সহস্র মুহূর্ত হু হু করে গড়িয়ে যাচ্ছে দেয়ালের গায়ে। টেবিলের ওপাশের রিভলভিং চেয়ারটি ডিপ অলিভ ফোমে মোড়ানো। দারুণ অভিজাত! অথচ রাজার মতো একা। প্রিন্টারে ছেপে আসা কাগজের আধা খানা বেরিয়ে আছে। হয়ত প্রসব মুহূর্তে ভোক্তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিল। রিসেপশনের ছেলেটি বলেছিল,ডাক্তার সাহেব রাউন্ডে বেরিয়েছেন। আমাকে তাঁর চেম্বারে অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু আমি আমার পীড়িত মাথাটি কোথায় রাখব বুঝতে পারছিলাম না। সামনের টেবিলে পুরু কাঁচের আচ্ছাদনে বেআরাম। মাথাটি চেয়ারেই এলিয়ে দিলাম। দেয়ালে একটি কংকাল ঝুলছিল। মানুষের করোটি নিয়ে কিছুদিন পড়ালেখা করেছিলাম। তাতে বুঝলাম কঙ্কালটি কোন পুরুষের হবে। ডান হাতের দুটো আঙ্গুল নেই। বাম পায়ের গোঁড়ালি থেকে পায়ের পাতা অবধি গরহাজির। বুকের পাঁজরে কয়েকটি ছিদ্র।
ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। কিছু একটার শব্দ নিশ্চয় পেয়েছিলাম। চোখ খুলে দেখলাম ত্রিভঙ্গি মুদ্রায় কঙ্কালটি খটখটিয়ে শরীরে ঝড় তুলছে। রিভলভিং চেয়ারটি আর একা নয়। প্রফেসর ডক্টর আব্দুর রহমান- নেমপ্লেটে এই নামটিই দেখেছিলাম বোধ হয়। এমবিবিএস, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ। এফসিপিএস… এসব ও লেখা ছিল। কিন্তু এ তো…
সুজাতা, এতদিন পর এলে?
প্রতিটি শব্দ ইকো হচ্ছে, দেয়াল থেকে দেয়ালে। বিভাস! সেই চব্বিশেই আছে। দুর্দান্ত যুবক। মাঝে স্পেস প্রায় চৌদ্দটি বছর। মেরুদন্ড বেয়ে ঘাম পড়ছিল বা সেটা আমার মনের কল্পনা। তবুও ছুঁতে গেলাম ওকে। স্পর্শ করতে গেলাম প্রচন্ড আবেগ নিয়ে। ঠিক তখনই দরজা খুলে গেল।
সরি, দেরী হয়ে গেল। মিসেস সুজাতা নিশ্চয়? আমি ডক্টর আব্দুর রহমান। ডক্টর মুশফিক আপনার কথা বলেছিলেন। কেমন আছেন বলুন তো?
ডক্টর রহমানের কথাগুলো কানে আসছিল কিন্তু আমার চোখ কঙ্কাল থেকে সরছিল না। মুখমন্ডলীর চৌদ্দটি অস্থি খন্ডের সবকটি অটুট। যার ফলে ওর হাসি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। রহমান সাহেবের ঠোঁট এখনো নড়ছে, আমিও কিছু বলছি। কদিন যাবৎ অসহ্য মাথাব্যথার হিস্ট্রি বলছি হয়তো। বা স্পাইনাল কডের তীব্র যন্ত্রনার কথা। খলবলে হাসির দমকে সেসব কথা হারিয়ে যাচ্ছে। রহমান সাহেবের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে দিয়ে একসময় বেরিয়ে আসি।
