রাহেলা বেগম খুব দুশ্চিন্তায় আছেন। আজ তার মেয়ে নাসরীনের শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে তিনি ইফতারের দাওয়াত করেছেন। আয়োজন ঠিকঠাক মতই চলছে। তবু দুশ্চিন্তা থেকেই যায়। ওনারা যা খুঁতখুঁতে স্বভাবের! আপ্যায়নে ত্রুটি পেলে তো মেয়েটাকেই কথা শোনাবে। এই চিন্তায় অস্থির রাহেলা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন। জেসমিন কতদূর কী করলো দেখে আসা দরকার। জেসমিন এই শরীর নিয়ে খাটছে, রাহেলার দুশ্চিন্তা হয়। তার ভবিষ্যৎ বংশধর এই মেয়েটার শরীরে। মেয়েটা ভালো, লক্ষ্মীমন্ত। কিন্তু রাহেলা কী করবে! সে নিজেও অসুস্থ। গায়ের শক্তি পড়ে গেছে। নিজে তো এখন খাটতে পারে না।
জেসমিন রাহেলা বেগমের পুত্রবধূ। জেসমিন এখন পাঁচমাসের অন্তঃসত্ত্বা। তার প্রথম সন্তানের আগমনের অপেক্ষায়। এই অবস্থায় তার শ্বাশুড়ি একটার পর একটা আয়োজন নামাচ্ছে। বিশ্রামের কোনো ফুসরত নেই। জেসমিন যারপরনাই বিরক্ত। এই বিরক্তি নিয়েই সে সকাল থেকে খাটছে। না খেটে উপায় নেই। মামার বাড়িতে বড় হওয়া পিতৃমাতৃহীন জেসমিনের গিয়ে থাকবার মত কোনো জায়গা নেই। শ্বশুর শ্বাশুড়ি একটা অনাথ মেয়েকে বউ করে এনেছিলো এটা তার ভাগ্য সে জানে। কৃতজ্ঞতা থেকেই সে এতকিছু মুখ বুজে সয়। নাসরীনের জন্য রাহেলার দুশ্চিন্তা দেখে মাঝেমাঝে তার মনে হয় তার মা বাবা মরে গিয়েই বেঁচে গেছেন! জেসমিন জানে তার স্বামী রাসেলকে বললেও আলাদা থাকবে না এখন তাকে নিয়ে। দিনরাত বউকে খাটিয়ে মারছে দেখেও তার স্বামীর নীরবতায় খুব অভিমান হয় জেসমিনের। সে শুধু অপেক্ষা করছে তার অনাগত সন্তানের আগমনের। সেই সন্তান তার খুঁটি হবে সংসারে। তখন রাসেল চাইলেই তাকে চলে যেতে বলতে পারবে না। তারপর সে আলাদা হবেই। শ্বশুর আব্বার জন্য তার কষ্ট হবে। হয়তো কষ্ট হবে শ্বাশুড়ি আম্মার জন্যও। কিন্তু এত খাটখাটুনী আর কত! তারও তো একটা জীবন আছে!
