রোজকার মতো আজও রশীদ সাহেব অফিসের হিসাব পত্র মিলিয়ে চেয়ার টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। রাজশাহী শহরের সাহেব বাজারে অবস্থিত সমবায় সমিতির একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তিনি হিসাব রক্ষক পদে দীর্ঘ পঁচিশ বৎসর ধরে একই পদে চাকরি করে আসছেন। প্রথম জীবনে বাজারের এক বড় ব্যবসায়ীর চেম্বারে তাঁর কর্মময় জীবন শুরু হয়। সেখানে কাজ করতে গিয়ে বর্তমান প্রতিষ্ঠানের পূর্ববর্তী ম্যানেজারের সুনজরে পড়েন। পরবর্তীতে সেই ম্যানেজার তাকে এই প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসেন। পড়ালেখা বেশিদূর না করার কারনে তিনি একই পদে এতগুলো বছর নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন, এতে অবশ্য তার বিন্দুমাত্রও কোন ক্ষোভ নেই। চাকরি জীবনে তিনি অফিসের অনেক জনকেই হাতে কলমে কাজ শিখিয়েছেন। তাঁর কাছে কাজ শিখে অনেকেই বর্তমানে উচ্চ পদে চাকরি করছেন। বর্তমান ম্যানেজারকেও তিনি হাতেকলমে অনেক কিছুই শিখিয়েছেন। তাঁর কাজের প্রতি নিষ্ঠা, সততা ও একাগ্রতার বিষয়ে কারও কোন বিন্দুমাত্র দ্বিমত নেই। একারনে ম্যানেজার বাবুও তাঁর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা রেখে ভল্টের চাবি পর্যন্ত তাঁর হাতে ছেড়ে দিয়েছেন।
রশীদ সাহেব প্রতিদিন অফিস শুরু হওয়ার আধা ঘন্টা আগে অফিসে আসেন। প্রথমেই অফিসে প্রবেশ করে তিনি পূর্ববর্তী দিনের ভল্টে তুলে রাখা টাকার বান্ডিলগুলো গুনে নিশ্চিত হয়ে তবেই অন্যান্য কাজে হাত দেন। দিনশেষে আবারও অফিসের সব কাজ শেষ করে ক্যাশ মিলিয়ে ভল্টে টাকাগুলো তুলে রেখে তবেই তিনি অফিস ত্যাগ করেন। এর ব্যতয় কোনদিনও ঘটেনি।
আজও সন্ধ্যার পর ডিউটি শেষ করে রশীদ সাহেব অফিসের বাইরে বের হয়ে আসলেন। বাজার করতে হবে বিধায় সোজা বাসায় না গিয়ে কাঁচা বাজারে প্রবেশ করলেন। প্রথমে বাসার জন্য অল্প করে শাকসব্জি কিনে তবেই মাছের বাজারে প্রবেশ করলেন। কিন্তু মাছের আকাশচুম্বী দাম শুনে তিনি মনেমনে প্রমাদ গুনলেন। গত দুইদিন ধরে বাসার জন্য কোন আমিষ কেনা হয়নি। বাসায় ফ্রিজ না থাকার কারণে মাসের শুরুতেই বেতন পেয়েও বেশি করে মাছ মাংস কিনে রাখতে পারেন না। আজ বাসা থেকে বের হয়ে আসার সময় রশীদ সাহেবের ছোট মেয়ে রিমি মাছ খাওয়ার জন্য বায়না ধরেছিল। কিন্তু বড় বোন রেবেকা এক ধমক দিয়ে তাকে থামাতে গেলে রশীদ সাহেব তাকে হাত তুলে থামিয়ে রিমির মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিতে দিতে মাছ আনবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু মাছের বাজারের অবস্থা দেখে তিনি বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। শেষে উপায় না দেখে অসহায়ের মতো চারিদিকে তাকাতেই বাজারের শেষ মাথায় টাকি মাছ নিয়ে বসে থাকা এক লোক তাঁর নজরে পড়লো। মাছগুলো কিছুটা সস্তা পাওয়ায় তিনি তা কিনে বাজার থেকে বেরিয়ে সোজা বাসার উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে রওনা দিলেন।
বাসায় আসতেই রেবেকা দ্রুত হেঁটে রশীদ সাহেবের হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা হাতে নিতেই পিছন থেকে রিমি দৌঁড়ে এসে বাবাকে জিজ্ঞাসা করলো,
” বাবা তুমি আমার জন্য মাছ নিয়ে আসোনি ? ‘
