আহসান হাবীব
নাফিসা খানমের কাশি হয়েছে সাথে জ্বরও আছে। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন তার করোনা হয়েছে। হওয়ারই কথা। আশির উপর বয়স, শরীরের সব কলকব্জাই পুরোনো হয়ে গেছে, তাকে করোনা ধরবে না’তো, কাকে ধরবে? ধরার কারণও আছে বুয়াটা মাঝে মাঝে তার ঘরে আসে আঁচলে করে কাচা সুপারি আনে তার জন্য, না করতে পারেন না। মেয়েটা আগ্রহ করে আনে আর ফিস ফিস করে নানান অভিযোগ করে
– নানী একটা কতা কই, রাগ কইরেন না।
– কি?
– আপনের পুলা আর পুলার বউ দুইটাই খারাপ, আপনেরে এই ছোট ঘরটার মইদ্যে ফেলায়া রাখছে, আপনার খোঁজ খবরও নেয় না। ঐদিন তাগো একটা কথা কইতে শুনলাম… বলে গলা নামিয়ে আনে আরও এক ধাপ
– কি কথা? – আপনেরে বুলে বুড়াবুড়িগো বাড়িত পাঠায়া দিবো, এইখানে আর রাখবো না।
নাফিসা বেগমের দুর্বল বুকটা ধক করে উঠে, ওল্ডহোমে যাওয়াটা তার ভিতর থেকে একদমই আসে না। আর ক’টা দিনই’বা আছে ছেলেটার কাছে থাকতে পারলে আর কিছু চাইনা তার। নিজে নিজে ফিস ফিস করেন তিনি!
– নানী কি কন?
– কিছু না। আবার কাশি আসে। খুব সাবধানে কাশিটা চাপেন নাফিসা খানম।
ছেলে যদি টের পেয়ে যায় তার কাশি জ্বর হয়েছে, তাহলে নিশ্চয়ই তাকে এখানে আর এক মুহূর্ত রাখবে না। আরেকটা ব্যাপারে সাবধান হতে হবে, নাতিটা যেন এদিকে না আসে, ওকে যদি করোনায় ধরে। তিনি নিজেকে প্রস্তুত করেন। নাতিটা মাঝে মাঝে গল্প শুনতে আসে দাদীর কাছে । কিন্তু যেভাবেই হোক আসা বন্ধ করতে হবে। তখনই নাতিকে দরজায় দেখা গেল, দাদী নিজেকে প্রস্তুত করলেন। মুখে একটা হিংস্র ভাব করে পাখাটা উল্টো করে ধরে মারার ভঙ্গি করলেন। নাতিটা অবাক হয়ে এক পলক দেখল, তারপর ছুটে চলে গেল। আবার কাশি আসছে, অনেক কষ্টে কাশি চাপলেন নাফিসা বেগম।
রাতে মন্টিকে ঘুম পাড়িয়ে নীপা সজলের জন্য চা নিয়ে এলো। এই সময়টা তারা দুজনেই চা খেতে খেতে টুকটাক সাংসারিক কথা বার্তা বলে।
-শোন বুয়ার আসা বন্ধ করতে হবে। ওর হয়তো ক্যারিয়ার। ওদের ইমিউন সিস্টেম ভালো। ওর কিছু হবে না উল্টো আমাদের হয়ে যেতে পারে, মা’র হয়ে যেতে পারে…
– বেশ’তো, আমিও তাই ভাবছিলাম। ঢাকার অবস্থা এখন’তো বেশ খারাপ, আজ মারা গেছে ৩৮ জন!
– হু, তাহলে কাল থেকে ওর আসা বন্ধ। – আরেকটা ব্যাপার, তোমার মা না আজকাল অদ্ভুত ব্যবহার করছেন মন্টির সাথে… মন্টি এখন ওর দাদীকে ভয় পায়, দাদীর ঘরে যায় না আজকাল!
– তাই নাকি? আসলে মার মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে… আমার মনে হয় সময়টা একটু ভালো হলে মাকে একটা ভালো ওল্ডহোমে দিয়ে আসবো। ওরা ভালো দেখভাল করে। আমরা না হয় মাঝে মাঝে যাবো।
– সেই ভালো।
রাত আড়াইটার দিকে নাফিসা বেগমের শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন কি হতে যাচ্ছে। আমরাতো যাওয়ার জন্যই আসি, ছেলের বাপ এই কথাটা প্রায়ই বলতো। লোকটা অনেক কষ্ট করেছে জীবনে। ছেলেটাকে মানুষ করার জন্য একজোড়া ছেঁড়া জুতা পরে জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছে বেচারা। কি’বা করবে সামান্য স্কুল মাস্টার। নাফিসা প্রায়ই বলতেন এক জোড়া নতুন জুতা কিনো তো। কিনবো, কিনবো ছেলেটা আরেকটু বড় হোক। ছেলেটা বড় হয়েছে, অনেক বড় হয়েছে; লোকটা দেখে যেতে পারে নি। আহা সেই ছেলেটা আছে এই ছাদের নিচেই আছে নাফিসার কাছাকাছি… নাফিসা চোখ বন্ধ করেন, লোকটার সেই ছেঁড়া জুতা জোড়া যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন… এই ছেঁড়াখুড়ো জুতা জোড়া পরেই লোকটা কত দূর চলে গেছে… নাফিসা ধরতে পারবেন তো তাকে?