লোকটা প্রতিদিন সকালে এই ক্যাফেতে এসে কোনার টেবিলটা দখল করে। তারপর একের পর এক কালো কফি সাবাড় করতে থাকে। তার সামনে একটা ম্যাকবুক খোলা থাকে, স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কী যেনো ভাবে লোকটা। কিছু টাইপ করে, আবার অনেকসময় হতাশা আর বিরক্তি নিয়ে জানালার বাইরে সফেদ বরফের দিকে তাকিয়ে থাকে।
মিরা লোকটাকে গত এক সপ্তাহ ধরে লক্ষ্য করছে। প্রতিদিন ক্যাফে খোলার সাথে সাথেই লোকটা এসে ঢোকে, থাকে দুপুর পর্যন্ত। তারপর কম্পিউটার সহ বাকি সব গুটিয়ে চলে যায়। বয়স পঞ্চাশ হবে হয়তো। গভীর নীল চোখের চারপাশে বেশকিছু গভীর ভাঁজ, মাথার চুল ঘন সোনালী। বেশ পেটানো শরীর। ভারী কোটে ঢেকে রাখা শরীর কেমন কুঁজো হয়ে বসে কম্পেউটারে পূর্ণ মনোযোগ দেয়। ক্যাফের ভেতরেও কোট পরে থাকে, তার মানে লোকটা কোনো উষ্ণ দেশ থেকে এসেছে, এখানকার অসহনীয় ঠান্ডার সাথে পরিচয় নেই। অবশ্য দেখে বোঝা যায় না ভদ্রলোক কোন দেশী, পর্তুগীজ নাকি নরওয়েজিয়ান, নাকি সুইডিশ? কী জানি, মানুষের চেহারা দেখে সে কোন দেশী, সেটা ঠিক বুঝতে পারে না মিরা।
সুইডেন বর্ডারের কাছে রিকসগার্সেন শহর মূলত শীতকালীন স্কি রিজোর্ট হিসেবে বিখ্যাত। অক্টোবরের শেষ থেকেই প্রবল তুষারপাত হানা দেয়। ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত স্কি-প্রেমী পর্যটকে বেশ জমে ওঠে এই শহর। বাকি সময়টা শহরটা কেমন যেন শান্ত শুভ্র নির্জীব সুন্দরী নারীর রূপ ধারণ করে, মীরার ভালো লাগে না। ফেব্রুয়ারি এলেই ওর মন ভালো হতে থাকে। কত রকম মানুষ আসে তখন ক্যাফেতে। উৎসব উৎসব একটা উচ্ছলতা চারদিকে।
দুবছর আগে মিরা কাছেই লুলেয়া ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজিতে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসেছে। বাবার সাথে অনেকটা ঝগড়া করেই এসেছে। তার বাবা মা চেয়েছিলেন মেয়ে দেশেই পড়বে, বছরখানেক বাংলাদেশেই পড়েছে। মিরা স্বাধীনতা চাইছিলো। হুট্ করে এখানে স্কলারশিপ পেয়ে যাওয়ায় মাত্র এক মাসের নোটিশে চলে এসেছে। বাবার আপত্তির মূল কারণ ছিল এই তীব্র শৈত্য। বারবার বলছিলেন সুইডেনের এমন ঠান্ডা জায়গায় মিরা কিছুতেই টিকতে পারবে না, শুধু শুধু গাঁটের পয়সা খসিয়ে নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে চললো মেয়ে। বাবাকে সায় দিতে মা আরেক পা এগিয়ে, অবিবাহিত তরুণী কন্যা বিদেশে একা একা থাকবে -তাতে ওনার ঘোর আপত্তি। তার কথা হচ্ছে দেশেই অনার্স শেষ করে তবেই মাস্টার্স করতে যাওয়া উচিত, তখন মীরার বিচার বিবেচনা বোধ আরো পরিপক্ক হবে। কিন্তু মিরার যুক্তি স্কলারশিপ যখন পাওয়া গেছে তখন সুযোগটা ছাড়া কিছুতেই উচিত হবে না। এমনিতে মেয়েকে বিদেশে পাঠিয়ে পড়ানোর মতো বিলাসিতা মিরার বাবাকে মানায় না। নিতান্তই মধ্যবিত্ত পরিবার মিরাদের।