লম্বা করিডোরে ভর দুপুরের নির্জনতা। করিডোর সংলগ্ন পুরুষ ওয়ার্ড গুলোর পাশ দিয়ে দ্রুত ফেরার সময় অন্যরকম কিছু উপলব্ধি করি। চারপাশ সুনসান। যাবার সময় এমনটি ছিল না। অসুস্থ পুরুষদের আর্ত চিৎকারে তখন জায়গাটুকু প্রায় দৌঁড়ে পার হয়েছিলাম। কিন্তু এত নির্জনতার কারন খুঁজতে সেদিকে খুব বেশি নজর দিতে পারলাম না। আমার পাশাপাশি কিছু একটা আমার মতই দ্রুত হাঁটছিল। ভয়ে কুঁকড়ে উঠছিলাম।
লিফটের সামনে মানুষের ভীড় নেই। আমি একা। পাশে সেই অশরীরি অনুভূতি। মুহূর্তকে বছর মনে হতে লাগলো। সরকারী অন্য হাসপাতালে যেমন ওষুধের গন্ধ, স্ট্রেচারের ঘড়ঘড়ানি, রোগী-নার্স-ডাক্তারের দৌঁড়াদৌঁড়ি, এখানে তার কিছুই নেই।
বেশ কিছুটা দূরে রিসিপশনে বেঁটে মত মেয়েটি পাশের সুদর্শন যুবকের সাথে গল্প করছে। মেয়েটির কপালের চুলগুলো এমন যে সেখানে একটি সেকেন্ড ব্র্যাকেট তৈরি হয়েছে। সরল অঙ্কে সেকেন্ড ব্র্যাকেটের কাজ আগে নাকি ভাগের কাজ আগে সেটা নিয়ে একদিন বিভাসের সাথে বেশ ঝগড়া হয়েছিল। ও অঙ্কে খুব ভাল ছিল। আমি তর্কের জন্যই শুধু তর্ক করেছিলাম। বিভাস কখনো হার মানতে চাইত না। সেদিনও জিতে গিয়েছিল। আমি মনে করার চেষ্টা করলাম আসলে সেকেন্ড ব্র্যাকেটের কাজ আগে নাকি ভাগের? অংকের প্রয়োজন ফুরিয়েছে বহুদিন হল।
লিফট চলে এসেছে। ঠাসাঠাসি লোক দেখে বেশ খুশি হলাম। কয়েকজন পুরুষ যেখানে জটলা করে দাঁড়িয়ে ছিল তার মাঝখানে নিজেকে সেঁধিয়ে দিলাম। সুন্দরী নারীকে শরীরের স্পর্শে পেয়ে কারো কারো মন মন্দিরে সুনিশ্চিত ঘণ্টী বাজছে বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু আদতে তাঁরা ছিলেন আমার ঢাল। যদিও সেই চলন্ত অনুভূতি আমি লিফটে অনুভব করলাম না। লিফট খুব দ্রুতগতিতে আমাদেরকে নীচে নামিয়ে নিয়ে এলো।
এই হাসপাতালে আজই প্রথম এসেছি। একবছর আগে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন। বিশাল শ্বেত পাথর সেটির সাক্ষ্য বহন করছে। মখমলের মলমলে কাপড়টি এখনো দুভাগ হয়ে লেখাটির দুপাশে ঝুলছে। বৃষ্টিতে ভিজে রোদে পুড়ে রঙটা পানসে লাল। আমি সামনের চত্বরে দাঁড়িয়ে চারপাশ খুব দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলাম। কোন অসঙ্গতি চোখে পড়ল না। তবুও মন সংকটে পরিপূর্ণ। রবিউলের নম্বর কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না। রবিউল আমার গাড়ীর ড্রাইভার। হাত কাঁপছে। মোবাইলের স্ক্রিনের উপর আঙুল অনির্দিষ্ট ভাবে নড়ছে। বেশ কিছুক্ষণ বাদে ওকে ফোনে ধরতে পারলাম। রবিউল গাড়ী নিয়ে পাঁচ মিনিটে হাজির হলো। কি ঘটেছিল বা কি ঘটতে পারে কোনকিছু ভাবার মত মন নেই। ক্লান্তি আর অবসাদে শরীর একটু বিশ্রাম চাইছিল। চোখ বন্ধ করে সীটে শরীর এলিয়ে দিলাম।
সুজাতা, টায়ার্ড লাগছে?