রাহেলা বেগম রান্নাঘরে তদারক করছেন কাজকর্ম। জেসমিন আর কাজের মেয়ে কণা সকাল থেকে খাটছে। রাহেলা বাতের ব্যথায় দাঁড়াতে পারছেন না। তবু খাটে শুয়ে থাকলে তো চলবে না। মেয়েটা তো তার, মেয়ের সুখের কথা তো ভাবতে হবে তাকেই। জেসমিন কি আর অত গা করবে! কোনোমতে ফাঁকি দিয়ে রান্না কিছু করে রাখবে নাহলে।
হুলুস্থল রান্নাবাড়া চলছে। হালিম সবে চুলো থেকে নামলো, ফিরনি উঠেছে চুলোয়, আরেক চুলোয় চিকেন স্টেক ভাজছে জেসমিন, পেঁয়াজু, বেগুনী সেসব ভাজা শেষ। এনাম সাহেব বাজারে ছুটেছেন জিলাপি, দই আর ফল আনতে। এনাম রাহেলার স্বামী। তিনি রিটায়ার্ড পার্সন। সারাজীবন সরকারি চাকরী করেছেন রেলওয়েতে। সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে ছেলেমেয়ে দুটোকে মানুষ করেছেন। চাকরীর শেষ সঞ্চয় দিয়ে মেয়ে নাসরীনের বিয়ে দিয়েছেন আর ছেলে রাসেলের জন্য ব্যবস্থা করেছেন সরকারি চাকরীর। রাসেলের জন্য শিক্ষিত চাকরিজীবি মেয়ে জেসমিনকে বউ করে এনেছেন। রাহেলা চাকরীটা করতে দিলো না মেয়েটাকে। রাহেলাকেও দোষ দেয়া যায় না। অসুস্থ রাহেলা কী করে সংসার সামলাবে! সংসারের দায়িত্বটাও তো কাউকে নিতে হবে। কিন্তু রাহেলা যেভাবে কাজ চাপাচ্ছে জেসমিনের উপর, এই শিক্ষিত বউ বেশিদিন একসাথে থাকবে না। রাহেলাকে তিনি তা বোঝাতে চেয়েছিলেন বেশ ক’বার। কিন্তু পুরুষ মানুষ রিটায়ার্ড হয়ে গেলে সংসারে তাদের কথার আর দাম থাকে না!
বাজারের চটের থলে নিয়ে হেঁটেই ফিরছিলেন এনাম। পথে রাসেল তাকে দেখে রিকশায় তুলে নিলো। বাবাকে ঘামে ভিজতে দেখে রাসেল অভিমান করে জানতে চেয়েছে কেন রিকশা নেয় নি। এনাম ছেলেকে বললেন, তোমার বউ জেসমিনও কিন্তু ঘামে ভিজেই রাঁধছে সকাল থেকে। তুমি তার একটু যত্ন নিও বাবা। মেয়েটা অন্তঃসত্ত্বা।
রাসেল চুপ করে রইলো। জেসমিনের খুব কষ্ট হয় সে বোঝে। স্ত্রীর চাপা অভিমানগুলো অনুভব করে। কিন্তু তার একার আয়ে সে তো একজনের বেশি দুজন কাজের লোক রাখতে পারে না। এর মধ্যে বোনটার বিয়ে দিয়েছে মাত্র আটমাস আগে। বিয়ের পর এটা প্রথম রমজান। বোনের শ্বশুরবাড়ির লোকজন ভীষণ খুঁতখুঁতে, বিয়ের দিন থেকে সব আয়োজনেই তারা ভুল ধরছে। আর তারা ভুল ধরলেই নাসরীনকে কথা শোনায়, নাসরীন কাঁদে। মায়ের কষ্ট হয় মেয়ের জন্য, মা তখন জেসমিনকে বকে। জেসমিন এখন কিছুই বলছে না। চাপা রাগ নিয়ে রাসেলের দিকে তাকায়। রাসেল জানে জেসমিন আলাদা হতে চায় বাবা মায়ের সংসার থেকে, কিন্তু অসহায় বাবা মাকে ছেড়ে রাসেল কিভাবে যাবে! বাবা তার শেষ সম্বল দিয়ে তার চাকরীর ব্যবস্থা করেছে। জেসমিনের দোষ নেই, দোষ নেই মায়েরও। দুটো মানুষই যদি একে অপরকে একটু বুঝতো!