মিরার বড় মামা সাদেক সাহেব সবাইকে বুঝিয়ে পড়িয়ে তবেই না মিরাকে এখানে আসার ব্যবস্থা করে দিলেন। এখানে আসার পর মিরার জীবনটা পাল্টে গেছে। জীবনকে কত রকম ভাবে দেখতে শিখেছে ও! এই দুইবছরে নিজের প্রতি বিশ্বাস বেড়েছে বহুগুন। খারাপ অভিজ্ঞতা যে হয়নি , তা নয়। অনেকেই ওর বাদামি ত্বকের দিকে তির্যক দৃষ্টি এবং মন্তব্য ছুঁড়ে দিয়েছে। অবশ্য এসব মন্দ লাগাকে পাশ কাটাতেও শিখে গেছে এতদিনে।
পর্যটক বাড়লে গ্রীষ্মের এই সময়টায় পার্ট টাইম কাজ করে মিরা। এই গ্রীষ্মে ‘লাপ্পিস ক্যাফে’তে ওয়েটার হিসেবে চাকরি নিয়েছে। এর আগের গ্রীষ্মে ক্যাফের বুড়ো মালিক লিয়ামের সাথে বেশ ভাব হয়েছিল ওর। তাই এবারে কাজটা পেতে খুব বেগ পেতে হয়নি। সপ্তাহে চারদিন কাজ করে মিরা, ক্লাসগুলো বিকেলে বলে সমস্যা হয়না।
বেশ কয়েকবার কফি স্যান্ডউইচ পরিবেশন করেছে লোকটাকে। যাওয়ার সময় বেশ ভালো টিপস রেখে যায় লোকটা। কিন্তু কখনোই আগে বাড়িয়ে কথা বলতে যায়নি মিরা। হঠাৎ একদিন লোকটা তার ল্যাপটপের ব্যাগটা ফেলে চলে গেলো ভুলে। মিরা যত্ন করে রাখলো ব্যাগটা, পরদিন লোকটা এলে ফেরত দেবে বলে।
আশ্চর্য, লোকটা পরের তিনদিন এলো না ! কেমন উৎকণ্ঠা হতে লাগলো মিরার , ব্যাগের ভেতর থেকে ঠিকানা বা ফোন নাম্বার বের করবে নাকি ভাবতে লাগলো। লিয়ামকে বলার উপায় নেই, লিয়াম গেছে ছুটিতে ওর ছেলের কাছে। ম্যানেজার অলিভিয়া কেমন একটু পাজি ধরনের, মিরাকে পছন্দ করে না মোটেই। ক্রেতার ফেলে যাওয়া ব্যাগ নিয়ে তিনদিন ধরে বসে আছে শুনলে উল্টো খিটখিট করতে পারে।
চতুর্থ দিন সকালে লোকটা এলো। মিরা প্রায় ছুটে গেলো ব্যাগটা ফেরত দিতে। ব্যাগটা ফেরত পেয়ে লোকটার তেমন কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। একটা ধন্যবাদ আশা করেছিল মিরা। লোকটা মৃদু হেসে ছোট্ট করে মাথা দোলালো। এ কদিন মাথায় ওপর একটা বোঝা মনে হচ্ছিলো, আজ ব্যাগ ফেরত দিয়ে একটু ভারমুক্ত লাগছিলো মিরার।
লোকটা দূর থেকে মিরাকে লক্ষ্য করছে , অস্বস্তি নিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পারে মিরা। একটু পরে কফি নিয়ে লোকটার টেবিলে যেতেই লোকটা ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললো, “ব্যাগটা ফেরত পেয়ে এতই অভিভূত হয়েছি যে তোমাকে ধন্যবাদ পর্যন্ত দিতে ভুলে গেছি। তোমাকে ধন্যবাদ। আমি ভাবিনি ব্যাগটা ফেরত পাবো, ভেতরে পাঁচ হাজার ইউরো ছিলো।”
মিরা হেসে বললো, “ব্যাগ খুলেও দেখিনি, দেখলে কী হতো, জানি না। তবে আমি জীবনে কখনও চুরি করিনি। আচ্ছা, এত টাকা সহ ব্যাগ ফেলে গেলেন, অথচ তিন দিন কোনো খবরই নিলেন না কেন? “
লোকটা হাত বাড়িয়ে বললো, “আমি রডরিগো কস্তা, আসলে গত তিনদিন মনখারাপ ছিলো , হোটেল থেকে বের হতেই ইচ্ছে করেনি। তোমার পরিচয় ?”