উহ্! আমি রবিউলের সাথে খুব জোরে জোরে গল্প শুরু করি। ওর সংসারের খোঁজ নেই। ওর ক্লাস সেভেনে পড়া ছেলেটা কবে যেন বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। কিছুদিন পর নিজেই ফিরে আসে। সে আবার পালাবে কিনা তার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করি। ওর বউকে একটা সূর্যমুখী রঙের শাড়ি কিনে দিয়েছিলাম, পছন্দ হয়েছিল কিনা জানতাম না। সে বিষয়েও প্রশ্ন করি। ও বোধ হয় একটু অবাকই হয়েছিল। কারন গাড়ীতে সচরাচর আমি কথা বলি না। বই পড়ি। কিন্তু রবিউল জানে না, আমার পাশেই বিভাসের অস্তিত্ব অনুভব করছি এবং প্রগলভতায় আমি সেই অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে চাইছি।
এক সময় কি দারুণভাবে অস্তিত্বময় ছিল আমার জীবনে ও। শিশু বয়স থেকে আমরা পাশাপাশি বাড়িতে বড় হয়েছি। ওর বাবা প্রফেসর, আমার বাবা ব্যবসায়ী। মতে একদম মিল নেই কিন্তু আমাদের মধ্যকার সঘন প্রেমে তাঁদের কারো দ্বিধা ছিল না। কেন ছিল না সেটা একটা বিস্ময়। ভার্সিটিতে ভর্তি হবার ক’মাসের মধ্যে এক বড় ভাইয়ের উস্কানিতে বিভাস কমিউনিজম জ্বরে আক্রান্ত হলো। ওর মনে হতে লাগলো সমাজের একশ্রেণীর পুঁজিবাদী মানুষ আর্থসামাজিক অধিকার জবর দখল করে রেখেছে। এরাই শ্রেণী শত্রু, এদেরকে ধ্বংস করতে হবে। ও গোপন একটি কম্যুনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হলো। একদিন আমাকেও সেই বিপ্লবী চেতনায় দীক্ষিত করল। আমার উপর ওর প্রভাব ছিল সীমাহীন। দুজন মিলে মার্কসবাদ-লেলিনবাদ গুলে খেতাম। সমাজ বদলানোর চিন্তা আমাদের মাথায় এমন চেপে বসল যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ততদিন পর্যন্ত থামব না যতদিন পুঁজিবাদী এই সমাজকে সাম্যবাদী সমাজে রূপান্তরিত না করা যাবে। ভার্সিটি ফাঁকি দিয়ে চলে যেতাম পুরনো ঢাকার গলি ঘুপচিতে। গোপন মিটিং গুলোয় বিভাস রগচটা উদ্ধত যুবক। অন্যায় বললে লিডারকেও ছাড় দিয়ে কথা বলে না। আবার আমার পাশে একান্ত যখন, তখন সে পাগল প্রেমিক। আমাদের আটুল বাটুল শ্যামলা শাটুলের প্রেমে একের পর এক সাজিয়ে ফেলত নিখাদ ছায়ার ঝাউবীথি। যুগলে ছুঁয়ে যাওয়া হাওয়ায় ভৈরব সুর সঞ্চারিত হতো আমাদের শরীর মনের তাবৎ পাড়ায়।
সুজাতা, তোমার গাড়ীটির দাম কত?
আবার চমকে উঠলাম। ও কেন দাম জানতে চাইছে আমি জানি। পুঁজিবাদী ধনী শ্রেণীকে ওর প্রচন্ড ঘৃণা। এই ঘৃণা ওকে দিনে দিনে হিংস্র করে তুলেছিল। ও আমার জবাবের অপেক্ষা করছে কিনা জানি না। কিন্তু আমি কিছু বললাম না।
গাড়ী মগবাজার চৌরাস্তা পার হয়ে বেইলি রোডে আমার বাড়িতে থামল। তালা খুলে খুব দ্রুত ভেতরে ঢুকে গেলাম। কিছুতেই এ বাড়িতে ওর উপস্থিতি আমি চাই না। এসি অন করে সোজা বিছানায়।
ওয়াও! সেন্ট্রাল এসি নাকি? কুল, সুজাতা!
ঘর যেন নয় ধূধূ প্রান্তর। প্রতিটি কথার ইকো হচ্ছে। আমার পাশে শুয়ে আছে ও। দেখতে পাচ্ছি না, অনুভব করছি ওর তপ্ত নিঃশ্বাস। খুব অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটলো। ওকে আমি আর মোটেই ভয় পাচ্ছি না। বরং প্রচন্ড লোভ হচ্ছে। কামনা করছি বিভাস ওর শরীরে ফিরে আসুক। নাক গুঁজে প্যান্টিনের ঘ্রাণ নিক আমার মোহময় চুলে। ও আমার ওম হোক। ওর ফিরে আসাই তো আমি চেয়েছি এতটা বছর। ওকে সানন্দে এক্সেপ্ট করা উচিত। আমি খুব শান্তস্বরে বললাম,
কেন এসেছ বিভাস?
