আশির দশকের একটি গল্প বলতে চাই।ভদ্রলোকের নাম “বেলায়েত হোসেন ” বয়স ৫২। ডিসি অফিসে চাকরী করেন, চাকরীর স্থান কলাপাড়া। সুন্দরী বউ, আর এক ছেলে তিন মেয়ে নিয়ে সুখী সংসার। ভদ্রলোকের সমস্যা হল তিনি একটু ঘাউড়া টাইপের লোক। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর অভ্যেস আছে। এই নিয়া বউয়ের সাথে অশান্তি ও আছে।কিন্তু ঘরের শান্তি রক্ষার জন্য বউয়ের কথা শুনবেন এমন লোকও তিনি নন।তাই স্বাভাবিক ভাবেই ঘরের চেয়ে বাইরে তার জয়জয়কার বেশী।
বেলায়েত হোসেনের ছোট ভাইয়ের বিয়ে।একগাদা টাকা নিয়া তিনি ঢাকা রওনা হইছেন এই উপলক্ষে।কলাপাড়া লঞ্চঘাটে লঞ্চের অপেক্ষায় বসে আছেন। একাই যাচ্ছেন তিনি।কারন আগের রাতে চরম অশান্তি হইছে বাসায়। স্ত্রীর ভাষ্য ” ভাইকে লেখাপড়া করাই মানুষ করছো, এখন ভাল চাকরী করে। তারপর ও একগাদা টাকা দিয়ে ক্যান তোমার বিয়ে দিতে হবে।বেলায়েত হোসেন চুপ।কথা বললেই অশান্তি বাড়বে। শেষমেশ স্ত্রী সিদ্ধান্ত দিলেন তিনি কিছুতেই এই বিয়েতে যাবেন না। অগত্যা বেলায়েত সাহেব একাই যাচ্ছেন। ঘর থেকে বের হওয়ার ঠিক আগ মূহুর্তে তার ১০ মাস বয়সী ছোট মেয়েটি কোলে ঝাপিয়ে পড়লো।কিছুতেই তাকে মায়ের কোলে হস্তান্তর করা গেলোনা। বাসার সাথেই লঞ্চঘাট। তাই বাচ্চাকে কোলে নিয়েই তিনি লঞ্চঘাট গেলেন। বাচ্চাকে ফেরৎ আনার জন্য স্ত্রী কেও লঞ্চঘাট যেতে হল।লঞ্চ চলে আসছে, উঠে দাড়ালেন বেলায়েত হোসেন।স্ত্রীকে বললেন ” মীরন যাওয়ার সময় এমন মুখ কালো কইরা থাইকনা, খারাপ লাগে।লঞ্চ থেকে লোকজন নামছে তাই আর কিছু বলতে পারলেন না।মেয়েটাকে মায়ের কোলে দিলেন।বাচ্চাটা এখন শান্ত। মাথায় হাত দিয়ে মেয়েকে আদর করলেন তিনি।বললেন ” চইলা আসবো তাড়াতাড়ি, একটু হাসি মুখে তো বিদায় দিতে পার!! বাচ্চাটা বাবা ডাকতে পারে। সে বাবা বাবা বইলা বেলায়েত সাহেবের পাঞ্জাবীর হাতা খামচে ধরল।মনটা খারাপ হইল তার।মন খারাপ নিয়া তিনি লঞ্চে উঠলেন। লঞ্চ ছেড়ে দিল। লঞ্চের সামনের পাটাতনে দাড়াইয়া তিনি স্ত্রী আর শিশুকন্যার দিকে অসহায় চোখে তাকাই রইলেন। মীরনের সবুজ শাড়ী আর চুল বাতাসে উড়ছে সমানে। শিশুটি গভীর মনোযোগে উড়ন্ত চুল ধরতে ব্যস্ত!!!
ভাইয়ের বিয়ে মিটে যাওয়ার পর ও ঢাকা ইউনিভার্সিটির কোয়ার্টারে থাকা ছোট বোন লুতফা আবদার করল ” মিয়াভাই আরেকটা দিন থাকেন না। ছোট বোনের অনুরোধ ফেলতে পারলেননা তিনি,থেকে গেলেন। দুর্দান্ত ফুটবল খেলতেন বেলায়েত হোসেন।রক্তে নেশা ছিল ফুটবলের। ঢাকা স্টেডিয়ামে তখন ফুটবল খেলা চলে। ছোট বোনের জামাই রে নিয়া তিনি মহা আনন্দে খেলা দেখতে চলে গেলেন বিকেলে।খেলা শেষ করে ফিরতে ফিরতে রাত ৯:৩০। ইউনিভার্সিটি এরিয়ায় ঢুকলেন তিনি, সাথে ছোট বোনের জামাই এরফান।হঠ্যাৎ ৬/৭ জন অল্প বয়সী ছেলে তাদের দিকে এগিয়ে আসল।ব্যাপার টা বোঝার চেষ্টা করলেন বেলায়েত হোসেন।কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলে গুলা ঘিরে ধরলো তাদের। আবছা আলোয় তিনি দেখতে পেলেন ছেলেগুলোর হাতে রিভলভার আর বেশ বড় সাইজের একটা ছুরি। বেলায়েত হোসেন হতভম্ভ, এইটুক এইটুক বাচ্চা পোলাপান কি করতেছে এগুলা!!!! পকেটে মাত্র ৪২ টাকা আর হাতে একটা ঘড়ি।রিভলভার তাক করা হল এরফানের মাথায়,ছুরি ঠেকানো হল বেলায়েত সাহেবের বুকে। দলের মধ্যে একটা ছেলে বলল ” যা আছে বাইর কর সব।প্রথমে কিছুটা দিশেহারা হলেন তিনি। কিন্তু তারপরই ছুরি ঠেকানো ছেলেটারে জোড়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলেন মাটিতে।চিৎকার দিলেন তিনি “” বেয়াদব থাপড়াইয়া দাত ফালাই দিমু!! এত সাহস!!