মিরা হাত বাড়িয়ে করমর্দন করে বললো, “আমি মিরা, ছাত্রী এবং এখানকার পার্ট টাইম ওয়েটার। আচ্ছা, আপনি কি লেখক?”
রডরিগোর চোখ কেমন জ্বলে উঠলো। “তুমি কী করে বুঝলে?”
মিরা হেসে ফেললো, “আপনার ভাবভঙ্গি দেখেই বুঝেছি আপনি রাইটার, রাইটার্স ব্লকে ভুগছেন। এখানে বসে বসে লেখার চেষ্টা করছেন কিন্তু পারছেন না। সেজন্যই কি আপনার মন খারাপ? “
“আসলেই তাই। আমি লেখক। পর্তুগালের লিসবন থেকে এসেছি। ক্রিস্টমাসের আগেই একটা জমাটি প্রেমের গল্প লিখতে হবে, পাবলিশারদের চাপ আছে। তাই এখানে চলে এসেছি নিরিবিলিতে লিখবো বলে। অথচ দেখো, যে হোটেলে উঠেছি সেখানে রুমে ওয়াইফাই কাজ করে না। তাই এই ক্যাফেতে চলে আসি সকালেই, ফ্রি ওয়াইফাইয়ের জন্য কফি খেতে থাকি। ইন্টারনেট তো লাগেই লেখার সময় , কখন কী কারণে গুগলের দারস্ত হতে হয়, কে জানে? “
মিরা রডরিগোর সামনে চেয়ারে বসে। অলিভিয়া আশেপাশে নেই, এই সুযোগে লেখকের সাথে একটু আড্ডা দেয়াই যায়।
“তো, কী লিখেছো এ পর্যন্ত?”
রডরিগো হতাশ ভঙ্গিতে কাঁধ উঁচিয়ে বললো, “কিছুই না, কিচ্ছু মাথায় আসছে না। সব ভালোবাসার গল্প বলা হয়ে গেছে। নতুন কিছু পাচ্ছি না। এখানে আসাই বৃথা হলো বুঝি।”
মিরা একটু উত্তেজিত হয়ে বললো, “আমি ঠিক বুঝেছিলাম, তুমি রাইটার্স ব্লক এ ভুগছো।”
রডরিগো এবার একটু যেন সহজ হলো। হাসি মুখে বললো, “তোমার তো মানুষকে পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা ভালো। এইযে এতদিন ধরে এই ক্যাফেতে আসছি, আর কেউ এতকিছু জিজ্ঞেস করেনি।”
“আমার মানুষকে দেখতে ভালো লাগে। এই ক্যাফের মালিক লিয়ামকে কি করে চিনেছি জানেন? আগে আমি একটা বুকশপে কাজ করতাম। লিয়াম যেখানে প্রতিদিন আসতো পত্রিকা কিনতে। পত্রিকা হাতে নিয়েই ও খেলাধুলার খবর দেখতো। আমি ব্যাপারটা খেয়াল করি। এত খুঁটিয়ে কেন খেলার খবর দেখে ভাবতে ভাবতে একদিন জিজ্ঞেস করে ফেললাম ও খেলা নিয়ে বেটিং করে কিনা। লিয়াম তো অবাক! ভাবছিলো,আমি কী করে বুঝলাম? পরে স্বীকার করেছে, অনলাইনে স্পোর্টস বেটিং করে ও। তারপর প্রায় প্রতিদিন কথা হতো আমাদের। সেই পরিচয়ের সূত্রে এ বছর ওর এই ক্যাফেতেই চাকরি নিলাম।
মীরার কথা বলার ভঙ্গিতে একটা অনিবার্য আন্তরিকতার উষ্ণতা আছে, রডরিগো মুগ্ধ হয়ে মিরার গল্প শুনছিলো। এই বরফ ঢাকা ছোট্ট নির্জন শহরে গল্প লিখতে এসে ভয়াবহ একাকিত্ব তাকে গ্রাস করবে, সে বোঝেনি। প্রায় পনেরদিন হলো এখানে এসেছে, কেউ তার সাথে এভাবে গল্প করেনি। যেন কত জন্ম পরে কাছের আজ কেউ গল্প করছে।
মিরা ওর গল্প বলছে, ওর দেশের গল্প, এই দেশে পড়তে আসার গল্প। হঠাৎ অলিভিয়াকে দেখে উঠে যায় মিরা। রডরিগো যেন সম্বিৎ ফিরে পায়।
জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ। এই মাসের শেষেই বন্ধ হয়ে যাবে স্কি রিজোর্ট। ধীরে ধীরে এডভেঞ্চারকামী মানুষদের ভিড় কমে আসবে। রডরিগো প্রতিদিন আসে ক্যাফেতে, মিরার সাথে একটু গল্প করার জন্য। মিরা কাজের ফাঁকে রডরিগোর সামনে বসে, গল্প লেখা কতদূর জানতে চায়। সাথে এটা ওটা রাজ্যের গল্প করে। রডরিগো শুনতে থাকে। মেয়েটা যেন একটা উষ্ণ ঝর্ণা, বরফের পাহাড় গলে উচ্ছল ভঙ্গিতে নেমে আসে উদ্বেগহীন। রডরিগোর মুগ্ধতা বাড়তে থাকে আর কমতে থাকে ওর ভেতরে পাথরের মতো নিকষ কালো একাকিত্ব।
একদিন লাঞ্চ শেষে ক্যাফে থেকে বের হতেই রডরিগোর দেখে মিরা একটা লম্বা ছেলের হাত ধরে হেটে যাচ্ছে। ছেলেটা মাঝারি গড়নের, একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছে। মিরা বাচ্চাদের মতো ছেলেটার হাত ধরে দোলাচ্ছে আর অন্য হাত নাড়িয়ে কী যেন বকবক করছে। ছেলেটার মাথায় ভারী উলের টুপি। মাথা নিচু করে হাসি মুখে মীরার গল্প শুনছে আর মাঝে মাঝে মাথা নাড়ছে। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে ছেলেটা সাদা, মিরার মতো বাদামি নয়।
বুকে ভেতরে একটা ধাক্কা টের পায় রডরিগো। চোয়াল শক্ত করে দীর্ঘক্ষণ ক্যাফের ভেতর থেকে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটু দূরে গিয়ে ছেলেটা মাথা নিচু করে মীরার ঠোঁটে চুমু দেয়। মিরা একটু লজ্জা পায়। প্রেমিক যুগলদের মাঝে খুব স্বাভাবিক দৃশ্য অথচ হিংসার জ্বলুনি টের পায় রডরিগো।
পরদিন সকালে সুযোগ বুঝে মিরাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললো গতকাল ওর সাথে থাকা ছেলেটার কথা। “তোমাদের দুজনকে যে কী মানিয়েছে, আমি দূর থেকে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম তোমাদের ভালোবাসার গল্পটা কেমন হতে পারে।”
মিরা লাজুক ভঙ্গিতে হেসে বললো, “আমাদের গল্পটা খুবই সাধারণ। তবে তুমি শুনতে চাইলে বলবো। শুনতে চাও?”
“অবশ্যই।” রডরিগোর মুখে মিথ্যা হাসি।
“আমি যখন এই ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এলাম, আমার প্রচন্ড মন খারাপ লাগছিলো। দেশে কতশত মানুষের মাঝে ছিলাম। এমন জনশূন্য ঠান্ডা জায়গায় কেমন করে বেঁচে থাকবো বুঝতে পারছিলাম না। এখানে সবাই ভালো ইংলিশ বলতে পারে না, আমিও ইংলিশ অত ভালো পারতাম না। কারো সাথে কথাও বলতে পারি না। মা বাবা ফোন করলে অভিনয় করে বলি খুব ভালো আছি, আসলে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করতো আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও।
