-কি সমস্যা আপনার??
-বুঝলেন স্যার আমি একজন অদৃশ্য মানব!! এটাই আমার সমস্যা!!
রোগীর কথা শুনে ডাঃ হাসান এনামের মেজাজ চরম খারাপ হলো কারন তিনি শিওর এই লোক তার কাছে আসেনি, উনি এসেছেন ডাঃ হাসান জামানের কাছে!! ডাঃ হাসান জামান পাগলের ডাক্তার!! যে লোক নিজেকে অদৃশ্য মানব বলে সে পাগল না হয়ে উপায় আছে?? নাম কাছাকাছি হওয়ায় প্রায় হাসান জামানের রোগীরা উনার কাছে চলে আসে!! এইতো কয়েকদিন আগে একজন এসে বলল, স্যার আমি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভুলে বাংলাদেশে চলে এসেছি অথচ কেউ বিশ্বাস করে না আমার কথা!! হাসান সাহেবের একবার ইচ্ছা করলো ব্যাটাকে কষিয়ে এক চটকানা মারে!! পরে অনেক কষ্টে সে রোগীকে বিদায় দিয়েছেন!! আর তার অ্যাসিস্ট্যান্ট রফিককে কয়েকবার করে বলে দিয়েছেন আগে ভালো করে জিজ্ঞেস করবে কার কাছে এসেছে তারপরে রোগী ঢুকতে দিবে এর আগে না, কিন্তু কে শোনে কার কথা!!
-আপনার ভুল হয়েছে মনেহয় আপনি ডাঃ হাসান জামানের কাছে এসেছেন!! আমার নামও হাসান হওয়ায় এই ভুল অনেকে করেন!!
-না, না স্যার আমি আপনার কাছেই এসেছি!! আসলে আমি জানি ডাঃ হাসান জামান পাগলের ডাক্তার!! কিন্তু আমি আপনার কাছেই এসেছি!! আসলে কোন রোগের কারনে আসি নাই!! আমার মত আপনিও একজন অদৃশ্য মানব তা জানাতে এসেছি!! অবশ্য অদৃশ্য মানব এটাও মনেহয় কোন অসুখ!! কি বলেন এইসব?? আমি অদৃশ্য মানব হবো কোন কারনে?? আর এই অদৃশ্য মানব এগুলা আবার কি??
-আসলে স্যার অদৃশ্য মানব ব্যাপারটা হচ্ছে যারা সমাজে থেকেও নাই!! যারা চোখের সামনে কোন অন্যায় দেখেও চুপ থাকেন, কোন প্রতিবাদ করেন না অন্যায়ের, ভাবটা এমন ধরেন যে তিনি অন্যায় হচ্ছে দেখতেই পাচ্ছেন না!! তিনি ঘটনাতেই নাই!! আসলেই তারাই অদৃশ্য মানব স্যার!! আমরা যারা অদৃশ্য মানব তারা একজন আরেকজনকে ব্যাপারটা জানিয়ে দেই যে সে অদৃশ্য মানব, আমরা অদৃশ্য মানবরা একজন আরেকজনকে খুঁজে বের করি!! খুঁজে বের করার একটা কারন আছে!! যদি আমরা একজন অদৃশ্য মানবকে খুঁজে বের করে সমাজ থেকে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হওয়ার থেকে রক্ষা করতে পারি তাহলে যে খুঁজে বের করে সেও অদৃশ্য হওয়ার থেকে মুক্তি পায়!! আপনাকে যদি আমি সম্পূর্ন অদৃশ্য হওয়ার থেকে রক্ষা করতে পারি তাহলে আমিও এই অদৃশ্য হওয়া থেকে মুক্তি পাবো!! বুঝলেন স্যার অদৃশ্য মানব হয়ে বেঁচে থাকাটা খুব কষ্টের!! কেন কষ্টের সেটা পরে বলছি, আগে বলি আমি কিভাবে অদৃশ্য হলাম!! অনেকদিন আগে আমাকেও একজন এসে জানিয়েছে আমি একজন অদৃশ্য মানব!! একদিন বাসার কাছে দাঁড়িয়ে চায়ের দোকানে চা খাচ্ছিলাম তখন একলোক এসে বলে, ভাই আপনি যে একজন অদৃশ্য মানব আপনি জানেন?? স্যার, আমার অদৃশ্য মানব হওয়ার কারন ছিল, আমার পাশের বাসায় এক মেয়ে রেপ হয় স্যার!! রাতের বেলায় মেয়েটার চিৎকার শুনেও কানে বালিশ চাপা দিয়ে রেখেছিলাম আমি!! আশেপাশে কি হচ্ছে সব ভুলে ছিলাম!! সকালে মেয়েটাকে নিয়ে যখন পাড়ায় কথা উঠে মেয়েটা বেশ্যা তখন আমি প্রতিবাদ করে বলতে পারতাম, না সে বেশ্যা না, সে ধর্ষিতা!! কিন্তু