মাদকাসক্ত পোলাপান এত সব ক্যান সহ্য করবে!! মাটি থেকে উঠেই পেট বরাবর ছুরি ঢুকাই দিল বেলায়েত হোসেনের। এরফান সব দেখতেছে, শুনতেছেও। কিন্তু প্রতিবাদ করার তো প্রশ্নই ওঠেনা কারন মাথায় রিভলভার ঠেকানো। ছুরি মাইরা ছেলে গুলা পালিয়ে গেল সাথে সাথে।
মাটিতে পড়ে আছেন বেলায়েত সাহেব। গোঙানির আওয়াজ হচ্ছে। এরফান দৌঁড়াইয়া বেলায়েত সাহেব রে জড়াই ধরল, মিয়াভাই কিচ্ছু হবেনা আপনার, আমি আছি, একটু চোখ খোলা রাখেন শুধু। রক্তে ভাইসা যাইতেছে রাস্তা। মানুষ জনের সাহায্য নিয়া তারে একটা ট্যাক্সি তে ওঠানো হল। রক্ত থামানো যাচ্ছেনা, ভাইসা যাইতেছে ট্যাক্সির সিট। বেলায়েত হোসেন দুর্বল হাত দিয়ে চেপে ধরেছেন ক্ষতর জায়গাটা। বাঁচতে চান তিনি। মতিঝিলের শাপলা চত্তর টা ক্রস করার সময় এরফান জোরে চিৎকার দিল “” মিয়াভাই চোখ খোলেন!! ও মিয়াভাই!! মিয়াভাই আর নাই, নিস্তেজ মাথাটা কাত হয়ে আছে এরফানের কোলে—————।
গভীর রাতে টেলিগ্রাফ অফিস থেকে কলাপাড়ায় খবর গেল বেলায়েত সাহেবের পরিবারের কাছে। গ্রামের বাড়ী যেতে হবে তার স্ত্রী কে জরুরী ভাবে।মীরন ভেবেই পেল না গ্রামের বাড়ীতে এমন কি ঘটল যে এখন ই তাকে যেতেই হবে। ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে ভোর রাতে সে লঞ্চে উঠলোল কোলের ১০ মাসের মেয়েটা অকারনে শুধু কাঁদছে, কোনভাবেই তাকে শান্ত করা যাচ্ছেনা।
ঢাকা থেকে লাশ নিয়ে রওনা হয়েছে সবাই। কিছুই জানেনা মীরন। জানেনা সে কি ভয়াবহ অনিশ্চিত জীবন অপেক্ষা করছে তার জন্য!!!
কোলের সেই ১০ মাসের শিশু কন্যাটির নাম– ” নাঈমা পারভীন অনামিকা “”
আমার বয়স ৩৭ চলতেছে। এই ৩৭ বছরে আমি কত বার যে ভেবেছি — কি হইত গণ্ডগোল না করে ৪২ টাকা আর ঘড়ি টা ওদের দিয়ে দিলে। আব্বা বেঁচে থাকতেন। আমি পিতৃহারা হইতাম না, আম্মা অল্প বয়সে বিধবা হইত না। কি অমানুষিক বাস্ত্যবতায় আম্মা আর আমাদের দিন কেটেছে, সে অনুভূতি কাউকে বোঝান সম্ভব না। তারপর আম্মার চাকরী হইল, আব্বার সম্পত্তির আয় দিয়া আমরা বেশ সচ্ছল ভাবেই জীবন কাটাইছি। কিন্তু একটা অতৃপ্তি সারাজীবন ই থেকে গেল—– পিতৃস্নেহ।
আজ আমার দুই মেয়েরে যখন তাদের বাবা আদর করেন, আমি আড়াল থেকে তৃষার্ত নয়নে সেই ভালবাসা দেখি। আমার চোখ ভিজে ওঠে বারবার। তখন কেবলই মনে হয় — আহারে!!! আমি কি হারাইলাম!!
তারপর ও আমি গর্বিত যে আব্বা আর পাঁচ টা সাধারণ লোকের মত ছিলেন না। অন্যায়ের প্রতিবাদ সবাইরে দিয়া হয়না।সবাই পারেনা। কলিজার জোর লাগে!!
আমার জামাই প্রায়ই আমারে বলেন “” এত ঘাউড়া ক্যান তুমি?? একটু আপোষ করে চলতে পারনা?? সব জায়গায় সত্যবাদী যুধিষ্ঠির সাজতে যাও!! আমি একটুও রাগ করিনা তার কথায়। বরং অন্য রকম ভাললাগায় মন ভরে যায়, এই ভেবে যে —‘” আমি আমার অভ্যন্তরে বাবাকে ধারন করে আছি!!!
( এখন ও বরিশাল গেলে এত বছর পরেও কেউ না কেউ এই কষ্টের কাহিনী আমার সাথে বলে, আর আমি বাবার শোকে আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বুক ভাসাই)।
-নাঈমা পারভীন অনামিকা