রিকশা চলছে। এনাম তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে। ছেলের কপালে চিন্তার ভাঁজ। এই অল্প বয়সেই ছেলেটা সংসারের মস্তচাপ মাথায় নিয়ে ঘুরছে। খুব মায়া লাগে এনামের নিজ পুত্রের জন্য। চাকরীর টাকা দিয়ে সংসারের খরচ, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর সুচিকিৎসার খরচ, মায়ের চিকিৎসার খরচ, বোনের শ্বশুর বাড়ীর খুশীর জন্য খরচ এসব সামলাতে সে হিমশিম খাচ্ছে। তার উপর সংসারে এত জটিলতা। এনামের কিছুই করার নেই। তিনি জানেন তিনি এখন কর্মক্ষমতাহীন। ইচ্ছে হয় ছেলেটাকে যদি একটু সাহায্য করতে পারতেন!
এ পরিবারের প্রত্যেকেই প্রত্যেককে ভালোবাসে। আবার কেউই যেন কাউকে বুঝতে চান না! ভীষণ এক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে নড়বড়ে খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে আছে এই সংসার। কোনো বড় ঝড় এলেই যেন ভেঙে যাবে! অথচ একে অপরের জন্য অনুভূতিটুকু যদি এরা মুখ ফুটে প্রকাশ করতো।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আফজাল সাহেব তার স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ নাসরীন ও ছোট কন্যাকে নিয়ে পুত্রের শ্বশুরবাড়ী দাওয়াত খেতে এসেছেন। তিনি ও তার পরিবার বেশ আয়েশি মুডে আছেন। কেবল নাসরীন ছাড়া। নাসরীনের বুকটা প্রতি মুহূর্তে শুকিয়ে যাচ্ছে। সে জানে তার পরিবার অনেক কষ্ট করে এসব আয়োজন করেছে তার সুখের জন্য। সে এটাও জানে তার শ্বশুরকুল কখনোই কোনো আয়োজনে ভুল না ধরে যায় নি। এই ভুল ধরার রেশ গিয়ে পড়ে তার মা আর ভাবীর সম্পর্কে। সে সম্পর্ক দিনদিন শীতল হচ্ছে।
ইফতার টেবিলে সকলে। আফজাল সাহেব যারপরনাই বিরক্ত। মাত্র বারোটা আইটেম করেছে এরা। মুখ ফুটে তিনি কিছু বলছেন না। তিনি কী আর তত অভদ্র! বিরস মুখে তিনি পিঁয়াজু চিবুচ্ছেন। পেঁয়াজুর ডালগুলোও বাসার মত মসৃণ হয় নি। এবার এটা অন্তত বলা দরকার। রসিক আফজাল সাহেব রস করেই বললেন, কী গো বেয়াইন সাহেবা, আপনাদের পাটায় কি ডাল তেমন মিহিগুড়ো হয় না? রাহেলা লজ্জিত মুখে তাকিয়ে আছেন। নাসরীনের শ্বাশুড়ির খাসীর মাংস পছন্দ নয়, হালিম মুরগী দিয়ে করলে খেতে পারতেন বলে তিনি আক্ষেপ করছেন অনেকক্ষণ ধরে। নাসরীনের ছোট ননদ মৌটুসি এতসব ফ্যাটি খাবার দেখে বিরক্ত। ফ্রুট সালাদ কেন করতে বলে নি ভাবী ওনার বাসায় তা নিয়ে ক্ষোভ দেখালো। নাসরীনের বরের অবশ্য প্রথমদিকে আয়োজন পছন্দই হয়েছিলো। এখন ফ্যামিলির সবার আক্ষেপ দেখে তারও আর আয়োজন ঠিক পছন্দ হচ্ছে না।
অতিথি চলে গেছেন। থমথমে মুখে রাহেলা বসে আছে। জেসমিন রাহেলার ঔষধ নিয়ে এসেছে। রাহেলা খেদ করে উঠলো, “আর ক’টা আইটেম বেশি করলে কি তোমার সংসার উজাড় হয়ে যেতো জেসমিন?”