মেয়ের প্রশ্ন শুনে রশীদ সাহেব কিছুটা থতমত খেয়ে আমতা আমতা করতেই রেবেকা ব্যাপারটা খেয়াল করলো। বাবার অসহায় অবস্থাটা বুঝতে পেরে সে রিমির দিকে চোখ পাকিয়ে বললো , ” যা জলদি করে পড়তে বস ! বাবাকে দেখেই পড়া ফেলে উঠে আসতে হবে না ! সারাদিন তো দেখি পড়ার নামে লবডংকা ! যা এখনই পড়তে বস গে যা ! ”
বড় বোনের বকা শুনে রিমি আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ঘরে গিয়ে পড়তে বসলো। রিমি চলে যেতেই রশীদ সাহেব যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। এতটুকু মেয়েকে তিনি কি বলবেন বুঝতে পারছিলেন না। বাবাকে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রেবেকা বললো, ” যাও বাবা হাতমুখ ধুয়ে ঘরে গিয়ে বসো। আমি তোমার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসছি। চা খেতে খেতে টিভি দেখো গে যাও। আমি আর মা দুইজনে মিলে রান্নাটা শেষ করে ফেলে সবাইকে ভাত দিচ্ছি। ”
”একটু মুড়ি তেল পিঁয়াজ দিয়ে মাখিয়ে দিস তো মা , খুব ক্ষুধা লেগেছে ! ”
রশীদ সাহেবের কথা শুনে রেবেকার কালো মুখটা আরও কালো হয়ে উঠলো ! বেশ অসহায় ভাবে সে বললো, ” মুড়ি তো শেষ হয়ে গেছে বাবা। গতকাল তোমাকে আনতে বলেছিলাম। তুমি মনেহয় ভুলে গেছিলে। দাঁড়াও বাবা, বয়ামে টোস্ট বিস্কুট আছে, তাই দিয়ে চা দিচ্ছি। এরমধ্যে আমি তাড়াতাড়ি করে রান্নাটা করে ফেলছি। ” কথাটা বলেই রেবেকা ব্যাগটা নিয়ে দ্রুতবেগে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল।
রাতে সবাই মিলে ভাত খাওয়ার পর বিছানায় শুতে গিয়ে রশীদ সাহেবের স্ত্রী আয়েশা বেগম পান বানিয়ে স্বামীর হাতে দেয়ার পর নিজেও একখিলি পান মুখে পুরে কিছুটা চিবিয়ে বললেন, ” আজ ওই পাড়ার রমজানের বৌ রেবেকার জন্য একটা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। ছেলে নাকি রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে চাকরি করে। বেতন মোটামুটি। বাড়িতে বাপ মা, ছোট ভাইবোন আছে। ছেলের বাবার বাজারে একটা মুদির দোকান আছে। এখন কি করা যায় বলোতো ? ”
বৌয়ের কথা শুনে রশীদ সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন ,
” রমজানের বৌ আর কি বললো ? ”
আয়েশা বেগম একটা ঢোক গিলে আস্তে করে উত্তর দিলো, ” বলবে আর কি, সবাই যা বলে, ওই একই কথা ! মেয়ে আমার কালো। তাই জামাইকে সংসারের সবকিছু নাকি গুছিয়ে দিতে হবে ! পোড়াকপালী মেয়ে আমার ! আল্লাহ তারে সব গুন দিয়া পাঠাইলেও গায়ের রং টা দিয়া দুনিয়াতে পাঠায় নাই। কতজন যে আসলো আর গেল ! আমার মাইয়ার গায়ের রঙ টাই শুধু তাদের চোখে পড়লো। মাইয়ার গুনটা কেউ চাইয়াও দেখলো না ! ” কথাটা বলেই আয়েশা বেগম একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন।
রশীদ সাহেব সব কথা শুনে ছোট্ট করে একবার মাথাটা ঝাঁকিয়ে বললেন, ” তুমি বরং ছেলের বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে দাও। খোঁজখবর নিয়ে দেখি বাড়ি ঘরের কি অবস্থা! ”
আয়েশা বেগম বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, ” এত টাকা তুমি কোথায় থেকে জোগাড় করবে শুনি ? ”
স্ত্রীর কথাগুলো শুনে রশীদ সাহেব একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, ” আগে তো তাদের খোঁজখবর নিই। এরপর মেয়েকে যদি তারা পছন্দ করেন তখন নাহয় ভাবা যাবে। ”