আসব কেন সুজাতা? আমি ছিলাম।
কোথায় ছিলে? আমি দেখলাম না কেন?
কেন তোমার মধ্যে। একটা দিন কল্পনা কর তো, যেদিন আমাকে তুমি ভাব না।
আর ভেবে কি হবে?
ফয়সাল কোথায়?
গাজীপুর, অফিসে গিয়েছে।
সুজাতা তুমিও আমার আদর্শ ছেড়ে দিলে?
হুম।
কেন?
কি হবে? এদেশে কমিউনিস্টরা কিছু কিছু হত্যাযজ্ঞ ছাড়া কি করতে পেরেছে?
চেষ্টা করে দেখেছ?
তুমিও তো চেষ্টা করেছিলে, কি লাভ হলো? সমাজকে একচুল পরিমান বদলাতে পেরেছ? বরং তোমাকেও মরতে হয়েছে।
আমাকে কে মেরেছে তুমি জান?
জানি।
তবুও তার সাথেই ঘর করছ?
হ্যাঁ করছি। কারণ নইলে তোমার মতই আমাকে মরতে হবে।
বাহ্! বলিহারি তোমাকে সুজাতা।
ঘর প্রকম্পিত করে ও হাসছে। এতক্ষণে আমার মনের মধ্যে অজানা একটা ভয় শিরশিরিয়ে উঠল।
দুজনের সংসার। ফয়সালের আসতে রাত হবে। কাজের মেয়েটা ছুটিতে। ফয়সাল চেয়েছিল বাসায় অনেক পিওন আর্দালি থাকুক। আমিই চাইনি। ভীড় ভাল লাগে না। ফয়সালকে ফোন করলে হয়ত চলে আসবে। কিন্তু ওকে ফোন করতে ইচ্ছে করছে না। খুব প্রয়োজন ছাড়া ফোন করিও না। ফয়সালই দিনে কয়েকবার খোঁজ নেয়। সেটা ভালবাসায় নয়, আমার অবস্থান জানার জন্য। আমার সম্পর্কে নোংরা চিন্তা ওর মগজে কিলবিল করে। আর সেটা মাঝে মধ্যেই সামনে এসে বমির মত উগরে দেয়। আমার নির্লিপ্ততা ওর মেজাজকে শতভাগ উস্কে দেবার বড় অস্ত্র। আমি সেই অস্ত্র প্রয়োগ করি। ও নিস্ফল আক্রোশে বোতলের ছিপি খুলে বসে। আমিও ঠোঁটে পরিতৃপ্তির কর্পোরেট হাসি ঝুলিয়ে ঘুমুতে চলে যাই। কিন্তু শুয়ে থাকি, ঘুমাই না। বিভাস আমাকে চৌদ্দটি বছর ঠিকমত ঘুমুতে দেয়নি।
ফয়সাল বেশ পরে আমাদের দলে যোগ দিয়েছিল। একসাথে পড়ার সুবাদে বিভাস আমি দুজনই ওর বন্ধু। বিভাস খুব গোপনে সদস্য সংগ্রহ করত। তখন তত্বাবধায়ক সরকারের আমল। চারদিকে ধরপাকড় আর ভাঙ্গাভাঙ্গি চলছে। অনেক পীড়াপীড়িতে বিভাস ফয়সালকে একদিন সূত্রাপুরে মিটিং এ নিয়েছিল। সেখানেই ফয়সাল সদস্য হিসেবে যোগ দেয়। কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে গিয়েছিলাম আসলে ওর নিজস্ব কোন আইডোলজি ছিল না। ওই দলে আসার একমাত্র কারন আমি। বিভাসকে টেক্কা দিয়ে আমাকে জিতে নিতে চেয়েছিল। মাত্র কয়েকদিনেই আমার আর বিভাসের মধ্যে ও আড় কাঠির মত বেরিয়ার হয়ে দেখা দিল। হয়ত আমরা দুজনে রিক্সায় বুড়িগঙ্গা ব্রিজ পার হবার প্ল্যান করেছি ও আচমকা হাজির হয়ে প্ল্যান ভেস্তে দিতে লাগলো। বাপের গাড়ী নিয়ে হুটহাট লিফট দিতে চলে আসতে লাগলো। আমাদের গম্ভীর কোন রাজনৈতিক আলাপের মাঝে ক্রিকেট বা সিনেমার হালকা কোন গল্প ঢুকিয়ে ফেলত অনায়াসে। বিভাস প্রথম প্রথম চুপ থাকলেও ক্রমেই বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। ফয়সালের সাথে খুব রূঢ় আচরণ করত। আমি ওকে থামাতে চাইলে কতদিন রেগেমেগে আমাকে ফেলে চলে গিয়েছে। আশ্চর্য্য, ফয়সাল কিছুই মনে করত না। বিভাসের রাগকে ছেলেমানুষি বলে হেসে উড়িয়ে দিত। কি ভীষণ চতুর ছিল ফয়সাল। যেটা অনেক পরে বুঝেছি।
