত্রীর হক বাবা।’
বাবা তার মাথা নিঁচু করে কোলে রাখা হাতদুটোর দিকে অন্যমনস্ক চেয়ে থাকেন। তিনি মনে মনে কি ভাবেন আমি জানিনা। কি ভালই না হতো, যদি সন্তান তার বাবা-মায়ের মনের কথা বুঝতে পারতো! সন্তান যেমন পেটে থাকতে মায়ের সব অনুভব বুঝতে পারে। আমি তাহলে একবার আমার মায়ের মনে ঘুরে আসতাম! তাকে বুঝতে পারতাম একবার!
চলবে…….
–বেলা প্রধান