যা হোক, ক্লাস শুরু হলো। আস্তে আস্তে পড়ালেখায় ব্যস্ত হয়ে গেলাম। ইউনিভার্সিটি থেকে ডর্ম- এই ছিল আমার গন্ডি। ডর্মে ফিরে মন খারাপ করে বসে থাকতাম। আমার রুমমেট নরওয়ের অনিতা প্রায়ই বিভিন্ন পার্টি করতে যেতো, আমাকেও যেতে বলতো কিন্তু আমি যেতাম না। আমার আসলে এগুলো ভালো লাগতো না। আনিতা বুঝতে পারছিলো আমি ওদের মতো না, তাই আমাদের মাঝে তেমন সখ্যতা হয়ে ওঠেনি। আমি ভীষণ একা বোধ করতাম। অন্য কারো সাথেও খুব ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি। আমার মতো বাদামি রঙের কেউ ছিল না ক্লাসে। একদিন অনিতা বললো গোটেবার্গে মিউজিক ফেস্টিভ্যালে যেতে চাই কিনা, ও যাবে, একজন পার্টনার হলে ওর খরচ কমে। তখন ছিলো ইস্টারের ছুটি। সবাই বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাচ্ছে, আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। তাই অনিতার সাথে যেতে রাজি হয়ে গেলাম। “
অলিভিয়া মিরাকে ডাকতেই গল্পের গতি রোধ করতে হলো। রডরিগো এতটাই ডুবে ছিল মিরার গল্পে যে বাধা পেয়ে ভীষণ বিরক্ত হলো। তীব্র আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলো পরের দিনের জন্য, যখন মিরা আবার সুযোগ বুঝে রডরিগোকে গল্প শোনাবে।
পরদিন মিরা অবাক হয়ে দেখলো রডরিগো আগ্রহ নিয়ে মিরার গল্প শোনার অপেক্ষা করছে। মিরা কাজ শেষে রডরিগোকে বলতে শুরু করলো ,”বাসে করে গোটেবার্গে গিয়ে দেখি হাজার হাজার মানুষ এসেছে। একটা মাঠের মধ্যে শত শত তাঁবু টানানো হয়েছে। আনিতা খুঁজে খুঁজে আমাদের তাঁবুতে হাজির হলো। ভেতরে চারজন ঘুমানোর ব্যবস্থা। আমি আর আনিতা , আর একটা ছেলে আর তার গার্লফ্রেন্ড। ওই ছেলেটা হচ্ছে লুকাস, আমার বয়ফ্রেন্ড। “
“ওমা ! ওর গার্লফ্রেন্ডের কী হলো? ” কৌতূহলে রডরিগোর চোখ চকমক করছে, হাতের তালু কেমন ঘেমে উঠছে।
মিরা দুষ্টুমি করে বললো, “বলছি বলছি। ওই তাঁবুতে ঢুকে আমার মনে হলো এখানে আমি কিছুতেই থাকতে পারবো না। প্রচন্ড ঠান্ডা, আমি তেমন ভারী কাপড় আনিনি। এমন ঠান্ডায় তাঁবুতে থাকলে কেমন কাপড় দরকার হতে পারে, আমার ধারণা ছিলো না। তাছাড়া এই মিউজিক ফেস্টিভ্যালে যে ধরণের গান হচ্ছিলো সেগুলো আমার ভালো লাগছিলো না।
সবার হাতে হাতে নানান রকম এলকোহল, বিয়ার। লুকিয়ে চলছে মারিজুয়ানার যথেচ্ছ প্রয়োগ। আধ মাতাল নেশাগ্রস্ত তরুণ তরুণীদের গায়ে যেন শীত লাগে না। গানের তালে অদ্ভুত উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়েছে সবার মাঝে। ভুতুড়ে ভঙ্গিতে নাচছে সবাই। আমার কেমন জানি দম বন্ধ লাগছিলো। ভিড় ঠেলে নিজের তাঁবুতে এসে বসে থাকলাম। কেমন অভিমান হচ্ছিলো নিজের বর্তমান পরিস্থিতির উপর। দেশের কথা খুব মনে পড়ছিলো। আমার ছোট্ট ঘর, ছোট্ট পড়ার টেবিল, রান্না ঘর থেকে আসা মায়ের রান্নার গন্ধ- এইসব অর্থহীন শব্দ-গন্ধ-দৃশ্যের স্মৃতিগুলো মনে করে কেঁদে ফেলেছিলাম। ঠিক তখন তাঁবুতে ঢুকলো লুকাস।”
থামলো মিরা। লুকাসের কথা মনে করে চোখদুটো মায়াবী হয়ে এলো, লক্ষ্য করলো রডরিগো।
“তারপর?” জানতে চাইলো সে। মিরা বললো আজ আর না, বিকেলে তার ক্লাস আছে। পরদিন আবার শুরু হলো গল্পের ধারাবাহিকতা।
পরের পর্বে সমাপ্তি..
-সালমা সিদ্দিকা