দক্ষিণ বঙ্গে একটা গোপন মিটিং এ গিয়েছিল বিভাস। ঝিনাইদহের মহেশপুরে। পুলিশ জেনে গিয়েছিল খবর। যেদিন ধরল সেদিনই এনকাউন্টার। ফয়সাল খুব নির্বিকারভাবে আমাকে বিভাসের মৃত্যু খবর দিল। ফয়সালই যে পুলিশকে জানিয়েছিল সেটা আমি বিয়ের অনেক পরে জানতে পারি। কিন্তু মানুষ বোধ হয় নিজেকেই সব থেকে বেশি ভালবাসে। ফয়সালকে ঘৃণা করা ছাড়া আর কিছু করতে পারিনি।
মাথা ব্যথাটা আবার বেড়েছে। অনেকক্ষণ ধরে বিভাসের অস্তিত্ব বুঝতে পারছি না।
আমি ব্যাকুল হয়ে ডাকি,
বিভাস আছ? এই বিভাস?
কোন সাড়া নেই। ও কি চলে গেল?
ভাবতেই শূন্য চর জেগে ওঠে চোখের কোণে। খুব অস্থির হয়ে উঠি আমি। ঘরের পর ঘর বদলাই । কোথাও নেই। বিভাস, বিভাস বলে পাগলের মত চিৎকার করি। একসময় ঝরঝর করে কেঁদে ফেলি। বারান্দা বেয়ে মৃদু এক পশলা হাওয়া আসে। আমার শরীর বুলিয়ে দেয়।
কানের কাছে এসে চুপিচুপি বলে,
আমি আছি সু।
আমি আরও জোরে কাঁদি। আদর করে ও যে আমাকে সু বলে ডাকতো, সেটা ভুলে গিয়েছিলাম।
বিভাস আমি তোমাকে দেখতে চাই।
চেষ্টা করলেই দেখতে পাবে।
কিভাবে?
খুব গভীরভাবে তাকাও, অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে।
আমি সোজাসুজি তাকাই। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। চোখের পাতা পড়ে না। বিভাস, আমার সেই বিভাস! এই ব্ল্যাক শার্ট পরেই তো সেদিন ঝিনাইদহে গিয়েছিল। যাবার সময় শুধু বলেছিল, সাবধানে থেকো। আমি বিশ্বাস করতে পারি না। এসবকিছু স্বপ্নে ঘটছে না তো? ওর হাত ধরি, নাক টিপে দেই, চুল ধরে টানি। ওর বুকের মধ্যে সেঁধিয়ে যাই। ও সবল দুবাহুর মধ্যে আমাকে বন্দী করে। আমি ওর বুকে চৌদ্দ বছর আগের সেই স্পন্দন শুনি। ঢিপঢিপ ঢিপঢিপ…।
বহুদিন পর আমি দীর্ঘ শাওয়ার নিয়ে বের হই। ও আমার শরীর ঘেঁষে দাঁড়ায়। আমার হাত ধরে। চব্বিশ বছরের যুবকের সাথে সাথে ঘর বারান্দা হেঁটে বেড়ায় আটত্রিশ বছরের একজন পরিণত নারী।
বিকেলে ছাদে যাই। ফুল গাছের কেয়ারী করি। পানি দেই। ও আমার সাথে সাথে কাজ করে। আকাশের কমলা রঙ আমাদের দুজনকে ভিজিয়ে দেয়। কখনো আমার হাতের চায়ের কাপে ওর হাত থেকে টুপ করে ঝরে পড়ে গোলাপের পাপড়ি । আমি সেই চা গোলাপ জল হিসেবে পান করি। আমার কানে গুঁজে দেয় সবথেকে বড় কসমসটি। আমরা যুগলে সেলফি তুলি। আমাদের দুজনের মাঝে থালার মত সূর্যটি রাঙা হাসে। খুব দ্রুত আমার দিনলিপি বদলে যায়।
ও কখনও কিছু খায় না। কিন্তু খাবার টেবিলে বসে খুনসুটি করে। টেবিলের নীচে পায়ের সাথে পা জড়িয়ে রাখে। আমার সুড়সুড়ি লাগে, পা টেনে নেই। রান্নার সময় গলা পেঁচিয়ে ধরে গালের সাথে গাল ঘষে।
উফ! বিভাস শেভ করে এসো, লাগছে তো!