সারাদিনের পরিশ্রমে পরিশ্রান্ত জেসমিন প্রথমবারের মত ধৈর্য্য হারিয়ে বলে উঠলো, “আমার উচিত ছিলো কিছুই না করা এই অসুস্থ শরীরে। এটা আমার সংসার। অথচ আপনার মেয়ের জন্য খেটে মরছি।” হতবিহ্বল রাহেলা এক মুহূর্ত চুপ থেকে এরপর বললো, “সংসার কেবল তোমার, জেসমিন? ছেলেটা কি আমার নয়? এইজন্য লোকে বলে মা মরা মেয়ে ঘরে আনতে নেই।”
জেসমিনের চোখে জল। কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো, “মা মরা মেয়েটা ভালোই ছিলো, আপনি তার মা হতে পারেন নি বলেই মেয়েটা মুখরা হয়ে গেছে।”
বলেই সে ঘর থেকে ছুটে নিজের ঘরে চলে গেলো জেসমিন। রাসেল বিছানায় বসে আছে নির্বাক।
জেসমিন দরজায় হেলান দিয়ে চুপ করে কাঁদছে। সে কান্না কি রাসেল শুনতে পাচ্ছে? সে কান্না কি শুনতে পাচ্ছে তার অনাগত সন্তান? জেসমিন খুব করে চায় তার পুত্রসন্তান হোক। সে কন্যাসন্তানের মা হতে চায় না। রাসেল জেসমিনের কান্না দেখছে, পাশের রুম থেকে মায়ের ফুঁপিয়ে কাঁদবার শব্দ শুনছে রাসেল, হয়তো তার বোন নাসরীনটাও কাঁদছে অপমানে। এসব কান্না বন্ধ করতে না পারার তীব্র হাহাকার তার বুককে জর্জরিত করছে। কেউ কি দেখছে? অন্তর্যামী দেখছেন। সে পুরুষ মানুষ, সে কাঁদতে পারে না!
এনাম সাহেব রাহেলাকে নীচু গলায় বললেন, “রাহেলা! এই শহর বড্ড অসহ্য লাগছে! কতদিন গ্রামে যাই না! মনটা বড্ড পুড়ছে গো গ্রামের জন্য। জিনিসপত্তর গুছিয়ে নাও, গ্রামে গিয়ে থাকবো চল আমরা দুজন।”
রাহেলা অসহায় চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে।
আফজাল সাহেবের পরিবার পুরো রাস্তায় নাসরীনকে নানা কথার বাণে জর্জরিত করেছে। এনারা শিক্ষিত লোক। বাড়ির বউকে গালমন্দ করেন না, কথা শোনান খুব কায়দাকানুন করে। নাসরীন এসব কথায় অভ্যস্ত। অজান্তেই তার চোখে জল এসেছে দু’ফোটা। এটুকু জল সে মুছে নেবে। কিন্তু এ চোখের জলের দাম তার পরিবারকে চুকাতে হচ্ছে কিনা সে ভয় নাসরীনের। গাড়ি থেকে নেমে আপ্যায়নের ত্রুটি নিয়ে আলাপ করতে করতে আফজাল সাহেবের পুরো পরিবার সিঁড়ি বেয়ে দুতলায় উঠেছেন সবে। সিঁড়িতে বসে আছে তাদের বড় মেয়ে শাম্মি। শাম্মির পাশে তার বিয়ের সাজকাপড়ের বিশাল ব্যাগটা। ওর বাঁ গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে আছে! মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছে গতমাসে। আফজাল সাহেব মাত্র পনেরো দিন আগে নিজ খরচায় মেয়ে-মেয়েজামাইকে মধুচন্দ্রিমায় পাঠিয়েছিলেন। আফজাল বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে অশ্রুর বন্যায় ভেসে যাওয়া মেয়ের বাঁ গালের দিকে। তার স্ত্রী মেয়েকে জড়িয়ে ধরে জানতে চাইলেন কী হল। শাম্মি কান্না আর ভয়জড়িত কন্ঠে জানালো, তার স্বামী যৌতুকের জন্য তাকে মেরে পাঠিয়ে দিয়েছে!
-জান্নাতুন নুর দিশা