বলি নাই আমি!! মেয়েটার চোখে চোখ পড়তেই নিজেকে লুকিয়ে ফেলি আমি!! ভাবটা এমন করি আমি সেখানেই নাই!! আপনাকে স্যার প্রথমে এসে বলা হবে আপনি অদৃশ্য মানব তবে তখনো আপনি সমাজ থেকে সম্পূর্ন অদৃশ্য হবেন না!! আপনার হাতে কিছু সময় থাকবে সমাজ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার!! যদি আপনি প্রতিবাদ করেন সেই অন্যায়ের তবেই আপনি রক্ষা পাবেন অদৃশ্য হওয়ার থেকে!! যদি সেদিন আমি থানায় গিয়ে সাক্ষী দিতাম যে মেয়েটাকে রেপ করা হয়েছে, কারা রেপ করেছে তাহলে আমি এই অদৃশ্য জীবন থেকে মুক্তি পেতাম স্যার!! ধর্ষণ হওয়ার থেকে মুক্তি পেতো আমার নিজের বোন!! স্যার বলেছি না অদৃশ্য মানব হয়ে বেঁচে থাকা অনেক কষ্টের!! আসলে সেদিন আমাকে বলা হয়েছিল আমি যদি মেয়েটার ধর্ষণের প্রতিবাদ করি তবে শুধু নিজেই অদৃশ্য হওয়ার থেকে রক্ষা পাবো না, রক্ষা পাবে আমার ঘরের কেউ না কেউ!! আমরা যারা অদৃশ্য মানব হই আমাদের শাস্তি এটাই যে অপরাধের প্রতিবাদ না করি সেই অপরাধে নিজের ঘরে কেউ না কেউ ভোগে!! বুঝলেন স্যার বোনের কষ্টে সেদিন আমি চিৎকার করে কেঁদেছি অথচ দেখলাম কেউ আমার কান্না শুনতে পাচ্ছে না!! পুলিশের পায়ে পড়ে বললাম কারা আমার বোনটাকে রেপ করেছে অথচ তারা আমাকে দেখতেই পেলো না!! আমি কিছুইতে কিছু স্পর্শ করতে পারি না!! কোন কিছুর গন্ধ পাই না!! শুধু চিৎকার করি আর চিৎকার শুনি!! মায়ের পাশে দাঁড়ানো আমি অথচ মা বলে, আমার রবি কই?? তার বোনের এই সর্বনাশ হয়েছে আর সে গেলো কই?? স্যার আমার নাম রবি, আর স্যার বুঝতে পারছেন অদৃশ্য মানব হওয়ার কি কষ্ট?? এবার বলি আপনাকে কিভাবে পেলাম, গতকাল রাতে আপনার বাসার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় এক বাচ্চা মেয়ের চিৎকার শুনে আপনার ঘরে ঢুকি আমি!! স্যার আমরা যেহেতু অদৃশ্য মানব তাই আমাদের কেউ দেখে না!! যতক্ষণ না আপনি জানবেন আপনি একজন অদৃশ্য মানব ততক্ষন আপনিও অন্য অদৃশ্য মানব দেখবেন না!! আপনার ঘরে ঢোকাতেও তাই আমাকে আপনিও দেখেন নাই!! যাইহোক দেখলাম আপনার স্ত্রী আপনার বাসার কাজের মেয়েটাকে মারছে, আর আপনি পাশে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন!! এক পর্যায় আপনার স্ত্রী মেয়েটার গায়ে গরম পানি ঢেলে দিল তবুও আপনি কোন প্রতিবাদ করলেন না!! মেয়েটার শরীরে ফোস্কা পরে চিৎকার করে কাঁদছিল আর আপনি এমন ভাব করলেন যে আপনি ব্যাপারটা দেখনই নাই!! তখন বুঝলাম আপনিও আমার মত অদৃশ্য মানব!! আপনাকে ব্যাপারটা জানাতে হবে আমার!! আপনাকে যদি অদৃশ্য হওয়ার থেকে রক্ষা করতে পারি তাহলে আমিও এই জীবন থেকে রক্ষা পাবো!! রক্ষা পাবে আপনার ঘরের কেউ না কেউ!!
-এইবার আমি বুঝতে পেরেছি আপনি পুলিশের লোক নাহয় চাঁদাবাজ!! কিভাবে কিভাবে খবর পেয়েছেন মেয়েটার কথা এখন এসেছেন চাঁদা দাবি করতে!! আমিতো মেয়েটার বাবাকে কিছু টাকা দিয়েও বলেছি ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতে!! গরীবের এই এক সমস্যা যার কাছে যতবেশি পাবে সেই দলে যোগ দিবে!! তো বলেন কত টাকা চাই আপনার?? কত হলে মুখ বন্ধ হবে আপনার??