ও শেভ করে না । বিভাসের দাড়ি লম্বা হচ্ছে। ওকে দেখতে এখন বেশ লাগে। চেগুয়েভারার মত। আমি মাঝে মাঝে মাঝে ওকে চে বলে ডেকে উঠি। বিভাস উঁ বলে সাড়া দেয়। ইদানিং বিভাস আমাকে বলে পুঁজিবাদী। রাতে ঘুমানোর সময় দু বেণী করা আমার অভ্যাস। ও প্রতি রাতে বেণী দুটি খুলে চুল ছড়িয়ে দেয়। খোলা চুলে নাকি আমাকে অপ্সরী লাগে।
আগের মতই বিভাসের সাথে আমার তুমুল তর্ক চলে। প্রেম, রাজনীতি, বর্তমানের কমিউনিজম। আমি বলি কোমরভাঙা কমিউনিজম। বিভাস ক্ষেপে ওঠে। ওর চব্বিশ বছরের বুদ্ধি আর আমার আটত্রিশ বছরের পরিণত অভিজ্ঞতায় কখনও কখনও ম্যাচ করে না। ও রাগী যুবকের মত রেগে যায়। অভিমান করে বাচ্চাদের মত। আমি কখনও প্রেমিকার শাসনে, কখনও মায়ের মমতায় মান ভাঙ্গাই। আবার কখনও এমন হয়, অলস মোহময় মধ্যাহ্নে এক নিঃসঙ্গ নারী নির্মম ভাবে চব্বিশ বছরের পুরুষটিকে পেতে চায়। ও আসুক আমাকে ভেঙ্গে পুনঃ নির্মাণ করুক। বিভাস আসে। ওর যাদুর ছেনীর স্পর্শে বারবার পুনঃ নির্মিত হয় আমার শ্যাওলা ধরা প্রাচীন ভাস্কর্য।
ফয়সাল বেশ রাত করে ঘোরে ফেরে। আমি অস্থির হয়ে অপেক্ষায় থাকি সকালের। এই সময়টুকু আমি বোবা হয়ে থাকতে চাই কিন্তু পারি না। ফয়সালের সামনেই বিভাস আমাকে পেছন থেকে আচমকা কোমর পেঁচিয়ে ধরে। খুব ভয় পাই। ফয়সাল যদি ওকে দেখে ফেলে? সরিয়ে দেই। ফয়সাল আমার পরিবর্তন ধরে ফেলে। ও বিস্মিত হয় যতটা, অখুশি হয় তার থেকে অনেক বেশি। খোঁচা দিয়ে বলে, কি ব্যাপার আজকাল তোমার মধ্যে অনেক চেঞ্জ। শরীরে জেল। নতুন প্রেমে পড়েছ নাকি? আমি নির্লিপ্ত। ও খুব করে ক্ষেপে যায়। মাতলামি বাড়ে। স্বামীত্ব ফলাতে এসে আক্রোশে আরও নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। আমি বরাবরের মত দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থাকি নির্মোহ। ওর সম্ভ্রমে লাগে। একসময় কালিহীন কলমের মত ছুঁড়ে ফেলে। অশ্লীল ভাষায় গালি দেয়।
শালীর শরীর তো নয়, লাশ। শরীরের তেজ যায় কোথায়? আমি কিছু বুঝিনা ভেবেছো? মর। মেয়ে মানুষের অভাব রয়েছে আমার?