কথাটা বলেই রশীদ সাহেব বিছানায় শুয়ে পড়লেন।
ভোরের আজানের আওয়াজে যথারীতি ঘুম ভেঙ্গে যায় রশীদ সাহেব। ঘুম ভাঙ্গার পরও কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বাথরুমে গেলেন। একটু হাতমুখ ধুয়ে এসে পাঞ্জাবীটা পড়ে গেট খুলে মসজিদে গিয়ে ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে আসতেই পাড়ার রসুল আলী তাকে দেখে সালাম দিয়ে উঠে রশীদ সাহেবের সাথে হেঁটে আসতে লাগলো। রাস্তায় কিছুদূর আসতেই রসুল আলী প্রথম নীরবতা ভেঙ্গে বলে উঠলো,
” বড় মাইয়াডার বিয়ের কোন ব্যবস্থা হইলো মিয়া ভাই? “
রশীদ সাহেব একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” নাহ ! কই আর হলো ! সবাই এসে শুধু মেয়েটাকে একনজর দেখে চলে যায়। তারপর আর কোন খবর থাকে না। জানি না পোড়া কপালীটার ভাগ্যে কি লেখা আছে? এমন যদি একটা ছেলে পাওয়া যেতো যে তার গায়ের রঙ না দেখে তার গুণ গুলো দেখতো! কিন্তু কোথায় পাবো সেই রকম ছেলে? আছে কি এই যুগে এইরকম ছেলে? “
” তাই বলে এইরকম হাত পা ছড়িয়ে বসে থাকলে হবে ভাইজান? ছেলের খোঁজ করতে হবে না? ”
” চেষ্টা তো কম করা হয় নি ! যাও বা কেউ একটু আগ্রহ দেখায় তা ওই যৌতুকের কারণেই দেখায়। আমি ছাপোষা মানুষ , যৌতুকের এতো টাকা কোথায় পাবো বলেন? ”
” আপনি যদি কিছু না মনে করেণ তাহলে আমি একটা কথা বলতাম। “
রসুল আলীর কথা শুনে তার দিকে রশীদ সাহেব প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চাইতেই রসুল আলী একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললো , ” আমার গ্রামের এক শ্যালক আছে , বয়স একটু হয়ছে এই যা। তয় পুরুষ মানুষের বয়সটাতো তেমন বড় কিছু না। যা বলছিলাম, মাস ছয়েক হতে চলছে আমার ওই শ্যালকের বৌটা ডেলিভারী হতে গিয়ে মারা গেছে। অতটুকু দুধের বাচ্চাটাকে নিয়ে লোকটা পড়েছে বিপদে। ভাগ্যিস বাচ্চাটার দাদি এখনও বেঁচে আছে। সেই বুড়িও আর কয়দিন বাঁচবে বলেন। এছাড়াও শ্যালকের আরও একটা ছেলে আছে , ক্লাস সেভেনে পড়ে। এক্কেবারে নির্ঝঞ্ঝাট সংসার। বাড়িতে ওই দুই বাচ্চা আর ওই বুড়ি মা ছাড়া আর কেউ নেই। বাড়ির অবস্থা বেশ ভালো। তাই গত দুইদিন আগে আপনার ভাবী বলছিলো কি .. রেবেকা ….. ”
রশীদ সাহেব এতক্ষণ ধরে অনেক বিরক্ত মনে রসুল আলীর কথাগুলো শুনছিলেন। তিনি রসুল আলীকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে উঠলেন,
” আজ আমার মেয়েটার গায়ের রঙ একটু চাপা বলে আপনি এই কথা বলতে পারলেন। একটা কথা শুনে রাখুন, আমার মেয়ের যদি সারাজীবন বিয়েও না হয় তবুও আমি কারও বাড়ির বাচ্চা মানুষ করার জন্য কোন বিপত্নীকের সাথে বিয়ে দিতে যাবো না। দরকার হলে মেয়েকে নিজ হাতে কেটে ওই পদ্মা নদীতে সোজা ভাসিয়ে দিবো বুঝলেন। নিজের মেয়ে বলে বলছি না, এই মেয়ের মতো লক্ষী একটা মেয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। এই মেয়ে যে ঘরে যাবে সেই ঘর আলো করে রাখবে , বুঝছেন। আর খবরদার এইরকম কথা আর দ্বিতীয়দিন বলবেন না! ”
কথাগুলো একনাগাড়ে বলেই রশীদ সাহেব রাগে হনহন করে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন।
(চলবে )
–ফিরোজ চৌধুরী