-স্যার মেয়েটার দাফনের যত টাকা লাগে তত টাকা মেয়েরটার বাবাকে দিয়ে দেন আমার টাকা লাগবে না!! আর পুলিশের কাছে গিয়ে এই অন্যায়ের কথা জানান!! বুঝলেন স্যার মেয়েটা বিকালে মারা যায় স্যার!! তার বাবা ভয়ে কাউকে নালিশ করতে পারছে না!! আপনার শ্যালক গিয়ে তাকে ভয় দেখিয়ে এসেছে!! স্যার একটু প্রতিবাদ করুন নাহয় এই অদৃশ্য মানবের জীবন সহ্য করতে পারবেন না!! প্রিয়জন হারানোর কষ্ট নিতে পারবেন না!! কারন এই অন্যায়ের শাস্তি আপনার পরিবারের কেউ না কেউ ভোগ করবে!! প্রিয় কারো কষ্ট সহ্য করতে পারবেন স্যার?? “বের হন আপনি!! বের হন আমার চেম্বার থেকে!! বেটা ফাজিল কোথাকার!!” ডা: হাসান এনাম রাগে ক্ষোভে উনার অ্যাসিস্ট্যান্টকে ডেকে বললেন, একে বের করো!! তাড়াতাড়ি বের করো!! বের না হলে পুলিশ ডাকো!! কিন্তু ডাঃ হাসান এনামের অ্যাসিস্ট্যান্ট রফিক রুমে ঢুকে দেখে রুমে ডা: হাসান ছাড়া কেউ নেই!! স্যারের মাথা গরমের কোন কারন বুঝলো না সে!!
হাসান সাহেব বুঝলেন, কালকের ঘটনায় মন মেজাজ খারাপ তাই হয়তো কোন সমস্যা হচ্ছে!! বাসায় গিয়ে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুম দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে!! তাই তিনি আজকের মত রোগী দেখা বন্ধ করে বাসায় চলে যান!! বাসায় গিয়েই তিনি স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন মেয়েটা কি সত্যি মারা গিয়েছে কিনা!! আর শোনেন মেয়েটা সত্যি মারা গিয়েছে তবে ভয়ের কিছু নাই তার শ্যালক সব দেখছে!! মেয়েটার পরিবার চুপ আছে!! তারা কোন সমস্যা করবে না!!
হাসান সাহেব নিশ্চিন্ত মনে পরিবারের সাথে রাতের খাবার শেষে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুম দেন!! তার ঘুম ভাঙে মধ্যরাতে স্ত্রীর চিৎকার শুনে!! তাদের একমাত্র মেয়েটা রুমের ভেতর থেকে আগুন আগুন বলে চিৎকার করছে!! ভেতর থেকে দরজা লাগানো তাই কোন ভাবেই বাহির থেকে দরজা খুলতে পারছে না হাসান সাহেবের স্ত্রী!! হাসান সাহেব বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে গিয়ে মেয়ের রুমের দরজায় একের পর লাথি দিচ্ছেন কিন্তু কিছুতেই সেই লাথি দরজায় লাগছে না!! ভয়ে তিনি স্ত্রীকে বললেন আশেপাশের মানুষ ডাকতে কিন্তু তার স্ত্রী তার কোন কথাই শুনতে পারছেন না!!শুধু চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে, আমার মেয়েটা মারা যাচ্ছে তুমি কই?? আমার মেয়েটাকে বাঁচাও!! সকালে অনেক মানুষ আসে হাসান সাহেবের বাসায়!! সবাই অবাক হচ্ছেন একটা মেয়ে ঘরের মধ্যে পুড়ে মারা গেছে আবার রাত থেকে মেয়েটার বাবাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!! অথচ হাসান সাহেব তখন তার মেয়ের পোড়া মৃত দেহটার সামনেই বসে আছেন!! অনেক চেষ্টা করেছেন শুধু একবার মেয়েটার পোড়া শরীরটা একটু স্পর্শ করতে কিন্তু পারছেন না!! মেয়েটার শরীরের পোড়া গন্ধও তার নাকে আসছে না!!
-কি স্যার বলেছিলাম না অদৃশ্য মানব হওয়া অনেক কষ্টের??
-কে রবি??
-জ্বী স্যার আমি!! চলুন আমরা অন্য অদৃশ্য মানব খুঁজে বের করি!! অন্য কাউকে অদৃশ্য হওয়া থেকে রক্ষা করি তাহলে এই জীবন থেকে আমরাও রক্ষা পাবো!!
-রবি আমার মেয়েটার কপালে একটা চুমো দিয়ে আসি??
ডা: হাসান এনাম শত চেষ্টা করেও তার মেয়েটার কপালে একটা চুমো দিতে পারছেন না!! চিৎকার করে কাঁদছেন তিনি তবুও কেউ শুনছে না তার এই চিৎকার!! কারন এখন তিনি একজন অদৃশ্য মানব!! সম্পূর্ন অদৃশ্য মানব!!
-মো: ফজলে খোদা রায়হান