আমি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ি,
পালাচ্ছ কেন ফয়সাল? আমাকে গ্রহণ কর। এর জন্যই না তুমি বিভাসকে সরিয়েছো? দেখ, বিভাস আবার ফিরে এসেছে।
বিভাসের ফিরে আসার কথা শুনে ফয়সাল ধন্দে পড়ে যায়। বিক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে চারপাশে দেখে। প্রায় দৌড়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করে। ওর আর আমার ঘর আলাদা। ও এখন বোতল নিয়ে বসবে। কিছুক্ষণ বাদে মাতাল হয়ে অনুতাপে দগ্ধ হবে। নিজের মৃত্যু কামনা করবে। আমাকে নিজের করে না পাওয়ার যন্ত্রণায় চিৎকার করে কাঁদবে। প্রতিরাতে ওর এই সময়টুকুই আমার পরম আনন্দের। ফয়সাল হাঁটু গেঁড়ে প্রার্থনায় বসে। আমার চোখে ঘুম আসে মোহন ভঙ্গিতে। আমাকে টেনে নিয়ে চলে রাতের গভীরে। যাবার মুহূর্তে আমি বিভাসের দীর্ঘশ্বাস শুনি। ও কখনও ঘুমায় না।
এরপর দিন কাল বছর কিছুই আমার হিসেব নেই। কতকাল পরে মনে হলো আমি গভীর ঘুম থেকে ধীরে ধীরে জেগে উঠছি। চোখ খুলতে কষ্ট হয়। মাথায় প্রচন্ড ব্যথা। ঘরটা আমার নয়। অপরিচিত সাদা ধবধবে পর্দায় ঘেরা। আশে পাশে সবুজ অ্যাপ্রোন পরা লোকজন ঘুরছে। কিন্তু ওদের চলফেরায় কোন শব্দ নেই । ওরা কি পায়ে নরম সোলের জুতা পরেছে, নাকি খালি পা? প্রশ্নের জবাব খুঁজতে আমি কাত হবার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারা গেল না। শরীরটা যেন ভারী পাথর। মানুষ গুলোকে অশরীরী মনে হয়। আমার মুখের উপর দুজন নারী-পুরুষের মুখ ঝুলে থাকে। গলায় স্টেথোস্কোপ। ওরা বুক দেখে, চোখ দেখে। বাহুতে প্রবল চাপ অনুভব করি। এতসময়ে আমি ভাসা ভাসা কথা শুনি,
বিপি হাই, ২৩০..। তবে চিন্তার কিছু নেই যথেষ্ট ইমপ্রুভ করেছে। আপনি আপনার স্ত্রীকে সামনের সপ্তাহে বাড়িতে নিতে পারবেন।
ডক্টরের পাশে ফয়সাল দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখে কি? তাচ্ছিল্য নাকি ঘৃণা? যাই হোক মায়া নেই ছিটেফোঁটা। কিছুক্ষণ পরেই ওর কণ্ঠ শুনতে পাই,
ডক্টর সাহেব, আমি চাচ্ছি আমার মিসেস আপনাদের কেয়ারেই থাকুক। ও এখন ফুল ম্যাড। কয়েকবার সুইসাইড করতে গিয়েছে। বাসায় গেলে আবারও চেষ্টা করবে। আপনারা বরং ওকে ঘুম পাড়িয়ে রাখুন। পেমেন্টের চিন্তা করবেন না, মাস শেষে পেয়ে যাবেন।
নো প্রব্লেম। অ্যাজ ইয়োর উইশ। ডক্টরের মুচকি হাসি দীর্ঘায়িত হয়।
আমি চিৎকার করে উঠি,
ফয়সাল, মিথ্যে বলছ কেন? আমি পাগল নই। সত্যি বিভাস ফিরে এসেছে। প্লিজ ডক্টর, আমাকে ঘরে যেতে দিন।
আমার কোন কথাই ওরা শুনছে না। ফয়সাল চলে যাচ্ছে। সবুজ অ্যাপ্রোন পরা মেয়েটি ডান হাতে সূচ ফুটিয়ে দিল। আচমকাই ঘরটিতে ঘন কালো পর্দা নেমে আসে। বিশাল এক ব্ল্যাকহোল যেন তীব্র মহাকর্ষীয় বলে আমাকে প্রচন্ড গতিতে টানছে। আমি ক্রমশ সেদিকে ধাবিত হচ্ছি। নিখাদ কালো আঁধারে ঢাকা সে পথটি হয়তবা অফুরন্ত। বা এমন হতে পারে, শেষে রয়েছে কৃষ্ণ গহ্বরের কেন্দ্র অথবা আরো একটি মনুষ্য করোটি।
– ম্যারিনা নাসরীন